হলিউডের 'গুড উইল হান্টিং' কিংবা বলিউডের 'ডিয়ার জিন্দেগি', এসব সিনেমায় গল্পের আড়ালে ক্রমশই প্রকট হয়ে ওঠে মস্তিষ্কের অন্তরালের অধিবাসীদের অবস্থান। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে আজ তাই এমন পাঁচ সিনেমার অবতারণা, যে সিনেমাগুলো 'মেন্টাল হেলথ' নিয়ে অনেকের আদ্যিকালের ধ্যানধারণা পাল্টে দেবে চিরতরে...

আমরা আমাদের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যতটা সচেতন, তার সিকিভাগও যদি মানসিক সুস্থতা নিয়ে হতাম, তাহলে হয়তো বর্তে যাওয়া যেতো। বিষয়টা আজ অনেকটুকুই এরকম, আঙ্গুলের নখ ভাঙ্গলেও শুশ্রূষা মিলবে, কিন্তু, মানসিক স্থিরতা টলে গেলে কোনো নিরাময় নেই। এমনকি মানসিক সমস্যার কথা বলাও যাবে না। বললেই সবাই পাগল ঠাওরাবে। 'উন্মাদ' হিসেবে একবাক্যে রায় দিয়ে দেবে। অথচ এই মানসিক বিপর্যয়ের কারণে অথবা মানসিক অস্থিরতার সময়ে ন্যূনতম সাহায্য না পাওয়ার কারণে প্রতিবছর যে সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছেন, সে পরিসংখ্যান যদি কেউ শোনেন, স্রেফ চমকে উঠবেন।

সে পরিসংখ্যানে যাচ্ছি না। তবে আশার কথা এটাই, সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের চেতনায় সামান্য হলেও পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই আজকাল মেন্টাল হেলথ এর গুরুত্ব বুঝতে পারছেন। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে যে যেখানে পারছেন, মানুষকে সজাগ করার কাজটি করে যাচ্ছেন৷ এক্ষেত্রে অবশ্যই অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে সিনেমা। সময়ের ফেরে অজস্র সিনেমা আমরা দেখেছি, যেসব সিনেমা 'মানসিক স্বাস্থ্য'কে দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। হলিউডের 'গুড উইল হান্টিং' বলি কিংবা বলিউডের 'ডিয়ার জিন্দেগি', গল্পের আড়ালে প্রকট হয়ে উঠেছে অন্তরালের অধিবাসীদের কথাও। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে আজ তাই এমন পাঁচ সিনেমার অবতারণা, যে সিনেমাগুলো দেখার পরে নিশ্চিতভাবেই 'মেন্টাল হেলথ' নিয়ে অনেকের আদ্যিকালের ধ্যানধারণার পরিবর্তন হবে। অনেকে সামান্য হলেও সহমর্মী হবেন এ অসুস্থতার সাথে সংযুক্ত মানুষদের প্রতি। 

১. আ বিউটিফুল মাইন্ড

ম্যাথমেটিকস এর ম্যাজিশিয়ান জন ফোর্বস ন্যাশের পুরো জীবনগল্পই অদ্ভুত অনুপ্রেরণার। চরম দারিদ্র্য, অবিশ্বাস, ঈর্ষা, সিজোফ্রেনিয়া...নানা উপাদান। ন্যাশের চড়াই-উতরাই এর এই জীবনকে যেভাবে পর্দায় জীবন্ত করেছিলেন প্রিয় অভিনেতা রাসেল ক্রো, তা চিরদিন মনে রাখার মতনই এক অভিজ্ঞতা। প্রসঙ্গত,  এ সিনেমায় ন্যাশের জীবনকাহিনীর পাশাপাশি মেন্টাল হেলথের গুরুত্বও যেভাবে পর্দায় তুলে এনেছিলেন ডিরেক্টর রন হাওয়ার্ড, সেটিও ভূয়সী প্রশংসার। জন ন্যাশ ছোটবেলা থেকে একেবারে শেষবয়স পর্যন্ত যেভাবে লড়েছেন করোটির অভ্যন্তরের দানবদের সাথে এবং হয়েছেন বিজয়ী, এ গল্প পর্দায় দেখার পরে তা যে অনেক মানুষকে খানিকটা হলেও মানসিক শক্তি যোগাবে, তা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। 

আ বিউটিফুল মাইন্ড

২. ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্য কাকু'স নেস্ট

অনেকের মতে, এটিই মেন্টাল হেলথ নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা। যদিও এ মত নিয়েও মতান্তর আছে। সে থাকুক নাহয়। মোদ্দা কথা এটাই, মিলোস ফোরম্যানের এ সিনেমায় যেভাবে 'মেন্টাল হেলথ' ইস্যুকে অ্যাড্রেস করা হয়, তা গল্পের সাথে যেমন খাপ খায়, পাশাপাশি দর্শককেও খানিকটা হলেও মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রতি সমব্যথী করে। এসবের পাশাপাশি উপরিপাওনা হিসেবে গ্রেট জ্যাক নিকলসনের অনবদ্য অভিনয় তো রইলোই। পঁচাত্তর সালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এরকম একটা নির্মাণ, এবং সে নির্মাণে 'মেন্টাল হেলথ'কে এভাবে প্রায়োরিটি দেয়া... ঠিক এই  কারণেই এই সিনেমা আজও প্রাসঙ্গিক। 

ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্য কাকু'স নেস্ট! 

৩. সিলভার লাইনিংস প্লেবুক

ম্যাথু কুইকস এর বই 'সিলভার লাইনিংস প্লেবুক' অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমার দুটি চরিত্র। প্যাট এবং টিফানি। তারা দুজনই মানসিকভাবে অসুস্থ। তাদের লড়াই ব্যক্তিগত। ভেতরের লড়াই। এই অপরিচিত দুইজন মানুষের দেখা হয় একবার। সময়ের ফেরে, ঘটনার ঘনঘটায় তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়, সখ্যতা হয়৷ রসায়ন বাড়ে। তারা একে অন্যের কাছে না আসতে চাইলেও ক্রমশ এমন সব পরিস্থিতি তৈরী হয়, অন্তরঙ্গতা এড়ানো যায় না। রোমান্টিক কমেডি জনরার এ সিনেমায় মিষ্টি-মধুর খুনসুটি তো আছেই। এসবের পাশাপাশি আছে এক সুন্দর বার্তাও। মানসিকভাবে অসুস্থ যেসব মানুষ আছেন আমাদের আশেপাশে, তাদের পাশে সহমর্মীতার আশ্বাস নিয়ে দাঁড়ানোর বার্তা। এ সিনেমার এ বার্তাটাই সবচেয়ে জোরালো।

সিলভার লাইনিংস প্লেবুক

৪. দ্য ফাদার

ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত এক বাবা, যিনি নিজের মেয়েকে ছাড়া বাকি সবাইকে ভুলে যাচ্ছেন ক্রমশ, তার যে এই ক্রমশ বিস্মৃতিযাত্রার যন্ত্রণাময় পথচলা, সেটিকে যেভাবে পর্দায় তুলে আনলেন কিংবদন্তি অভিনেতা অ্যান্থনি হপকিন্স, তা যদি কেউ 'দ্য ফাদার' সিনেমাটি না দেখে থাকেন, তাহলে তাকে শুধু লিখে এই অপার্থিব অভিনয়ের তাৎপর্য বোঝানো সম্ভব না। এই সিনেমায় বাবা-মেয়ের রসায়ন আছে। সব ভুলে বসা এক বাবার ছেলেমানুষির আখ্যান আছে। সে সাথে আছে মানসিকভাবে অসুস্থ এক বাবার সঙ্গ ছেড়ে না যাওয়া এক মেয়ের অদ্ভুত সুন্দর গল্পও। অন্দরমহল যাদের তাসের ঘরের মতন ওলটপালট, তাদের প্রতি আরেকটু মানবিক হওয়ার শিক্ষাই দেবে 'দ্য ফাদার।' এ সিনেমার সার্থকতাও এখানেই।

দ্য ফাদার

৫. দ্য পার্কস অব বিয়িং এ ওয়ালফ্লাওয়ার

স্টিভেন চবস্কি'র উপন্যাস থেকে নির্মিত এ সিনেমার প্রোটাগনিস্ট চার্লি। যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। প্রথম প্রেমের আবেগজনিত সংঘাত, প্রিয় বন্ধুর আত্মহত্যাসহ আরো নানাবিধ কারণে তার অন্তর্মহল বেশ উচাটন। এরকম এক টালমাটাল সময়ে তার পরিচয় হয় দুইজন মানুষের সাথে। এরপর? তা নিয়েই সিনেমা। হাই স্কুলের একজন টিনেজারের মেন্টাল প্যারাডক্স কীরকম হয়, বা, এসব প্যারাডক্স কিভাবে ট্যাকল দিতে হয়, এই সিনেমা সেগুলো নিয়েই মোটামুটি এক বয়ান দেয়ার চেষ্টা করে৷ প্রসঙ্গত এটাই বলার, মানসিক অস্থিরতার এই বিষয়টির সাথে বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরীরাই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এবং তাদের জন্যে এই সিনেমা চোখ খুলে দেয়ার এক দাওয়াই হিসেবেই বিবেচনাযোগ্য।

দ্য পার্কস অব বিয়িং এ ওয়ালফ্লাওয়ার! 

'মেন্টাল হেলথ' নিয়ে এরকম আরো অজস্র সিনেমা আছে। শুধু যে হলিউডে আছে তা না। অন্যান্য দেশের অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতেও আছে। তবে এই ক্যাটাগরির সিনেমা দেখা শুরু করার জন্যে এই পাঁচটি সিনেমার বিকল্প নেই। এগুলো দেখার পরে ক্রমশ আরো গভীর ভাবনার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সিনেমা দেখাই হবে প্রাসঙ্গিক। এবং এরকম 'সোশ্যাল ট্যাবু' বিষয়ক সিনেমা বানিয়ে প্রতিবাদ করার যে সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতিও রাখতে হবে জারি। তাহলেই সর্বাঙ্গসুন্দর। 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা