লুনানা'তে প্রকৃতপক্ষেই কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সৌরশক্তি আর একটামাত্র ক্যামেরা ব্যবহার করে 'লুনানা'র পুরো শুটিং হয়। যে কারণে টেকনিশিয়ান সহ পুরো টিমকেই নানা বৈপরীত্যে পড়তে হয় ক্রমশ। আর এভাবে জন্ম নেয়া সিনেমাটিই করে অসাধ্যসাধন। দ্বিতীয় ভুটানি সিনেমা হিসেবে অস্কারে যাওয়া এবং প্রথম ভুটানি সিনেমা হিসেবে অস্কারে নমিনেশন পাওয়া এই সিনেমার নির্মাতা পাও চয়নিং দর্জিরও এটা অভিষেক নির্মাণ!

মাটি থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে খণ্ড এক জনপদ, যে জনপদে মানুষ সর্বসাকুল্যে আটান্ন জন, সভ্যতার ছিটেফোঁটা অনুষঙ্গ থেকেও যাদের অবস্থান বহুদূরে, যেখানের আকাশ স্ফটিক-স্বচ্ছ, যেখানে দূরগামী মেঘের আড়ে উঁকি দেয় পাহাড়, চমরী গাইয়ের গলার ঘন্টার মৃদু টুংটাং আর বাতাসের চাপা ফিসফাসে যেখানে মিশে থাকে অদ্ভুত সারল্য... সেখানে যদি কোনোদিন উপস্থিত হন নগর সভ্যতায় আষ্টেপৃষ্টে বদ্ধ এক মানুষ, কী করবেন তিনি? তিনি কি মুহুর্তকালও টিকতে পারবেন সেখানে? নাকি, ডাঙ্গায় ওঠা মাছের মত তড়পাবেন? নাকি, একসময়ে মানিয়ে নেবেন ঠিকঠাক? 

নাগরিক সভ্যতার সর্বশেষ জংশন থেকে খাড়া আট দিনের যাত্রাপথে পৌঁছাতে হয় যে লুনানায়, যে 'লুনানা' শব্দের অর্থ অন্ধকার উপত্যকা, সে লুনানায় একদিন আসার ডাক পড়ে 'উগেন' নামের এক তরুণ শিক্ষকের। যদিও 'লুনানা'র আলো-ঝলমলে দিন আর রাতের আকাশের টলটলে ছায়াপথ দেখে এই জনপদকে কেন 'অন্ধকার উপত্যকা' ডাকা হয়, তার সার্থকতা খুঁজে বের করা যায়না। তবু নাম যেহেতু এটাই, অগত্যা, মেনে নিতেই হয়। তবে যতই আলো-ঝলমলে স্থান হোক আর নৈসর্গিক সৌন্দর্য থাকুক, উগেনের এই পাণ্ডববর্জিত লোকালয়ে আসার যে তিলমাত্রও ইচ্ছে নেই, সেটাও কালক্রমে বুঝতে পারা যায়। পাশাপাশি, এটাও জানা যায়, উগেনের 'শিক্ষক' হওয়ারই ইচ্ছে নেই মোটেও। সে হতে চায় গায়ক। যেতে চায় বহু দূরের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু কমিউনিটি প্রোগ্রামের নাগপাশে বিদ্ধ হয়ে, অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগমুহুর্তে তার দায়িত্ব পড়ে 'লুনানা' যাওয়ার। সেখানে পাহাড়-মেঘ-বৃক্ষসারির মাঝখানে মুখব্যাদান করে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলের শিক্ষক হবার 'আদেশের ঢেঁকি' গেলার জন্যেই তাকে রওয়ানা হতে হয় বিশ্ব-চরাচর থেকে বহুদূরের এই নিশ্চিন্তিপুরের উদ্দেশ্যে! 

'লুনানা'র পথে উগেনের যাত্রা শুরু হয় একদিন। খাড়াই পাহাড়, বন্য ঝর্ণা, পাহাড়ের কোলে ছোট্ট সরাইখানা, তাবু খাটিয়ে বিশ্রাম, পাতা-ডালের জ্বালানি, আগুনের মটমট, কাদামাটিতে হাঁচড়পাঁচড়...নানাবিধ কোমল-কঠোর বিচিত্র অভিজ্ঞতায় এগোতে এগোতে একদিন সে পৌঁছেও যায় লুনানায়। এবং সেখানে গিয়েই প্রবল এক মানসিক ধাক্কার মুখোমুখি হয় উগেন। বুঝতে পারে, 'লুনানা'র সময় থেমে গেছে বহুকাল আগেই। সর্বগ্রাসী সভ্যতার লেশমাত্রও আসেনি এখানে। উগেন আরও বুঝতে পারে, বহু বছরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধায় অভ্যস্ত সে এখানে টিকতে পারবেনা ক্ষণকালও। যে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সে, সেই স্কুলকে দেখে মানসিক পীড়া যেন বেড়ে যায় আরো খানিকটা৷ মাটির নাজুক দেয়াল, কাঠের বিহ্বল দরজা-জানালা, ভেতরের হতশ্রী আসবাব, বেঞ্চিতে কয়েক স্তরের পুরু ধুলো... তরুণ এ শিক্ষক বুঝতে পারে ভুল করে ভুল জায়গায় চলে এসেছে সে। তবুও সাময়িক বিহ্বলতা কাটে তাড়াতাড়িই। টালমাটাল পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা শুরু হয় তার। এই বৈপরীত্যের খাসমহলের সাথে আঁতাত করার অসম্ভব প্রচেষ্টাই যেন ক্রমশ শুরু করে উগেন! 

একঝাঁক উদ্যমী শিশু! 

'লুনানা'য় কয়েকদিন বসবাস করে উগেন বুঝতে পারে, এখানকার মানুষ যেমন সভ্যতার সুবিধে পায়নি, তেমনি সভ্যতার কৃত্রিমতাও ছুঁতে পারেনি তাদের। অদ্ভুত সারল্যময় আর নিপাট ছিমছাম তাদের জীবনযাপন। উগেনকেও তারা যেন প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ভালোবাসে, সম্মান করে। একজন শিক্ষককে কেন এত সম্মান, এই প্রশ্নের জবাবে যখন একজন বলে- 'কারণ শিক্ষকই ভবিষ্যৎকে ছুঁতে পারে' তখন বুঝতে পারা যায়, এরা শুধু মানুষ হিসেবেই উন্নত না, এদের জীবনবোধ ও চিন্তার পরিধিও গড়পড়তা মানুষের থেকে ভিন্ন। 

পরিবেশ, প্রতিবেশ কিংবা সময়ের প্রভাবেই উগেন আস্তে আস্তে সহজ হয়। এখানের মানুষের সাথে রসায়ন হয়, পড়াশোনা নিয়ে আগ্রহী শিশুদের সাথে মিথস্ক্রিয়া বাড়ে। চঞ্চল শিশু পেম জামের মিষ্টি হাসি, লাজুক তরুণী সালডনের গলায় আধ্যাত্মিক 'ইয়াক লেবি লাধার' গান, 'নরবু' নামের হৃষ্টপুষ্ট চমরী গাই কিংবা পরোপকারী মিশেন... সবার সাথেই আশ্চর্য হৃদ্যতা তৈরী হয় উগেনের। এদিকে সময় গড়ায়। যাবার ক্ষণ ঘনিয়ে আসে কাছে। ফিরতে হবে নাগরিক ল্যাম্পপোস্টে। যেতে হবে অস্ট্রেলিয়ায়। ঘড়ির কাঁটা সরীসৃপের মত এগোয়। পাশাপাশি, এগোতে থাকে গল্পও 

ভুটানের সিনেমা 'লুনানাঃ আ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম' শেষ করে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি বহুক্ষণ। ভেতরে ভেতরে অনেক কথাই বুদবুদের মত তৈরী, কিন্তু সেগুলো বাইরে বের করতে ইচ্ছে না হওয়ার মত বিরল এক অভিজ্ঞতায় পেয়ে বসে যেন। শঙখ ঘোষের সেই কথাটুকুই মনে আসে বারবার- চুপ করো, শব্দহীন হও। কথা বললেই যেন কেটে যাবে ঘোর, 'লুনানা'র সময়কালের এই যে অবিশ্বাস্য অপার্থিব ঘোর, তা কেটে যাবার শঙ্কাতেই নির্বাক, নিস্তব্ধ থাকতে হয় বহুক্ষণ। 

দূর পাহাড়ে গায়ে খেলনার ঘরবাড়ি! 

যদি গল্পের কথা বলা হয়, গল্প খুব যে নতুন সেরকম না মোটেও। আসামিজ সিনেমা 'আমিষ' এর গল্পে যেমন ক্ষণে ক্ষণে মুখোমুখি হয়েছিলাম অন্যরকম এক চমকের, সেরকম চমক এ গল্পে মোটেও নেই। কিন্তু 'লুনানা'র ঐ সবুজ পাহাড়, রোদে ঝলসানো চকচকে হিমালয়, নুড়িপাথরের বুকে কুলুকুলু খরস্রোতা নদী, চমরী গাইয়ের ঘুঁটে থেকে জ্বালানো রাতের আলো, দূর পাহাড়ের গায়ে খেলনার ঘরবাড়ি, হ্যাজাকের আলোর মত সরল এক গল্প... এ সিনেমা যখন শেষ হয়, তখন ভেতরের খুব ব্যক্তিগত অঞ্চলের যাপিত সব গুঞ্জন থেমে গিয়েছে পুরোপুরি। আশ্চর্য এক নীরবতার মুখোমুখি তখন, 'সিনেমা'র সংজ্ঞাই খানিকটা পাল্টানোর উপক্রম যেন। 

'লুনানা'য় রূপকের আড়ালে মুহুর্তে মুহুর্তে যেমন এলো দারুণ সব প্রসঙ্গ, মুগ্ধ হলাম সেখানেও। এলো বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রসঙ্গ। এলো শিক্ষাব্যবস্থার হতশ্রী দশা নিয়ে মৃদু পরিহাসও। ভুটানকে বলা হয়- পৃথিবীর সবচেয়ে হাসিখুশি দেশ । এমনকী সিনেমার একেবারে প্রথমেই প্রোটাগনিস্ট উগেনের টিশার্টের পেছনে লেখা থাকতে দেখি- জিএনপি (গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস)। এই প্রসঙ্গে খুব সুন্দর এক প্রসঙ্গেরও অবতারণা হয়। 'লুনানা'র গ্রামপ্রধান যখন জানতে পারে উগেন চলে যাবে অস্ট্রেলিয়ায়, তিনি খানিকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেন-

যে দেশকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ বলা হয়, সে দেশের মানুষই সুখ খুঁজতে যাবে অন্য কোথাও?

এরকম টুকরো টুকরো বাক্য, দৃশ্য, স্থান-কাল-পাত্র পুরো সময়েই আশ্চর্য এক সঙ্গত দিয়ে যায় 'লুনানা'কে। এবং শেষপর্যন্ত এভাবেই, নানা উপকরণের মিলিত মিশেলে এই নির্মাণ শুধুমাত্র এক 'চলচ্চিত্র'র গণ্ডিতে আটকে না থেকে পৌঁছে যায় বহুদূরের ভিন্ন এক উচ্চতায় 

উগেন ও সালডনের এই টুকরো স্মৃতিও কি ভোলা যাবে? 

অন্য প্রসঙ্গে আসি৷ ভুটানের এই সিনেমা এবারের অস্কারের 'বেস্ট ইন্টারন্যাশনাল ফিচার ফিল্ম' এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় আসার পর থেকেই সিনেমাটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছিলো। এই নির্মাণের নির্মাতা পাও চয়নিং দর্জি'র সাক্ষাৎকার থেকে যেমন জেনেছিলাম, 'লুনানা'তে প্রকৃতপক্ষেই কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সৌরশক্তি আর একটামাত্র ক্যামেরা ব্যবহার করে 'লুনানা'র পুরো শুটিং হয়। টেকনিশিয়ান সহ পুরো টিমকেই নানা বৈপরীত্যে পড়তে হয় ক্রমশ। আর এভাবে জন্ম নেয়া সিনেমাটিই করে অসাধ্যসাধন। দ্বিতীয় ভুটানি সিনেমা হিসেবে অস্কারে যাওয়া এবং প্রথম ভুটানি সিনেমা হিসেবে অস্কারে নমিনেশন পাওয়া এই সিনেমার নির্মাতা পাও চয়নিং দর্জিরও এটা অভিষেক নির্মাণ। এবং প্রথম সিনেমা দিয়েই পুরো ভুটানকে তিনি যেভাবে অপরিমেয় খুশির এক উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেন, সেটা যেন সিনেমা-সংক্রান্ত মুগ্ধতাকেই বাড়িয়ে দেয় বহুখানি। 

বৌদ্ধ ধর্মে একটা প্রবাদ খুব জনপ্রিয়- 

Nothing is permanent, so everything is precious. 

'লুনানা'র পরতে পরতে যেন মিশে থাকে সেই অমোঘ সত্যটুকুই। সুখী হতে খুব বেশি কিছুর যে দরকার নেই মোটেও এবং অপ্রত্যাশিত স্থান থেকেই যে আমরা সবসময় পাই মূল্যবান সব প্রাপ্তির খোঁজ... 'লুনানা'র জীবনঘনিষ্ঠ চালচিত্র সজাগভাবেই দিয়ে যায় সে বার্তা। এবং হয়তো সে কারণেই 'লুনানা' থেকে যায় ভেতরে, নৈশব্দের মোড়কে, বিচ্ছিন্নতার সংযোগে। ভাবতে ভালো লাগে- সুখী দেশের মানুষই তো সুখী হবার এমন গভীর জীবনবোধের সন্ধান দিতে পারে! বহুদূরের ভূখণ্ড হওয়া সত্বেও তাই 'লুনানা'র পাহাড়-নদী-উপত্যকার সাথে আশ্চর্য নৈকট্য অনুভব করি। 'লুনানা' নামক সংযোগসেতু মানচিত্রের তারতম্য ঘুচিয়ে যোগাযোগের কাজটিই করে দেয় অলক্ষ্যে। মুগ্ধ হই, তৃপ্ত হই, স্থির হই। জীবন নিয়ে একটু অন্যরকমভাবে আবার ভাবতে বসি। এই ভাবনাটাই শান্তির। এবং এই সিনেমার সার্থকতাও সেখানেই। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা