মেহজাবিন চৌধুরী: মেধা আর পরিশ্রমে যিনি হয়ে উঠেছেন সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

একযুগ আগে বাংলা ভাষাটা পুরোপুরি আয়ত্ত্বে ছিল না যার, সেই তরুণী এখন দেশের নাটকের শীর্ষ অভিনেত্রী! অতুলনীয় সৌন্দর্য্য, পরিশ্রম আর অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমেই নিজেকে একজন সুঅভিনেত্রী হিসেবে প্রমান করেছেন মেহজাবীন...
এই সময়ে বাংলাদেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম জনপ্রিয় ও আলোচিত অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মেহজাবিন চৌধুরী। নিজের সৌন্দর্য্য, অভিনয় দক্ষতার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে একজন সুঅভিনেত্রী হিসেবে প্রমান করেছেন।
তার শুরুটা ২০০৯ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার মঞ্চে বিজয়িনী হিসেবে। এরপরে মেহজাবিন মিডিয়া ভূবনে তার ক্যারিয়্যার শুরু করেন একজন মডেল ও অভিনেত্রী হিসেবে। লাক্স সুন্দরী হিসেবে তাকে নিয়ে দর্শকদের মাঝে আলাদা একটা আগ্রহ থাকলেও অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কিছুটা সময় নেন তিনি। পরিশ্রম, কাজের প্রতি ভালোবাসা, দক্ষতা তাকে একটা সময় নিয়ে আসে লাইমলাইটে। এবং দেশের এই সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় এবং আলোচিত অভিনেত্রী হিসেবে তার নাম শীর্ষে বললেও ভুল হবেনা।
মেহজাবিনের পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামে। সেখানেই তার জন্ম তবে শৈশবে বেড়ে উঠেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ও লেভেলে পড়াশুনা করার সময় তিনি লাক্স সুন্দরী নির্বাচিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ইফতেখার আহমেদ ফাহমি পরিচালিত ‘তুমি থাকো সিন্ধুপারে’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মত টেলিভিশন অভিনেত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হন তিনি। এই নাটকে তিনি অভিনয় করেছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা মাহফুজ আহমেদের বিপরীতে। এরপর তিনি একে একে কাজ করেন ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘কল সেন্টার’, ‘মেয়ে শুধু তোমার জন্য’, ‘আজও ভালোবাসি মনে মনে’, ‘হাসো আন লিমিটেডসহ’ বেশকিছু নাটকে।
২০১৩ তে শিখর শাহনিয়াত পরিচালিত নাটক 'অপেক্ষার ফটোগ্রাফি' ছিল অভিনেত্রী হিসেবে মেহজাবীন এর জন্য বড় একটি টার্নিং পয়েন্ট। তবে কঠোর পরিশ্রম, অভিনয়ের প্রতি তীব্র ভালোবাসা, চরিত্রে মিশে যাবার দক্ষতা এবং মেধার সমন্বয়ে এক নতুন মেহজাবীনের দেখা পাওয়া যায় ২০১৭ সালের ঈদুল আযহায় মিজানুর রহমান আরিয়ানের পরিচালনায় 'বড় ছেলে' নাটকের মধ্য দিয়ে। দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয় মেহজাবিন ও জিয়াউল ফারুক অপূর্ব অভিনীত আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, প্রেম এবং বাস্তবতা নিয়ে নির্মিত 'বড় ছেলে'।
এরপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার। এই সময়ে এসে একজন অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে আরো পরিপক্ক এবং দক্ষ করে তোলার প্রয়াসে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মেহজাবিন। রোমান্টিক নাটকে একচেটিয়া অভিনয় করলেও ক্যারিয়ারে একটা সময়ে এসে নানা বহুমাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে একজন ভার্সেটাইল অভিনেত্রীতে পরিনত করেছেন তিনি।
একথা বললে ভুল হবেনা যে, টিভির পর্দা হোক বা ইউটিউব সর্বত্রই এখন মেহজাবিনময়। দর্শপ্রিয়তার বিচারে এই সময়ের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী তিনি। অন্যভাবে বলা যায় তিশা'র পরে দিনকে দিন তিনি টেলিভিশন নাটকে একটি অপরিহার্য নাম হয়ে উঠছেন মেহজাবিন। রোমান্টিক ঘরানার নাটকে অভিনয় বেশি করলেও বেশকিছু নাটকে সফলভাবে এই ছক ভেঙেছেন তিনি। নিত্যনতুন নানা চরিত্রে অভিনয় করে প্রমান করেছেন যে, সুযোগ পেলে তিনি সব ধরনের চরিত্রেই পারফেক্ট তিনি।
তবে একজন দক্ষ অভিনেত্রী হিসেবে মেহজাবিনকে আমাদের সামনে যেকয়টি নাটকে উপস্থাপন করা হয়েছে তার জন্য প্রথমেই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেয়া যেতে পারে দেশের অন্যতম সেরা গুনী নির্মাতা আশফাক নিপুনকে। এই নির্মাতা- অভিনেত্রী জুটি একসাথে 'সোনালী ডানার চিল', 'ফেরার পথ নেই' এবং 'এই শহরে'র মতো অসাধারন নাটক উপহার দিয়েছেন। এই সময়ে এসে নাটকের মান নিয়ে যেখানে খোদ ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যেই হতাশা, ক্ষোভ কাজ করে সেখানে বাস্তব নানা ঘটনার আলোকে এসব নাটক আমাদের মনকে ছুয়ে যায়। চমৎকার গল্প এবং গল্পের চাহিদা অনুযায়ী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দক্ষ অভিনয়ের দেখা মেলে এসব নাটকে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে 'সোনালী ডানার চিল' হোক বা হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি করা নার্স চরিত্রে সাবলীল অভিনয় মেহজাবিন আমাদের অবাক করেছেন বারবার।
তার ক্যারিয়ারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে 'পতঙ্গ'। নাটকটি নির্মাণ করেছেন রাফাত মজুমদার রিকু। কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে নাটকটি। গত ঈদুল আজহায় একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর দর্শক রীতিমতো থমকে গিয়েছিলো। সাধারণত রোমান্টিক নাটকে মেহজাবিনকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত আমরা কল্পনাও করিনি যে, একজন পাগলীর চরিত্রে দেখা মিলেছে মেহজাবিনের। এই চরিত্রে তার অভিনয় নিয়ে শংকা থাকলেও মেহজাবিন পেরেছেন, চিরচেনা গৎবাধা বৃত্তের বলয় ভেঙে অভিনয় করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এ নাটকে মানবজীবনের চিরাচরিত কিছু বৈশিষ্ট্য দেখানো হয়েছে। এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করতে পেরে উচ্ছ্বসিত ছিলেন অভিনেত্রী নিজেও এমনটাই জানিয়েছিলেন একটি সাক্ষাৎকারে। এমনকি 'কাজের বুয়া' চরিত্রেও মানানসই ছিলেন তিনি।
মাহমুদুর রহমান হিমির পরিচালনায় 'স্বপ্ন দেখি আবারো' শিরোনামে একটি নাটকে কাজের বুয়া চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, নাটকটি মেহজাবিনের নিজের লেখা। নাটকে কাজের বুয়া ও ড্রাইভারদের যে ঈদ উদযাপনের পরিকল্পনা থাকতে পারে সেটাই দেখানো হয়েছে। এ নাটকটিও গত ঈদে প্রচারিত হয়েছিল। এমন জীবন সাদৃশ্য গল্পের নাটক আজকাল কম নির্মাণ হয়। গুটি কয়েক যাও তৈরি হয়, নানাবিধ কারণে আলোচনায় আসে না। তবে ব্যতিক্রম 'স্বপ্ন দেখি আবারো'। সঞ্জয় সমাদ্দারের ‘শিফট’, ‘কনকচাপা’ ভিকি জাহেদের ‘জন্মদাগ’, ‘ইরিনা’, ‘ভুল জন্ম’ অভিনেত্রী হিসেবে তাকে আরো কয়েকধাপ উপরে নিয়ে এসেছে। প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙছেন এই মিষ্টি হাসির সুন্দরী অভিনেত্রী।
ভিন্নধর্মী কনটেন্ট নিয়ে নাটকে অভিনত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি ‘শিল্পী’, ‘বান্টি বানু’, ‘ভাইরাল গার্ল’, ‘ক্যান্ডি ক্রাশ’ ‘মহব্বত’, চাপাবাজ’ র মতো ভিউয়ার ভিত্তিতে ইউটিউবে ঝড় তোলা নাটকেও অভিনয় করছেন তিনি সমান্তরালভাবে। দর্শকদের ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরুপ টানা দুইবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার জয় করেছেন তিনি।
মেহজাবিন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমি সব সময়ই নিজেকে ভাঙতে চাই। প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হতে চাই। তাই রিস্ক নিয়ে কাজ করি। এই সময়ে এসে দর্শকদের চাহিদা বুঝে বা নতুনত্ব না এনে কাজ করে যাওয়াটা বোকামি। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করাটাই একজন শিল্পীর আসল কাজ। আমি প্রতিনিয়ত অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে নতুন করেই প্রেজেন্ট করতে চাই।
সহ-অভিনেতা হিসেবে অপূর্ব কিংবা আফরান নিশোর সাথে তার জুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই বিষয়ে তিনি জানান, প্রথম কথা হচ্ছে- এটি আমার ব্যক্তিগত পছন্দ নয়। নির্মাতারাই আমাদের কাস্ট করেন। হয়তো এই দুজনের সঙ্গে আমার রসায়ন ভালো ও দর্শকও স্ক্রিনে আমাদের একসাথে পছন্দ করেন। তাই নির্মাতারা আমাদের নিয়েই কাজ করেন। তবে আমি ভাগ্যবতী যে, দেশের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় দুজন অভিনেতার সাথেই আমার জুটি দর্শকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।'
অভিনয়ের পাশাপাশি মেহজাবিনের ইউটিউব চ্যানেল ‘মেহজাবিন চৌধুরী’ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চ্যানেল নিয়ে জানতে চাইলে মেহজাবিন একটি আলাপচারিতায় বলেন, আমি সবসময়ই দর্শকদের ভালোলাগাকে গুরুত্ব দেই। ২০১৮ সালের শেষের দিকে আমার মনে হয় একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলতে কেমন হয়। সেই ভাবনা থেকেই পরে খুলে ফেলি ইউটিউব চ্যানেল। তারপর শুটিং এর বিরতিতে র্যাপিড ফায়ার, টিকটক সহ অন্যান্য ভিডিও বানিয়েছিলাম। আর এখন যেহেতু সারাদিন বাসায় থাকি তাই কয়েকটি রান্নার রেসিপি, কফি এবং করনা ভাইরাস নিয়ে দুটি ভিডিও বানিয়েছি। সবাই আমার ইউটিউব চ্যানেলটিকে এতো পছন্দ করবে এটা কিন্তু আমি শুরুতে ভাবিনি। দর্শকদের ভালোবাসার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
নাটক, টেলিফিল্মের পাশাপাশি এই সময়ে আমাদের দেশের বিজ্ঞাপনের অন্যতম সেরা চাহিদাসম্পন্ন অভিনেত্রী তিনি। দেশের বেশকিছু নামীদামী ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন এবং শ্যুটেও মেহজাবিন এখন শীর্ষে। তার সুন্দর হাসি, ফিটনেস, সৌন্দর্য্য এবং নিজেকে নান্দনিক ভাবে উপস্থাপন তাকে এনে দিয়েছে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা এবং প্রশংসা।
নিজের অসাধারন সৌন্দর্য্য, সহজাত অভিনয় প্রতিভা এবং পরিশ্রম দিয়ে অভিনেত্রী হিসেবে মেহজাবিন নিজেকে নিয়ে যাবেন সফলতার শীর্ষে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। জন্মদিনে দেশের এই জনপ্রিয় এবং আলোচিত অভিনেত্রীর জন্য রইলো অনেক অনেক শুভকামনা।