মালিক: ফাহাদ ফাসিলের ম্যাজিক এবং আরেকটি মালায়ালাম মাস্টারপিস!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দুটি কুকুর মিলে মানুষের ফেলে দেয়া এঁটো পাত থেকে খাবার খাচ্ছে- এই দৃশ্য দিয়ে শুরু করে পরিচালক প্রথমেই যেন এক আভাস দিয়ে রাখেন, সিনেমার ন্যারেশন স্টাইল অর্থোডক্স হবে না, মোটেও প্রথাগত পথে গল্প বলবেন না তিনি৷ এবং ঠিক সেটাই লক্ষ্য করি পুরো সিনেমার ট্রিটমেন্টে...
ইতিহাসবিদ ইউভাল নো হারারি'র 'টুয়েন্টি ওয়ান লেসনস ফর দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি' বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, সাম্প্রতিক বিশ্বে কোনো সরকার যদি স্বৈরশাসক হয়ে উঠতে চায়, তাহলে সে প্রথমেই নিয়ন্ত্রণ করবে দেশের গনমাধ্যমগুলোকে৷ এই বাক্য যে নির্জলা সত্য, তা আমরা বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারি। জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস '১৯৮৪' এর কালজয়ী লাইন ছিলো, বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ। এই 'বিগ ব্রাদার' অর্থাৎ প্রশাসনের নজরদারির সার্থক মঞ্চায়ন নিয়মিত দেখি আজকের এই ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীতে। সিনেমাই হোক, সাহিত্য হোক অথবা রোজকার খবর, সবখানেই সেন্সরশিপের অদৃশ্য কাঁটাতার।
তবু এসব বেড়াজাল ডিঙিয়েও, যারা রূঢ় গল্প বলতে চান, তারা নিয়মিতই হাজির হন একেকটা নতুন পথে। সেরকমই এক পথ- ওটিটি। অস্বস্তিকর বিধিনিষেধের বাতাবরণ উপেক্ষা করে এই ওটিটি-র কল্যানেই সাম্প্রতিক সময়ে অদ্ভুত সুন্দর কিছু নির্মাণ উঠে আসতে দেখি পৃথিবীব্যাপী। যেহেতু এই মাধ্যমটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র এখনো কব্জা করে উঠতে পারে নি, ঠিক সে কারণেই নির্বিঘ্নে এখানে মঞ্চস্থ হচ্ছে একের পর এক ধ্রুপদী নির্মাণ। যে নির্মাণের খুব সফল এক নিদর্শন, সাম্প্রতিক মালায়ালাম সিনেমা- মালিক।
'রামাদাপল্লী' নামের সমুদ্রতীরবর্তী এক জনপদের গল্প এই নির্মাণের উপজীব্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন পদ্মাপারের কেতুপুর গ্রাম সম্পর্কে বলেছিলেন-ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না! তেমনটি আমরা লক্ষ্য করি এই রামাদাপল্লীর ক্ষেত্রেও। সমুদ্র উদার, কিন্তু সমুদ্রতীরের এই মানুষেরা ততটা না। অথবা, হয়তো তারাও এককালে উদার ছিলেন। কিন্তু সময়, রাজনীতি, ধর্ম, অভাব...বহু চলকের অদৃশ্য ইশারায় তারাও ক্রমশ রূপান্তরিত হয়েছে সংকীর্ণ জীবনবোধের রক্তমাংসের প্রাণীতে।
এই রামাদাপল্লীর পুঁতিগন্ধময় গুমোট বাতাসে বেড়ে ওঠে সবাই, তাদের সাথে বেড়ে ওঠে আরেকজন বিশেষ মানুষও, যার নাম- আহম্মাদালি সুলায়মান ওরফে আলি ইক্কা। সময়ের ফেরে সে হয়ে ওঠে এই জনপদের হর্তাকর্তাবিধাতা। তার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ধর্ম, অধর্ম, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, রাজনীতি, অর্থনীতির দোলাচলও। সময়ের ফেরে জীবন পালটায়, পালটায় সমাজব্যবস্থা, পালটে যায় মানুষের মধ্যবর্তী আবেগগুলোর ভারসাম্যও।
এই প্রেক্ষাপট নিয়েই পুরো গল্প। দুই ঘন্টা একচল্লিশ মিনিট রানটাইমের এ সিনেমা শুরু হয় খুব মেটাফোরিক্যাল এক মেমোয়ার দিয়ে। দুটি কুকুর মিলে মানুষের ফেলে দেয়া এঁটো পাত থেকে খাবার খাচ্ছে...এই দৃশ্য দিয়ে শুরু করে পরিচালক প্রথমেই যেন এক আভাস দিয়ে রাখেন- সিনেমার ন্যারেশন স্টাইল অর্থোডক্স হবে না, মোটেও প্রথাগত পথে গল্প বলবেন না তিনি৷ এই ধারণা আরেকটু পাকাপোক্ত হয়, যখন প্রথম শটটা টানা তেরো মিনিটেরও বেশি সময় ধরে চলে। এই বিশেষ শটের নানারকম ঘটনা-পরম্পরায় পুরো সিনেমার এক ছোটখাটো সারসংক্ষেপ দেয়ারই প্রয়াস চালান পরিচালক। সাম্প্রতিক সময়ে মালয়লাম সিনেমা 'বিরিয়ানি'র প্রথম দৃশ্য দেখে যেরকম ধাক্কা খাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো, সেটার যেন পরিবর্ধিত সংস্করণ উপলব্ধি করি 'মালিক' এ।
মোটাদাগে এক মাফিয়ার উত্থানের গল্প হতে পারতো 'মালিক।' সেটা হওয়াটাই সহজ ছিলো। কিন্তু নির্মাতা মহেশ নারায়ণ সে পথে হাঁটলেনই না৷ তিনি 'আলি ইক্কা' নামের সে মাফিয়াকে সম্মুখে রেখে নগ্ন করলেন সমাজের নানাবিধ নোংরামিকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, প্রশাসনযন্ত্রের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতি, প্রেম, ভালোবাসা, খুন, রহস্য...এত এত লেয়ার তিনি সিনেমায় আনলেন এবং সে লেয়ারগুলো আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন পর্দায়, তাও নিরপেক্ষ থেকে...এই অসাধ্যসাধন করতে আসলে কতটুকু হিম্মত লাগে, তা জানতে সিনেমাবোদ্ধা হওয়ার দরকার নেই। কোনোরকম জাজমেন্টাল টোন না রেখে নিষ্পৃহভাবে বিচিত্র সব দ্বৈরথকে তিনি যেভাবে ট্রাপিজের সরু তালে দোলালেন...মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
মালয়লাম সিনেমার শিল্পীদের অভিনয়ের খুঁত ধরার ধৃষ্টতা করছি না। করা ঠিকও হবে না। মাত্র দুই-এক মিনিটের জন্যেও যারা স্ক্রিনে এলেন, দুর্দান্ত অভিনয় করলেন। নিমীশা, জজু জর্জ, ভিনয় ফোর্ট...এরা বরাবরই অসাধারণ। এই সিনেমাতেও ব্যতিক্রম না। আলাদা করে বলতে হবে একজনের কথা, ফাহাদ ফাসিল। চোখ দিয়ে তিনি অভিনয় করেন, তা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই সিনেমার তিনটা টাইমলাইনে তিনি যে অভিনয় করলেন, তা চোখে লেগে থাকবে বহুদিন। এ বছরে মুক্তি পাওয়া ইরুল, জোজি সিনেমায় তার যে অভিনয়, সেখান থেকে আলাদা এক অবতারে এসে যেভাবে নিজের ক্যারেক্টারকে স্টাবলিশ করলেন, তা অনবদ্য। মলিউডের জন্যে ফাহাদ ফাসিল যে এক আশীর্বাদের নাম, তা বলা মোটেও অত্যুক্তি না।
মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আগেও বহুবার এ কথা বলা হয়েছে, এরা গল্প কিভাবে বলতে হয়, তা জানে। সে প্রেমের গল্প হোক, রহস্যের গল্প হোক কিংবা পিওর পলিটিক্যাল ড্রামার গল্পই হোক। সিনেমার চিত্রনাট্য তারা এমনভাবেই সাজায়, এমনকি সাধারণ এক গানকেও তারা অপচয় করে না। সেখানেও গল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তারা যুক্ত করে। ব্যতিক্রম না 'মালিক'ও। ন্যারেশন স্টাইল, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ডায়লগ, সিনেম্যাটোগ্রাফী আর গল্প...সব বিভাগই দুর্দান্ত! এই তুখোড় নির্মাণের নির্মাতা মহেশ নারায়ণকেও একটু কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। 'ল্যাপটপ' জনরার 'সিইউ সুন' কিংবা ইরাকে মালয়ালিদের উপর অত্যাচারের সত্য ঘটনা নিয়ে নির্মিত 'টেক অফ'... তিনি নিজের স্বকীয়তা বরাবরই প্রমাণ করেছেন। এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন মালায়লাম ক্লাসিক এননু নিনতে মইদিন, বিশ্বরূপম, ট্রাফিক... সিনেমাতে। এই নির্মাতা 'মালিক' বানাতে গিয়ে এরকম চমক যে দেবেন, তা খানিকটা তাই অনুমিতই ছিলো।
বছর শুরুর পর থেকেই একের পর এক যেরকম রুদ্ধশ্বাস নির্মাণের পসরা সাজিয়ে বসেছে মলিউড, তাতে অবাক হওয়ার বোধও এখন স্তিমিত হওয়ার উপক্রম। আবার সামনে কোন চমক নিয়ে তারা আসবে জানি না, তবে এটুকু জানি, যে চমকই আসুক না কেন, তারা নিরাশ করবে না। সে ভরসার জায়গাটুকু দুর্দান্তভাবে দখল করে নিয়েছে মলিউড...