নানা ইন্ডাস্ট্রিতে দুর্দান্ত সব সিনেমা আছে, যারা 'মানসিক রোগ'কে করেছে তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বলা যেতে পারে মালায়ালাম 'টেরান্স', বাংলা 'হেমলক সোসাইটি' কিংবা ইংরেজি 'আ বিউটিফুল মাইন্ড' এর কথা। তবে এসব সিনেমা থাকা কিংবা মানসিক রোগকে ফ্রন্টলাইনে নিয়ে আসা মূখ্য কথা না মোটেও। বরং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই, এসব নির্মাণ দেখে মানুষজনের সংবেদনশীলতা কতটুকু বাড়লো, তা...

নেটফ্লিক্স এর সাম্প্রতিক মিনি সিরিজ 'হাউজ অব সিক্রেটসঃ দ্য বুরারি ডেথস' দেখে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব ভয়ঙ্করভাবে উপলব্ধি করলাম আরেকবার। সে সাথে খানিকটা আক্ষেপও এসে ভর করলো। এই উপমহাদেশের আমরা এখনো 'মানসিক স্বাস্থ্য'কে গুরুত্ব দেবার মতন উদার হতে পারিনি। কেউ মানসিকভাবে একটু অসুস্থ হলেই তাকে আমরা নিমেষেই বানিয়ে দিচ্ছি পাগল। তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা, তামাশা তো আছেই। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার এই সংস্কৃতি এতটাই বিশ্রি হয়েছে আজকাল, মানুষজন এখন এসব সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করেন। অস্বস্তিতে পড়েন। ঠিক এভাবেই খুব স্বাভাবিক এক ব্যাধি ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছে বড়সড় এক 'ট্যাবু'তে৷

তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল নাটক-সিনেমা-সিরিজ এ 'মানসিক স্বাস্থ্য' গুরুত্ব পাচ্ছে। যেহেতু এই মাধ্যমগুলি বড় অডিয়েন্সকে কাভার করে, সে কারণে, এসব নির্মাণের কল্যানেও বহু মানুষ আজকাল সচেতন হচ্ছে বিষয়গুলি নিয়ে। এরকমই এক আশাব্যঞ্জক সময়ে তাই কথা বলা যাক এমন কিছু বলিউডি নির্মাণ নিয়ে যারা নিরন্তর বলে গিয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা। যারা বলেছে- হাত ভাঙ্গলে যেমন চিকিৎসার প্রয়োজন, তেমনি মন ভাঙ্গলেও শুশ্রূষার দরকার। অনবদ্য সেসব নির্মাণ নিয়েই আজকের কলমদৌড়! 


১. ডিয়ার জিন্দেগি

'মেন্টাল হেলথ' যে মোটেও কোনো ট্যাবু নয়, এই কথাকে প্রতিষ্ঠিত করা ছিলো 'ডিয়ার জিন্দেগি'র প্রধানতম উদ্দেশ্য। মানসিক ব্যাধি হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, তার পরামর্শ মত চলে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা... 'ডিয়ার জিন্দেগি'র পুরোটা জুড়েই এ বয়ানের আধিপত্য। দারুণ এক সামাজিক বার্তার পাশাপাশি শাহরুখ খান ও আলিয়া ভাটের মিষ্টি এক ক্যামেস্ট্রিও ছিলো এ সিনেমার অন্যতম উপভোগ্য বিষয়।

ডিয়ার জিন্দেগি! 

২. ছিছোড়ে

সুশান্ত সিং রাজপুতের এ সিনেমা অনেকদিক থেকেই অনবদ্য। কনসেপ্ট, এক্সিকিউশন, সুশান্ত সিং রাজপুতের অভিনয়... এ সিনেমার ইতিবাচক দিকের সংখ্যা বিস্তর। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয়, কনসেপ্ট। ইয়াং জেনারেশনের প্রতিনিধি এক ছেলে কিভাবে পরীক্ষা, ক্যারিয়ার, সামাজিক-পারিবারিক নানা প্রত্যাশার চাপে পিষ্ট হয়ে ক্রমশ মানসিকভাবে টালমাটাল হয়ে যায়, সেটাই খুব দারুণভাবে ফুটে উঠেছিলো এ সিনেমায়। মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দিলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সেটিও ভয়ঙ্কর উদাহরণের আবরণে উঠে এসেছিলো 'ছিছোড়ে'তে৷ 

ছিছোড়ে

৩. আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ

খুবই আন্ডাররেটেড একটি সিনেমা 'আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ।' কঙ্কনা সেনশর্মার 'পরিচালক' হিসেবে অভিষেক এই নির্মাণে বহু অনুষঙ্গের পাশাপাশি এক তরুণের মানসিক জটিলতাকেও দেখানো হয়। কপর্দকহীন, বেকার এক যুবক কিভাবে 'ব্রাত্য' হতে হতে ক্রমশ এগোয় সামনে, মানসিক যন্ত্রনায় কিভাবে নাকাল হতে থাকে সে, সেসব কিছুই এ সিনেমার উপজীব্য। মানসিক অস্থিরতা কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার খানিকটা সুলুকসন্ধান এ সিনেমা দেখলে বুঝতে পারা যাবে। 

আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ 

৪. তামাশা 

ইমতিয়াজ আলীর এই নির্মাণ, সবকিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র রনবীর কাপুরের অভিনয়ের জন্যে হলেও দেখা যায় একাধিকবার। 'বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার' এ ভোগা এক তরুণের মানসিক অসুস্থতার রকমফের, অসুস্থ থেকে সুস্থ হওয়ার যাত্রাপথের অনিশ্চয়তা, রহস্য... এসব বিষয়কে যেভাবে পর্দায় তুলে আনলেন রনবীর কাপুর এবং 'মানসিক সুস্থতা'র বার্তাকে যেভাবে জনসম্মুখে পেশ করলেন ইমতিয়াজ আলী... অনবদ্য।

তামাশা! 

৫. ফিফটিন পার্ক অ্যাভেনিউ

এ সিনেমার গল্প আবর্তিত হয় 'সিজোফ্রেনিয়া'র রোগী মিঠিকে কেন্দ্র করে। অপর্ণা সেনের এই দুর্দান্ত সিনেমায় শুধুমাত্র যে মানসিক এক রোগীর সংগ্রামকেই দেখানো হয়েছে তা না। পাশাপাশি ঐ রোগীর কারণে পরিবারের উপরেও কি কি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাও দেখানো হয়েছে দুর্দান্তভাবে। ভীষণ ইমোশনাল এ সিনেমা বারবার দেখার মতন। উপলব্ধি করবার জন্যে দারুণ এক সিনেমা 'ফিফটিন পার্ক অ্যাভেনিউ।' 

ফিফটিন পার্ক অ্যাভেনিউ! 

৬. জাজমেন্টাল হ্যায় ক্যায়া

'ববি' নামের এক তরুণী ছোটবেলার এক মানসিক ট্রমার ফলশ্রুতিতে রূপান্তরিত হয় সিজোফ্রেনিয়ার রোগীতে। 'সিজোফ্রেনিয়া'র রোগী হিসেবে অদ্ভুতুড়ে সব বদ্ধমূল ধারণা এবং হ্যালুসিনেশনে ক্রমশ বিপর্যস্ত হতে থাকে সে। এই মানসিক রোগী কিভাবে ক্রমশ সুস্থ হয় কিংবা আদৌ সে সুস্থ হতে পারে কী না, তা নিয়েই পুরো গল্প। মানসিক রোগের উত্থান কিভাবে হতে পারে এবং যত্ন না নিলে কতটা সর্বগ্রাসী হতে পারে এ রোগ... তা নিয়ে বেশ ভালো এক বার্তা দেয় 'জাজমেন্টাল হ্যায় ক্যায়া।' 

জাজমেন্টাল হ্যায় ক্যায়া! 

৭. কার্তিক কলিং কার্তিক 

মানসিক রোগ হিসেবে 'সিজোফ্রেনিয়া' সম্ভবত বলিউড নির্মাতাদের মাত্রাতিরিক্ত পছন্দ। সে সূত্র মেনে 'কার্তিক কলিং কার্তিক' সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টারও সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। এ রোগের সাথে তার নিরন্তর অসম লড়াই, তীব্র মানসিক যন্ত্রণার নানাবিধ আখ্যাণ; এসবকিছুই এ সিনেমার উপজীব্য। পাশাপাশি নির্মাণটির বিন্যাস এতটাই অনবদ্য, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তা আটকে রাখে দর্শককে।

কার্তিক কলিং কার্তিক! 

৮. ব্ল্যাক

সঞ্জয় লীলা বানসালির এ ক্ল্যাসিক সিনেমাতে উঠে আসে মানসিক রোগীদের মানবিক এক গল্প। মিশেল ম্যাকনেলি নামের মূক, বধির এবং অন্ধ একজন মানুষকে কেন্দ্র করে গল্প শুরু হয়। সিনেমার প্রোটাগনিস্ট মিশেলের একজন শিক্ষকও আছেন। দেবরাজ সাহাই৷ এই শিক্ষক ও ছাত্রীর মিথস্ক্রিয়াতেই সিনেমা ক্রমশ এগোয় সামনে। এবং সিনেমার শেষে গিয়ে এমন এক চমক আসে, যে চমক গল্পকে পৌঁছে দেয় অন্য মাত্রায়। এবং গল্পটি জমে যায় ঠিক তখনই।

ব্ল্যাক! 

৯. আনজানা আনজানি

এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট দুই ক্যারেক্টার বিষন্নতায় আক্রান্ত। এবং এই বিষন্নতার ফলশ্রুতিতে তারা আত্মহত্যারও চিন্তা করে কখনোসখনো। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই দুইজন মানুষ কিভাবে নিজেদের সমস্যাগুলোর সাথে লড়াই করছে, এবং কতটা সর্বগ্রাসী হচ্ছে এসব মানসিক ব্যাধি, সেসবই মূলত এ সিনেমার লিড ক্যারেক্টার। পাশাপাশি 'আঞ্জানা আঞ্জানি' বার্তা দেয় তরুণ প্রজন্ম নিয়েও, যারা ক্রমশই বিপর্যস্ত হচ্ছে নানা মানসিক ব্যাধিতে। কিন্তু 'সোশ্যাল ট্যাবু' হিসেবে বিবেচিত এ সমস্যার সমাধান পাচ্ছে না। সমাধানবিহীন হয়ে যারা ক্রমশই হচ্ছে দিশেহারা। 

আনজানা আনজানি! 

১০. হিরোইন

আলো-ঝলমলে জগতের বাসিন্দা মাহি অরোরা, শৈশবের এক ট্রমা থেকে যিনি ক্রমশ রূপান্তরিত হয়েছেন 'বাইপোলার ডিজঅর্ডার' রোগের রোগীতে। এ রোগের সাথে যিনি লড়াই করছেন নিয়মিত। কিন্তু জুত করে উঠতে পারছেন না। 'বাইপোলার ডিজঅর্ডার' এ আক্রান্ত এ মানুষটি কিভাবে এই রোগের কাছে নিয়মিত বিপর্যস্ত হচ্ছেন এবং যাপিত সমাজ এই মানসিক রোগ নিয়ে কি ধারণা পোষণ করছে, সেসবের বৈপরীত্য ক্রমশই উঠে আসবে এ সিনেমায়। 

হিরোইন! 

বলিউডের বাইরে অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতেও দুর্দান্ত সব সিনেমা আছে, যারা 'মানসিক রোগ'কে করেছে তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বলা যেতে পারে মালায়ালাম 'টেরান্স', বাংলা 'হেমলক সোসাইটি' কিংবা ইংরেজি 'আ বিউটিফুল মাইন্ড' এর কথা। তবে এসব সিনেমা থাকা কিংবা মানসিক রোগকে ফ্রন্টলাইনে নিয়ে আসা মূখ্য কথা না মোটেও। বরং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই, এসব নির্মাণ দেখে মানুষজনের সংবেদনশীলতা কতটুকু বাড়লো, তা। আশার কথা এটাই, মানুষের চিন্তাভাবনা পাল্টাচ্ছে। মানুষ উপলব্ধি করছে মানসিক রোগের তীব্রতা। আশা থাকবে, এই সংবেদনশীল বিষয়ে মানুষের উপলব্ধির ক্ষেত্র তৈরী হবে নিয়মিত এবং সে উপলব্ধি অনুযায়ীই নিয়মিত কাজ করে যাবেন তারা। তাহলেই সর্বাঙ্গসুন্দর। সবার মঙ্গল। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা