কোন তারকার কবে বাচ্চা হবে, কোন তারকার বাচ্চার নাম কী, কার সাথে কার প্রণয়, কার সাথে কার বিচ্ছেদ, কোন তারকা বিয়ের আগে কোথায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন, কাকে কাকে দাওয়াত দিলেন- দেশের জাতীয় গণমাধ্যমগুলো এ জাতীয় সংবাদের মচ্ছবে ভাসতে ভাসতে নিয়মিতই ভুলে যায় তাদের পেশাগত দায়বদ্ধতা। সস্তা জনপ্রিয়তায় মোক্ষলাভের জন্যে এদেশীয় মিডিয়া আপোষ করে বিবেকের সাথেও...

বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করার মত উপাদান হাতেগোনা যে কয়টি আছে, তার মধ্যে শীর্ষের দিকে অবশ্যই রাখতে হবে বাংলাদেশের মিডিয়াকে! খানিকটা চমকে গেলেন? এখনই চমকাবেন না৷ খোলাসা করে পুরো বিষয়টি আগে বলে নিই। এদেশীয় মিডিয়া নিয়ে গর্বের প্রধানতম কারণ- তাদের দায়িত্ববোধ। গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে অ-গুরুত্বপূর্ণ কিংবা না-গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো নিয়ে তারা নিয়মিত যেসব ধাষ্টামো করে, তা হজম করা যেমন কষ্টকর, তেমনি বিব্রতকরও। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইউভ্যাল নো হারারির একটা বইয়ে তিনি দাবী করেছিলেন, মিডিয়াই পারে একটা দেশের সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করতে।  যদিও সে সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের দেশের গনমাধ্যমগুলো কিভাবে সামলাচ্ছে, তা নিয়ে লিখতে গেলে আরেক মহাকাব্য হয়ে যাবে। সে আলোচনায় তাই যাচ্ছি না। তবে উটপাখির মতন বালুতে মুখ গুঁজে কিভাবে যাচ্ছেতাই লিখে টিআরপি'র উপাসনায় মগ্ন হওয়া যায়, সে প্রসঙ্গে 'সকল দেশের রানী সে যে আমার মিডিয়াখানি'যে সবার শীর্ষে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই মোটেও। 

সম্প্রতি এই সত্যতার প্রমাণ আরেকবার পেলাম। বলিউড স্টার ভিকি কৌশল ও ক্যাটরিনা কাইফের বিয়ের সংবাদে এদেশের মিডিয়ায় যে পরিমাণ মাতামাতি হচ্ছে, খোদ ভারতের মিডিয়াতেও এতটা আদিখ্যেতা হচ্ছে কী না, জানা নেই। 'যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই' বাগধারাকে বগলদাবা করে এদেশের মিডিয়া নেমেছে অদ্ভুত সমরে। কবে বিয়ে, কোথায় বিয়ে, কেন বিয়ে, কিভাবে বিয়ে, কে আসবে, কে আসবে না, কি থাকবে খাবারের মেন্যুতে...এসব বিষয় নিয়ে যদি ভুঁইফোড় সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদ করতো, তাও নাহয় মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়া ও অন্যান্য মাস-মিডিয়া যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে, এই বিয়েকে কেন্দ্র করে, তা তীব্র বিরক্তিকর। বিব্রতকরও। এক বিয়েকে কেন্দ্র করে মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট মানুষদের মানসিক বিকারগ্রস্থতাই যেন নগ্ন হয়ে উঠে এসেছে জনসম্মুখে। 

ভিকি-ক্যাটরিনার বিয়েকে কেন্দ্র করে যে আদিখ্যেতায় মেতেছে দেশীয় মিডিয়া, তা বিরক্তিকর! 

কোন তারকার কবে বাচ্চা হবে, কোন তারকার বাচ্চার নাম কী, কার সাথে কার প্রণয়, কার সাথে কার বিচ্ছেদ, কোন তারকা ঈদের দিন কী পরলেন, কী খেলেন... দেশের জাতীয় গনমাধ্যমগুলো যদি এ জাতীয় সংবাদের মোচ্ছবে সামিল হন নিয়মিত, তাহলে দুঃখপ্রকাশ করা ছাড়া কিছু বলার থাকেও না। এরা যতটা আগ্রহ নিয়ে কোনো লাস্যময়ী নায়িকার প্রাক্তন প্রেমিকের ঠিকুজিকোষ্ঠী বের করে, এর একশোভাগের এক ভাগ নিয়েও যদি ভালো পাঁচটি সিনেমার রিভিউ করে ছাপাতো, তাহলেও আখেরে লাভ হতো। এ দেশের মিডিয়া আজকাল এতটাই পঙ্গু, এরা ভিন দেশের দুই তারকার বিয়ে নিয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট দিতে পারলেও এই দেশেরই এক ফোক শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়ার সহায়সম্বলহীন হয়ে ভিক্ষা করার মানবেতর ঘটনা নিয়ে সামান্য সংবাদ করার ন্যূনতম ভদ্রতাটুকু দেখাতে পারেনি।

 মিডিয়ার পাদপ্রদীপের তলে কাঙ্গালিনী সুফিয়ারা কখনোই আসেন না! 

আজকাল নিয়মিত ব্যবধানে এ দেশের বড় বড় সিনেমাহলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ভালো কোনো সিনেমা আজকাল এদেশে তৈরী হয় না, প্রতিভাবান নির্মাতারা বাজেটের অভাবে নির্মাণ শুরু করার আগেই গুটিয়ে নেন নিজেদের, মেধাবী অভিনেতারা ভালো কাজের সুযোগ পান না...এসব নিয়ে অজস্র কথা বলার, প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তোলার কথা ছিলো মিডিয়ার। কিন্তু মিডিয়া সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে কোনো কথা বলবেনা বলেই হয়তো করেছে পণ। মূক ও বধির হয়ে সে এসব প্রসঙ্গে ধারণ করেছে নিরন্তর মৌনব্রতও। 

অবশ্য এই মৌনব্রতের পেছনে মিডিয়ার কিছু যুক্তিও আছে। 'ক্লিকবেইট' এর এই যুগে অডিয়েন্স যেহেতু চিজি খবর, হালকা মুচমুচে সংবাদ বেশি পছন্দ করে, তাই মিডিয়াও চায় এসব খবরের বদৌলতে দর্শকের আকর্ষণ তাদের দিকে ধরে রাখতে। টিআরপি এবং অ্যালগরিদমে পিছিয়ে না পড়তে। আগ্রহের শীর্ষে থাকার এই ইঁদুরদৌড়ে সামিল হতেই তারা ক্রমশ বেছে নেয় সস্তা জনপ্রিয়তার রাস্তা। ভুলে যায় তাদের পেশাগত দায়বদ্ধতা, মূল্যবোধ এবং বিবেক। কোনো এক চকচকে নায়িকার আইটেম ড্যান্স নিয়ে একাধিক সংবাদ করা হলেও তাই ব্রাত্য থাকেন বহু শিল্পী, যাদেরকে নিয়ে আরেকটু আলোচনা আসলেই দরকার ছিলো। 

অন্য দেশের সংবাদপত্র অথবা টিভি চ্যানেলগুলো যখন দেখি, চমকে উঠি তাদের জ্ঞানের গভীরতায়। নিজ দেশের বাইরে অন্য দেশের মেধাবী বিষয় এবং মানুষদের তারা গুরুত্ব দেয়। সম্মান করে। গুণী অথচ নিভৃতচারী মানুষদের নিয়মিত নিয়ে আসে ফ্রন্টলাইনে। সেসব মানুষের তুখোড় চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত করে পাঠকদের, দর্শকদের। সেসব দেশের মিডিয়ার এসব আয়োজনের সাথে যখন নিজেদের দেশকে মেলাতে যাই, কেমন গ্লানিবোধে আক্রান্ত হই। জাতিগত দৈন্যদশাকেই যেন নগ্ন করে দেখিয়ে দেয় এ দেশীয় মিডিয়া। আমরা বুঝতে পারি, গায়েগতরে এ দেশের বয়স অনেক হলেও, মগজের বয়স যেন থেমে গিয়েছে বহু আগেই। তারই প্রতিক্রিয়ায় হওয়া এসব হীনতা দেখি নিয়মিত। আক্ষেপে তড়পাই। কিন্তু সুরাহা হয় না। যৌনতাকে, সস্তা ভাঁড়ামোকে কিংবা পরশ্রীকাতরতা কে রসদ বানিয়ে এগিয়ে চলে মিডিয়ার দোর্দণ্ডশাসন। কোনো হেলদোল কিংবা বিবেকের দংশনে তারা অভিশপ্ত হয় না। কোনোদিন হয়তো হবেও না!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা