রহস্যময় হাসি, ঐন্দ্রজালিক নাচ অথবা জীবন্ত অভিনয় তো রইলোই, এগুলো ছাপিয়েও মাধুরী দীক্ষিত এর সবচেয়ে বড় পরিচয়, স্রোতের বিপরীতে লড়াই করতে করতে নিজের এক আলাদা স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি বলিউডে। যে স্থান আর দখল করতে পারেনি কেউ...

রহস্যময় হাসি, ঐন্দ্রজালিক নাচ অথবা জীবন্ত অভিনয় তো রইলোই, এগুলো ছাপিয়েও মাধুরী দীক্ষিত এর সবচেয়ে বড় পরিচয়, স্রোতের বিপরীতে এক প্রতিকূল সময়ে এসে লড়াই করে নিজের এক আলাদা স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি৷ তাই বলিউডের এই 'ফিমেল সুপারস্টার এর গল্প শুরু করতে হলে, ফিরে যেতে হবে সেই বিখ্যাত ট্রিভিয়ায়-

'হাম আপকে হ্যায় কৌন' সিনেমায় সালমানের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন মাধুরী! 

অনেকেই জানেন তথ্যটি। তবে যদি প্রথমবার আপনি এ তথ্য দেখে থাকেন, চোখ কপালে উঠে যাওয়ার কথা। এই ঘটনাটিকে চাইলে আপনি এক লাইনের একটি তথ্যকণিকা ভাবতে পারেন৷ অথবা, এটিকে ভাবতে পারেন প্যারাডাইম শিফটের খুব উজ্জ্বল এক কেস-স্টাডি হিসেবে৷ যেখানে পুরুষ-সর্বস্ব বলিউডের মখমল গালিচায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এক নারী, তাও মূল পুরুষ চরিত্রের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিয়ে৷ ভাবতে একটু কষ্ট হলেও এই উল্টোপুরাণের গল্পই সম্ভব করেছিলেন বলিউডের এই লাস্যময়ী নায়িকা।

বলিউড, বাজারের চেয়েও বড় বিগ বাজার৷ বিশাল অডিয়েন্স৷ অজস্র কুশীলব। অগুনতি কন্টেন্ট৷ আলোর কারিকুরি৷ বাংলায় একটা বাগধারা আছে,  প্রদীপের তলাতেই সবচেয়ে বেশি অন্ধকার৷ সেই বাগধারাকে মেনেই আমরা বরাবর লক্ষ্য করেছি- বলিউডের চোখধাঁধানো জৌলুশের সাথে সাথে সেখানে লতায়-পাতায় বেড়ে ওঠে ঈর্ষা, রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি৷

সেই শ্বাপদসংকুল বলিউডে মাধুরী যখন বলিউডে পায়ের নীচে শক্ত মাটি খুঁজে বেড়াচ্ছে, আশির দশকের সেই সময়ে শ্রীদেবী তখন বলিউডের ডাকসাইটে অভিনেত্রী৷ তুমুল তাঁর জনপ্রিয়তা, খ্যাতি, প্রভাব৷ অথচ সময়ের ফেরে নবাগতা মাধুরীই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন মহীরুহ শ্রীদেবী'র। দুজনে টক্কর দিয়েছেন সমানে সমানে। মাধুরী-শ্রী'র এই স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা বজায়ও ছিলো বহুদিন। মাধুরী শুধু যদি শ্রীদেবীর সাথেই টক্কর দিতেন, তাহলেও তো হতো৷ তিন খান- আমির, সালমান, শাহরুখ এদের সাথেও পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন অজস্র সব কালজয়ী সিনেমার অন্যতম মূখ্য কুশীলব, এ নায়িকা। 

দেহ-সর্বস্ব আর জবরজং ডায়লগ-সর্বস্ব নায়িকা তো কালে কালে, যুগে যুগেই ছিলো। সেখানেও মাধুরীর ভিন্ন উপস্থিতি চমকে দিয়েছে দর্শকদের। আঞ্জাম সিনেমার কথা মনে আছে? সেখানের মাধুরীর আগ্রাসী-রূপ মনে আছে? আচ্ছা, আঞ্জাম এর কথা নাহয় বাদই দিলাম৷ আজা নাচলে অথবা গুলাব গ্যাং... সিনেমা একা টেনে নেওয়ার গুরুদায়িত্ব যদি কখনো তাঁর উপরে অর্পিত হয়, তিনি সে দায়িত্বপালনেও ছিলেন স্বমহিমায় ভাস্বর।

মাত্র সতেরো বছর বয়সে আসেন পর্দায়, হীরেন নাগের 'অবোধ'  সিনেমায়, তাপস পালের বিপরীতে। যদিও এই সিনেমা প্রচুর সমালোচনা কুড়িয়েছে। তবুও আলাদা করে নজর কেড়েছিলেন- মাধুরী। মাঝখানে কয়েকটা 'উল্লেখ অযোগ্য' সিনেমার পরেই আসে বারুদে ঠাসা  'এক দো তিন।" হ্যাঁ, "তেজাব" সিনেমার কথা বলছি। সেই সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয় আর সেই বিখ্যাত গান আর নাচ... বলিউডের বিশটা সুপারহিট গানের তালিকা করলে এখনও সে গানকে অনায়াসে জায়গা দেয়া যাবে। আর নাচ! আলাদা করে আর কীই বা বলা যায়!  মাত্র তিন বছর থেকে নাচের তালিম নিয়ে নিয়ে নাচটাকে যে ছেলের হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলবেন, তাও বা ভেবেছিলো কে? 

'এক দো তিন' গানে মাধুরীর সেই বিখ্যাত ড্রেসআপ! 

অভিনয় করলেন সাজান, বেটা, হাম আপকে হ্যায় কৌন এর মত সিনেমায়। ক্রমে ক্রমে দিল তো পাগল হ্যায়, খলনায়ক, রাম লক্ষ্মণ, কোয়লা'র মতন সুপারহিট সব ছবি এলো তার অ্যাকাউন্টে। মাধুরীর পায়ের নীচে শক্ত মাটি না, গজিয়ে গেলো কংক্রিটের রাস্তাই! 

সময়ের ফেরে নানা বিস্ফোরক খবরের শিরোনামও হয়েছেন তিনি। সঞ্জয়ের সাথে তুমুল প্রেম, সুরেশ ওয়াদেকর এর সাথে বিয়ের গুঞ্জন, মিঠুন বা অনীলের সাথে প্রেম নিয়েও গুঞ্জন রটেছে বলিউড পাড়ায়। যেগুলোর কোনোটা সত্যি। কোনোটা আংশিক সত্যি। আবার কোনোটার পুরোটাই মিথ্যের বেসাতি৷ 

যখন যে চরিত্র, সে চরিত্রেই দুর্দান্ত সব পারফরম্যান্স দিয়েছেন৷ নিজেকে ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন। নিজের দুয়েকটা জায়গায় খামতি থাকলে সেগুলো পুষিয়ে দিয়েছেন নিজের শক্তির জায়গাগুলোতে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স দিয়ে৷ সে কারণেই আলাদাভাবে মাধুরীর স্টাইলটাই হয়ে গিয়েছে ভিন্ন। যে স্টাইল পরবর্তীতে অনুসরণ করেছেন বলিউডের অনেক নায়িকা। সে প্রসঙ্গে মাধুরীর কয়েকটা লাইন তুলে দেয়া যায়-

আমি যখন প্রথম প্রথম এই ইন্ডাস্ট্রি'তে আসি, এখানের হালচাল, ছাঁচ বুঝতে সময় চলে গেলো বেশ খানিকটা। এরপর নিজের মত করেই শুরু করলাম সব। আস্তে আস্তে দেখলাম পুরোটাই সড়গড় হয়ে গিয়েছে৷ নিজের একটা আলাদা স্টাইল-ই দাঁড় হয়ে গিয়েছে।' 

আজকের এই দিনে চুয়ান্ন বছরে পা দেওয়া এই 'তরুণী'র হাসি, রূপ এখনও বিচলিত করে কোটি ভক্তকে। এখনও ফিল্ম ক্রিটিকরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়- মাধুরী'র মতন এমন কমপ্লিট প্যাকেজ বলিউডে আর আসেনি এরপর। স্রোতের বিপরীতে নৌকার বৈঠা আঁকড়ে ধরে যে সংগ্রাম তিনি শুরু করেছিলেন, এ কথা নির্দ্বিধায় এখন স্বীকার করাই যায়, তিনি সে সংগ্রামে সফল। শুধু 'সফল' বললে ব্যাপ্তির অতলান্ত সীমা বোঝা যাবেনা হয়তো। তিনি এতটাই অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন জীবনভর এ সংগ্রামে, দাপটের সাথে বলিউডের 'হল অব ফেম' এর চূড়ার দিকের আসনেই আসীন হয়েছেন। মাধুরীর চমৎকারিত্ব এখানে। উৎকর্ষও এখানে।

মধ্য পঞ্চাশে এসেও তিনি আগের মতই মোহনীয়! 

যিনি বলিউডের নানা ছাঁচে বিপর্যস্ত হতে হতে, নিজেই নিজের স্বকীয় ছাঁচকে বানিয়েছেন দুর্দান্ত এক 'ব্রান্ড।' 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা