যদিও 'মিন্নাল মুরালি' একজন সুপারহিরো, কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন সে আমাদেরই আশেপাশের একজন মানুষ। ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান কিংবা সুপারম্যানের সাথে আমরা যে দূরত্ব অনুভব করি, 'মিন্নাল মুরালি' সে দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়া এক 'সুপারহিরো' হিসেবেই আমাদের সামনে হাজির হয়। বিদেশি গল্পের অনুকরণ কিংবা নকল নয়, স্বকীয় দেশীয় উপাদানে ভরপুর এক মানুষের সুপারহিরো হওয়ার গল্পই বলে 'মিন্নাল মুরালি।

নিজস্ব এক সুপারহিরোর জন্যে উপমহাদেশের মানুষের আক্ষেপ বহুদিনের। যখন পৃথিবীর সব সুপারহিরোই আমেরিকায় জন্মায়, যখন সেসব সুপারহিরোর কারিকুরিতে এবং সিজিআই-স্টানিং গ্রাফিক্স এর খেলায় এই ভূখণ্ডের মানুষের চক্ষু ছানাবড়া হয়, তখন মস্তিষ্কের কোনো এক এঁদো গলিতে আচমকা বেজে ওঠে আক্ষেপ-

 ইশ! আমাদেরও যদি থাকতো!

সময়ের নানা প্রকোষ্ঠে এই ভূখণ্ড যে সুপারহিরো বানানোর চেষ্টা করেনি, তাও না। শক্তিমান, কৃশ, বিজলি... নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে বহুকিছুরই। কিন্তু কোনোকিছুই কেন যেন জমেনি। হাস্যকর গ্রাফিক্স, সস্তা গল্প এবং অনুকরণে জেরবার স্ক্রিপ্ট... সব মিলিয়ে পাতে দেয়ার অযোগ্য হিসেবেই স্বীকৃত হয়েছে নির্মাণগুলো। এরপর পেরিয়েছে বহুদিন। দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজত্ব শুরু করেছে মারভেল ও ডিসি কমিকস। কেউ যদি জাস্টিস লিগ নিয়ে আসে, অপর দল ছড়ি ঘোরানোর জন্যে আনছে- অ্যভেঞ্জারস। ব্যাটম্যান যখন গোথাম সিটির ঝামেলা নিকেশ করছে, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ আর স্পাইডারম্যান মিলে তখন মাল্টিভার্সে বিপর্যস্ত হতে হতে ডক্টর অক্টোপাস আর গ্রিন গবলিনের রদ্দা সামলাচ্ছে। সুপারহিরোর জয়জয়কার এরকম এক সময়ে আচমকা হুট করে আগমন উপমহাদেশের আরেক সুপারহিরো- 'মিন্নাল মুরালি'র

মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রি যখন কোনো এক বিষয়ে গল্প বলতে যায়, তখন অনেকটাই ধরে নেয়া যায়- সে গল্প জমবে। কিন্তু তবুও যখন তারা সুপারহিরো বানানোর ঘোষণা দিয়েছিলো, খানিকটা দমে যেতে হয়েছিলো। কারণ, মার্ভেল আর ডিসি কমিকস এত এত সুপারহিরো এনেছে, সেসব সুপারহিরোর এত এত লেয়ার, এত এত অ্যাকশন-সাসপেন্স-ইমোশন, সেখানে নতুন করে এক সুপারহিরোকে আনা, তাও আবার মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রিতে, সেসব বিবেচনায় খানিকটা চুপসে যাওয়া ছিলো প্রাসঙ্গিকও। তর্কের খাতিরে নাহয় মেনেই নিলাম, এই সুপারহিরোর গল্পও  দুর্দান্ত হবে, কিন্তু সুপারহিরো ফিল্ম বলতে যেখানে সিজিআই এর বাড়াবাড়ি ছড়াছড়ি, যেখানে গ্রাফিক্স এর প্রবল আধিপত্য, সেখানে কিভাবে কূলকিনারা করবে মিন্নাল মুরালি? প্রশ্ন ছিলো সেখানেও।

মুগ্ধতা ছড়িয়েছে সিনেমাটোগ্রাফিও!

সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সিনেমা দেখতে বসা। সিনেমার শুরুতেই যেমন মিথিক্যাল এক টাচ দেয়া হয় গল্পে। যাত্রাপালার মধ্যে হুট করে আগুন লেগে বিস্ফোরণ হচ্ছে, সে বিস্ফোরণে আহত এক ছোট বাচ্চা অজ্ঞান হওয়ার আগমুহুর্তে দেখতে পাচ্ছে, সামনে আগুনের মধ্যে একজন মানুষ। যে মানুষটি চেষ্টা করছে আগুনে আটকে পড়া বাদবাকি আহতদের বাঁচাতে, সেখান থেকেই শুরু হয় গল্প। ক্রমশ জানা যায়, জেইসন ও শিবু নামের দুইজন মানুষ বিশেষ এক বজ্রপাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিশেষ কিছু ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তারা দুইজন চলে গিয়েছেন সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। একজন হয়েছেন- হিরো। আরেকজন- ভিলেন। বজ্রপাতে জন্ম হয়েছে এক প্রোটাগনিস্ট ও এক অ্যান্টাগনিস্টের। ক্রমশ গল্পে আসছে একের পর এক সংঘর্ষ-সংকট!

'সুপার হিরো' ফিল্মের যে কমন ফর্মুলা, অর্থাৎ, শেষে এসে দুর্দান্ত এক ক্লাইম্যাক্সে বহু মানুষকে বাঁচানো, ভিলেনের সাথে মাঝেমধ্যেই সংঘাত, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্ব, সুপার পাওয়ারের বরাতে মাঝেমধ্যে কিছু কমিক রিলিফ...এর সবকিছুই উপস্থিত 'মিন্নাল মুরালি'তে। তবে উপাদান একই হলেও, সে উপাদানের মিশেলে বজায় রইলো বিস্তর চমক। অবশ্য চমক থাকারও কথা, একজন সুপারহিরো লুঙ্গি আর চপ্পল পড়ে বাসকে খাদ থেকে টেনে তুলছে... এ দৃশ্য পৃথিবীর আর কোনো 'সুপারহিরো' সিনেমাতেই বা দেখা যাবে? তাছাড়া, 'সুপারহিরো সিনেমা' মানেই বিস্তীর্ণ এক ক্যানভাস না হয়ে খুব ছোট্ট একটা গণ্ডিকে কেন্দ্র করেও যে ছিমছাম এক গল্প বলা যায়, সেটাও ক্রমশ স্পষ্ট হয় 'মিন্নাল মুরালি'তে! 

এ সিনেমায় সবার অভিনয়ই ভালো। 'মিন্নাল মুরালি' চরিত্রে টভিনো থমাস অনবদ্য। তবুও সবচেয়ে অবাক হয়েছি, অ্যান্টাগনিস্ট এর ক্যারেক্টারে। অ্যান্টাগনিস্ট 'শিবু' চরিত্রে গুরু সোমাসুন্দরাম, প্রোটাগনিস্ট টভিনো থমাসের সাথে পাল্লা দিয়ে তো অভিনয় করেছেনই, কিছু ক্ষেত্রে তিনি টভিনোকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। আর যেভাবে এই ক্যারেক্টারের স্টোরি ডেভেলপ করা হয়েছে, দুর্দান্ত। চরিত্রটাই এমন, আমরা জানি তিনি ভিলেন, কিন্তু তাও তাকে একপেশেভাবে ঘৃণা করা যায় না। তার গল্পেও এমন সব মানবিক ও বিষাদের আখ্যানের উপস্থিতি, খানিকটা যেন সহানুভূতিও চলে আসে এই চরিত্রের জন্যে। ব্যাটম্যানের 'জোকার' এর জন্যে যেমন এক ঘৃণামিশ্রিত ভালোবাসা, তেমনটি যেন 'শিবু'র ক্ষেত্রেও হয়। দর্শককে ঠিক ও ভুলের মাঝখানের ধূসর অঞ্চলে যেন ছেড়ে দেয় বিশেষ এ চরিত্র। চরিত্রটি ঠিক এভাবেই জয় করে হৃদয়! 

মিন্নাল মুরালি ও শিবু

সিনেমার শুরু থেকেই ভয়ে ছিলাম, 'সুপারহিরো' নিয়ে সিনেমা, না যেন ভজঘট পাকায় পুরোটা। কিন্তু নির্মাতা বাসিল জোসেফ যেভাবে গল্পকে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত টানলেন, কোনো ফ্রেমকেই খাপছাড়া রাখলেন না, ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট কিংবা স্টোরি বিল্ডআপ এ কোনো বিচ্যুতি রাখলেন না, বিস্ময়বোধে আক্রান্ত হলাম। আড়াই ঘন্টার সিনেমা, সেখানে এক মুহুর্তও বিরক্তির নেই, এরকম চমৎকারিত্বের জন্যে যেরকম টান টান স্ক্রিপ্ট দরকার, সেটাই পুরোপুরি উপস্থিত রইলো 'মিন্নাল মুরালি'তে। পাশাপাশি সিনেম্যাটোগ্রাফী, গান, বিজিএম এবং মোটামুটি সিজিআই তো রইলোই। তাছাড়া ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান কিংবা বলরাম, অমর চিত্রকথার মতন ফিকশনাল ক্যারেক্টারগুলোকে যেভাবে ট্রিবিউট দেয়া হলো গল্পে, সেটাও দারুণ লাগলো। 

যদিও 'মিন্নাল মুরালি' একজন সুপারহিরো, কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন সে আমাদেরই আশেপাশের একজন মানুষ। ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান কিংবা সুপারম্যানের সাথে আমরা যে দূরত্ব অনুভব করি, 'মিন্নাল মুরালি' সে দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়া এক 'সুপারহিরো' হিসেবেই আমাদের সামনে হাজির হয়। বিদেশি গল্পের অনুকরণ কিংবা নকল নয়, স্বকীয় দেশীয় উপাদানে ভরপুর এক মানুষের সুপারহিরো হওয়ার গল্প বলে 'মিন্নাল মুরালি।' যে গল্পে আবেগ আছে, রোমাঞ্চ আছে, অস্বাভাবিক বিষয়ও আছে। কিন্তু দিনশেষে বিপরীত এসব উপাদানগুলোর মিশেল এতটাই অনবদ্য, এই গল্পকে অবিশ্বাস তো করা যায়ই না, বরং নিরন্তর মুগ্ধ হওয়া যায়। এবং ঠিক এভাবেই 'মিন্নাল মুরালি'র এ উত্থান, উপমহাদেশের দর্শকের ' আমাদের সুপারহিরো নেই' জাতীয় আক্ষেপের চিরন্তন অবসান ঘটানোর সব আয়োজন করে দিয়ে যায়! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা