বিহারের প্রত্যন্ত এক গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অভিনেতা হয়েছেন তিনি, পেরিয়েছেন হাজারো বাধা-বিপত্তি, সয়েছেন ব্যর্থতা। মনোজ বাজপাইর এই যাত্রাটাও সিনেমার চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়...

অভিনেতা হওয়াটা শখের কোন কাজ না, কোন অপশনও না। নয়টা-পাঁচটার চাকরির সাথে অভিনয়ের কোন সম্পর্ক নেই সত্যি, কিন্ত সত্যিকারের অভিনেতা যে হতে চায়, আর সংগ্রামের হাজারটা অধ্যায় পেরিয়ে 'অভিনেতা' উপাধিটা যার নামের পাশে বসে, তারাই জানে এই পথটা কতটা কণ্টকাকীর্ণ। ধৈর্য্য আর সহ্যশক্তির কি বিশাল একটা পরীক্ষা দিতে হয় এখানে, কতটা প্যাশন নিয়ে লেগে থাকতে হয় স্বপ্নটার পেছনে- সেটা জানেন শুধু এই পথ ধরে হেঁটে সফল কিংবা ব্যর্থ হওয়া মানুষগুলোই। যারা এই জুতোয় কখনও পা গলাননি, যারা সিনেমা হলের রূপালি পর্দা কিংবা টিভি পর্দার বাইরে অভিনয় আর অভিনেতাদের জীবন নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাননি, তাদের এই গল্পগুলো জানার কথা নয়।

আজকের গল্পটা শুরু করি এখান থেকেই। নারকোটিগঞ্জ- শহরের নামটা শুনলে বিহারের অনেক লোকজনই মনে করতে পারে না, এই নামে কোন জেলা আছে তাদের রাজ্যে। এই জেলার বেলুয়া নামের যে গ্রামে গল্পটার জন্ম হয়েছিল ঠিক আজকের এই দিনে, সেই গ্রামটা জেলার মানচিত্রে ঢুকেছে মাত্র বছর দশেক আগে। এর আগে কাগজে কলমে গ্রামের অস্তিত্ব ছিল, ম্যাপে ছিল না। বিদ্যুৎ এসেছে কয়েক বছর আগে, পানির কষ্ট আছে, নেই স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। গ্রামটার বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন মধ্যবিত্ত, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা এখানে বেশি। জীবন এখানে সংগ্রামের আরেক নাম, বেঁচে থাকার জন্যে, দু'মুঠো অন্নের ব্যবস্থা করার জন্যে মানুষগুলোকে প্রতিটা মূহুর্তে লড়তে হয় এখানে।

এমনই একটা কৃষক পরিবারে জন্ম তার। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা ছিল না, আবার পরিবার যে খুব বেশি স্বচ্ছ্বল ছিল, এমনটাও নয়। পনেরো বিঘা জমি ছিল তাদের, সেগুলোতে ফসল ফলাতেন বাবা। ভদ্রলোক নিজে গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করেছিলেন, ডাক্তার হবার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্ত অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে স্বপ্নটা পূরণ হয়নি। তাই মনস্থির করে রেখেছিলেন, নিজের যতো কষ্টই হোক, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাবেনই।

সিনেমা দেখার নেশা ছিল, নিজের মেজো ছেলেটার নাম রেখেছিলেন বিখ্যাত নায়ক মনোজ কুমারের সঙ্গে মিল রেখে। বাবা তখন জানতেন না, তার ছেলে মনোজ বাজপায়ী একদিন মনোজ কুমারকে ছাপিয়ে যাবেন অভিনয়ে, সোয়াশো কোটি মানুষের বিশাল দেশ ভারতের বুকে মেথড অ্যাক্টরদের ছোট্ট তালিকা করতে বসলে তার নামটা সবার ওপরের দিকেই উচ্চারিত হবে।

একদম শূন্য থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল মনোজ বাজপাইর

বাবার মতো সিনেমাপ্রীতির রোগটা ছেলের মধ্যেও ছড়ালো। বাড়ি থেকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল একদম ছোটবেলায়, মফস্বলমতো সেই শহরে সিনেমা হল ছিল একটা। ছোট্ট মনোজের জীবনে তখন একমাত্র বিনোদন বলতে হোস্টেল থেকে সপ্তাহে একদিন বিকেলে বের হয়ে সিনেমা দেখা। কয়েক সপ্তাহ পরপর শুক্রবারে নতুন সিনেমা আসে, রবিবারের ছুটির দিনটা মনোজের কাটে সিনেমা হলে। কখনও কখনও এক সিনেমাও দু'বার দেখে ফেলেন। বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে ডাক্তার বানাবেন, সেই ছোট্ট বয়সে সিনেমা দেখতে দেখতেই মনোজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, বড় হয়ে কিছু যদি করতে হয়, অভিনয়টাই করবেন।

স্কুলের হোস্টেলে পত্রিকা আসে প্রতিদিন, বাকীরা যখন খেলার পাতা নিয়ে টানাটানি করে, মনোজ তখন বিনোদনের পাতাটা কুড়িয়ে নিয়ে এককোণে বসে পড়েন চুপ করে। অন্য একটা দুনিয়ায় ঢুকে যান তিনি তখন। অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার ছাপা হয় ছবিসহ, তার মনে হয়, তিনি যেন সেই অভিনেতার সামনে বসে আছেন। তার প্রিয় তারকা হাত নেড়ে নেড়ে তার সামনে কথা বলছেন, আর তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনছেন সেসব।

নাসিরউদ্দিন শাহ'র ইন্টারভিউ পড়ে প্রথমবার তিনি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা'র নাম শুনলেন, পরে রাজ বব্বরের এক সাক্ষাৎকারে আবার পড়লেন এনএসডির কথা। খোঁজ নিলেন, জিনিসটা আসলে কি। জানলেন, ঘষেমেজে অভিনেতা তৈরি করা হয় এখানে, ভারতের নানা প্রান্ত তো বটেই, বিদেশ থেকেও অনেকে পড়তে আসে এখানে। মনোজের শরীরটা তখন বিহারে, কিন্ত মনটা চলে গেছে দিল্লির স্কুল অফ ড্রামায়। যে করেই হোক, দিল্লি যেতেই হবে- এটাই তখন তার সংকল্প।

ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে এক বন্ধুর সঙ্গে দিল্লির ট্রেনে উঠে বসলেন। দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেছেন ততদিনে। টিকেট রিজার্ভেশন করা ছিল না, টিটির ভয়ে এই কামরা ওই কামরায় দৌড়াদৌড়ি করে পার করলেন সারারাত। সাতসকালে ট্রেন ঢুকলো দিল্লিতে, আলো ঝলমলে শহরটা কেমন যেন আপন মনে হলো মনোজের কাছে। এই শহরে আসার স্বপ্নই তো তিনি এতদিন দেখেছেন, তার অভিনেতা হবার আকাঙ্ক্ষাটা পূরণ করবে এই শহর, সেজন্যেই তো সব পিছুটান ফেলে ছুটে এসেছেন তিনি!

কিন্ত মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলেন মনোজ, যদিও গ্র‍্যাজুয়েশনটা বাহানামাত্র। এনএসডিতে ভর্তি হতে হলে ন্যুন্যতম গ্র‍্যাজুয়েট হতে হবে, সেকারণেই ডিগ্রিটা নেয়া। তিনটা বছর যেন আর পারই হতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন মনোজ, কারণ তার স্বপ্নজুড়ে তখন এনএসডি। সেখানে ভর্তির আগে যতোটা তিনি শিখতে পারেন, কাজ যতোটা এগিয়ে রাখা যায়। দিল্লির পথনাট্যদলের পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন বছরখানেকের মধ্যেই, পরিচয় হলো কিংবদন্তী অনেক অভিনেতা আর নির্দেশকের সঙ্গে।

গ্যাংস অফ ওয়াসিপুরে মনোজ

গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হলো, এমএসডির ফর্ম তুললেন মনোজ। পরীক্ষা দিলেন, মৌখিক পরীক্ষাও হয়ে গেল। রেজাল্ট বেরুনোর পরে নিজের নামটা কোথাও দেখতে পেলেন না তিনি, ভেঙে পড়লেন প্রচণ্ডভাবে। যে স্বপ্নের পেছনে তাড়া করে বিহার থেকে নিজের সবকিছু ছেড়ে অচেনা এই রাজধানী শহরে এসেছিলেন, সবকিছুই ভুল বলে মনে হতে লাগলো। রুমে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছেন টানা কয়েকদিন। বন্ধুবান্ধবেরা তখন পাশে ছিল তার, সর্বক্ষণ তার সাথে কেউ না কেউ থাকতেন, যাতে মনোজ আত্মহত্যা না করে বসেন। তারা বোঝালেন, আরেকবার চেষ্টা করতে। এরইমধ্যে একটা নাট্যদলের সঙ্গে কর্মশালায় যোগ দিলেন মনোজ।

পরের বছর আবার পরীক্ষা দিলেন, ফলাফল একই। এনএসডিতে যারা তখন শিক্ষক, মনোজ তাদের সঙ্গেই বাইরে থিয়েটারে কাজ করছেন। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন এমন হচ্ছে তার সঙ্গে? তার সমস্যাটা কোথায়? তারা কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না। এরইমধ্যে বিখ্যাত নির্দেশক ব্যারী জনের সঙ্গে পরিচয় হলো মনোজের, ব্যারির সঙ্গে কাজ শুরু করলেন। ব্যারি মনোজকে শেখাতেন, অভিনয়ের ওপর বই পড়তে দিতেন, বিনিময়ে ব্যারিকে ছোট ছোট বাচ্চাদের ওয়ার্কশপে সাহায্য করতে হতো মনোজকে।

তৃতীয়বার পরীক্ষা দিয়েও সুযোগ হলো না এনএসডিতে। দিল্লির নাট্যজগতে মনোজ তখন অন্যতম সেরা অভিনেতা। সরাসরি মুম্বাই চলে গেলেও পারতেন তিনি। কিন্ত জেদ চেপে গিয়েছিল নিজের ভেতরে। এনএসডিতে সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রমাণের একটা তাগিদ ছিল নিজের ভেতরে, তাই পরের বছর আবারও পরীক্ষা দিলেন। ভাইভা বোর্ডে শিক্ষকদের একজন তাকে বললেন, 'মনোজ, তোমাকে ছাত্র হিসেবে আমরা নিতে পারছি না। কিন্ত তুমি যদি চাও, শিক্ষক হিসেবে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় যোগ দিতে পারো।' এই প্রস্তাব শুনে মনোজ হাসবেন না কাঁদবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

দিল্লিতে কয়েক বছর ছিলেন, সেখানে বিয়েও করলেন। তারপর চলে এলেন মুম্বাইতে। সংগ্রাম ব্যাপারটাকে বিধাতা হয়তো তার জীবনের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন, তাই কষ্টের দিনগুলো শেষ হলো না তার। দ্রোহকাল নামের একটা সিনেমায় এক মিনিটের রোল পেলেন, ১৯৯৪ সালের ঘটনা সেটা। তিগমাংশু ধুলিয়ার সঙ্গে পরিচয় ছিল, তার পরামর্শে ব্যান্ডিট কুইন সিনেমায় মনোজকে একটা চরিত্র অফার করেছিলেন শেখর কাপুর। ডাকু মান সিঙের সেই রোলটাই ছিল রূপালী পর্দায় তার প্রথম কাজ। টেলিভিশনে কাজ করছিলেন টুকটাক, অল্পস্বল্প টাকা আসছিল সেখান থেকে। এমন সময়ে জীবনে আরেকটা ধাক্কা খেলেন তিনি, স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। কারণ তার নাকি কোন ভবিষ্যত নেই!

অ্যামাজন প্রাইমের ওয়েব সিরিজ ফ্যামিলি ম্যান

অল্প কয়েকটা সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয়ের পরে রামগোপাল ভার্মা ডাকলেন মনোজকে। কমেডি ফিল্ম দাউদ- এ ছোট একটা চরিত্রে তিনি নিলেন মনোজকে। মনোজের অভিনয়প্রতিভা দেখে শুটিং সেটেই আফসোস শুরু করলেন রামু, কেন এই লোককে আরেকটু বড় কোন চরিত্র দেননি তিনি! পরের বছর 'সত্য' বানালেন তিনি, মনোজকে নিলেন গ্যাংস্টার ভিখু মাত্রের চরিত্রে। সেই সিনেমা দেখে মনোজকে নিয়ে অনুপমা চোপড়ার মন্তব্য ছিল- 'মনোজের অভিনয় এতটাই সপ্রভিত, পর্দায় ওকে দেখে যেন মুম্বাইয়ের বস্তি আর অপরাধজগতের গন্ধটা টের পাওয়া যাচ্ছিলো!' নায়ক না হয়েও 'সত্য' সিনেমার সবটুকু আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছিলেন মনোজ, ক্যারেক্টার আর্টিস্টের সফলতা তো এখানেই!

পরের গল্পটা সামনে এগিয়ে চলার, নিজেকে বারবার প্রমাণের, বাকীদের জন্যে অভিনয়ের একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দেয়ার, বছর বছর সেটাকে ধাপে ধাপে ওপরে নিয়ে যাওয়ার। এরমধ্যেও অনেক সিনেমা থেকে কথাবার্তা পাকা হবার পরেও বাদ পড়েছেন, নিদারুণ অর্থকষ্টে দিন কাটিয়েছেন, কারণ ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি 'অভিনেতাদের' কদর করা শুরু করেছে অনেক দেরীতে। নামের পাশে তারকাখ্যাতি কখনও যোগ হয়নি, কোথাও গেলে অটোগ্রাফের জন্যে লোকে ছেঁকে ধরেনি তাকে। কিন্ত যারা অভিনয় বোঝেন, যারা সিনেমা নিয়ে গবেষণা করেন, তারা জানেন মনোজ বাজপায়ী কি জিনিস, তারা বোঝেন বিহারের অজ পাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা গ্রাম্য এই লোকটার ভেতরে কি সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে আছে!

শাহরুখের বীর-যারা'য় অভিনয়ের পরে পত্রিকার প্রচ্ছদে তার ছবি এসেছিল, প্রকাশ ঝাঁ'র রাজনীতির পরে মোটাদাগে কমার্শিয়াল সিনেমার দর্শকেরাও চিনেছে মনোজ বাজপায়ীকে। সত্য থেকে শুরু করে রোড, পিঞ্জর, চিটাগাং, রাজনীতি, গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর কিংবা আলীগড় থেকে সাম্প্রতিক সোনচিড়িয়া বা ফ্যামিলি ম্যান- এই সিনেমা আর সিরিজগুলো তার দুর্দান্ত অভিনয়প্রতিভার স্বাক্ষর হয়ে আছে। দুটো ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড আর চারটা ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড আছে ঝুলিতে। সেগুলোও আসলে পুরোপুরি বোঝাতে পারছে না মনোজ বাজপায়ীর অভিনয়ের সামর্থ্যটাকে।

খ্যাতি যুক্ত হয়েছে নামের পাশে, বোম্বেতে নিজের ফ্ল্যাট-গাড়ি, সবই হয়েছে। তবুও তিনি ভীষণ সাদামাটা একটা জীবনে চলতে পছন্দ করেন। স্ত্রীর ফোন পেয়ে মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নেমে যান টমেটো কিনবেন বলে। মেয়ে আবদার করে, স্কুলের ছুটিতে সুইজারল্যান্ড ঘুরতে যাবে, মনোজ মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করতে চান ঠিকই, কিন্ত শুধু মেয়েকে সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার জন্যে কাজ করতে হবে- এই ধারণায় তিনি বিশ্বাসী নন। অভিনয়টা তার কাছে যতোটা না পেশা, তারচেয়ে অনেক বেশি নেশার নাম; যে নেশা থেকে মৃত্যুর আগে সম্ভবত মুক্তি নেই!


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা