গল্পকার ও কলাকুশলীরা মূলত তিশা ও চঞ্চলের দ্বন্দ্বটাকে দর্শকদের মাঝে দিতে চেয়েছেন। দর্শক চাইলে তার মতো করে গল্পটাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন। হতে পারে সেই ব্যাখ্যায় চঞ্চল সঠিক, হতে পারে তিশা। হতে পারে সবই বাস্তব, কিছু অলৌকিক; অথবা হতে পারে পুরোটাই কল্পনা, ঊনলৌকিক...

চঞ্চল চৌধুরির পেছনের ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা তিনটা পয়েন্ট খেয়াল করুন।

* Anna O.
* Tan Broca’s Area
* Hysterical Pregnancy

অ্যানা ও. মূলত ছদ্মনাম যেটা জোসেফ ব্রুয়ার ও সিগমন্ড ফ্রয়েড তাদের স্টাডিজ অন হিস্টেরিয়া বইতে একজন পেশেন্টের নাম হিসাবে উল্লেখ করেছেন। অ্যানার মূল নাম ছিল বার্থা পাপেনহাইম। অ্যানা মূলত ব্রুয়ারের কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছিল যেখানে ব্রুয়ার আবিষ্কার করেন যে অ্যানা হিস্টেরিয়ার রোগী। সে হ্যালুসিনেট করে, নিজে নিজে কথা বলে, বাক্য গঠন করতে সমস্যা হয়, মুড সুইং, এমনেসিয়া (মেমোরি লস), ফলস প্রেগন্যান্সি (সে বলেছিল তাকে ব্রুয়ার প্রেগন্যান্ট করেছে)। ফ্রয়েড অ্যানার কেস স্টাডি করে বলেছিলেন যে সাইকো-অ্যানালাইসিসের জন্য অ্যানার কেস যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।

পরের পয়েন্ট ট্যান ব্রকাস এরিয়া মূলত ব্রেইনের একটা অংশ। ট্যান নামের এক পেশেন্টের চিকিৎসা করতে গিয়ে পল ব্রকাস ব্রেইনে এই বাড়তি অংশটার খোঁজ পায়। ট্যান কোন বাক্য বা শব্দ গঠন করতে পারতো না, শুধু ‘ট্যান’ বলতে পারতো। ট্যানের মৃত্যুর পর তাই ব্রকাস পোস্ট মর্টেম করে তার ব্রেইনে একটা বাড়তি অংশের খোঁজ পায়। এটাকেই ট্যান ব্রকাস এরিয়া বলা হয়। এই অংশটির জন্যই সে স্পীচ গুছাতে পারতো না। 

তিন নম্বর পয়েন্টে হিস্টেরিক্যাল প্রেগন্যান্সি মূলত ফলস প্রেগন্যান্সি। যখন কেউ প্রেগন্যান্সির সমস্ত সিম্পটম শো করে কিন্তু আসলে তার ভেতর কোন ফিটাস নেই তখন তাকে হিস্টেরিক্যাল প্রেগন্যান্সি বলে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় সিউডোসাইসিস। মূলত হিস্টেরিয়ার রোগীরাই এধরণের সিম্পটম শো করে। হিস্টেরিয়া মূলত একধরণের ট্রমা যেটা একজনের মাঝে এংজাইটি, ইনসমনিয়া, রেইজ ইত্যাদির সৃষ্টি করে।

তো এতোসব ভারী ভারী কথা বললাম মূলত মিসেস প্রহেলিকাকে ব্যাখ্যা করার জন্যই। মিসেস প্রহেলিকাতে আমরা দেখতে পাই তিশা তার বাস্তবতাকে স্বপ্ন বলছে আর সাইকিয়াট্রিস্ট চঞ্চল সেটাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করছেন। তিশা বলছেন বারবার যে যা হচ্ছে সব স্বপ্নে হচ্ছে আর চঞ্চল বলছেন সবকিছুই বাস্তবে হচ্ছে। দুজনের এই দ্বন্দ্ব কথোপকথনে স্পষ্ট হতে থাকে। তিশা তার পাস্ট ট্রমার কথা বলেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে কোমায় ছিলেন সেটা জানান, তার ধারণা তিনি আর ওঠেন নি, স্বপ্নই দেখছেন এখনো।

পরিচালক সাটলভাবে তাই আমাদের উপরের পয়েন্টগুলো দিয়ে এটাই বুঝিয়েছেন যে হতে পারে তিশা আসলে হিস্টেরিয়ার রোগী। মিসেস প্রহেলিকা আসলে অ্যানা ও। যেভাবে হিস্টেরিয়ার রোগীরা হিস্টেরিক্যাল প্রেগন্যান্সি কল্পনা করে নেয় সেভাবে তিশা হয়তো কল্পনা করছেন, যা আবার তার কাছে বাস্তব। তার মেমোরি লস হওয়া, এংজাইটি সবকিছু হিস্টেরিয়ারই ফসল। হিস্টেরিক্যাল প্রেগন্যান্সির জন্যই কি প্রহেলিকার নাম ‘মিসেস’ প্রহেলিকা? কারণ সে বিবাহিত এটা তো বলে নি কোথাও!

আবার অন্যদিকে আমরা শেষে গিয়ে দেখতে পাই চঞ্চলের ফেলে দেয়া পেপারওয়েট আসলে নিচে পড়ে নি, সেটা ঘরের মাঝ বরাবর দুলছে। তার মানে তিশা আসলেই স্বপ্ন দেখছে। চঞ্চল তার অংশ কেবল। তিশা আসলে হাসপাতালেই শুয়ে আছে। সে হাসপাতালেই কোমাতে থাকা অবস্থায় ডাক্তার বা নার্সদের মুখে শুনতে পাচ্ছে ‘এক্রোম্যাটোপসিয়া’, সেটাকেই চঞ্চলের মুখ দিয়ে নতুন শব্দ হিসাবে বলাচ্ছে। তিশা সিগারেট ধরাতে পারে না বলেই প্রথমে চঞ্চল উল্টো করে সিগারেট ধরায় প্রথমে। তিশা যখন কোমাতে গিয়েছিল তখনই হয়তো দেবি মুক্তি পেয়েছিল। আজ থেকে দু’বছর-তিন বছর আগে।

গল্পকার ও কলাকুশলীরা মূলত তিশা ও চঞ্চলের দ্বন্দ্বটাকে দর্শকদের মাঝে দিতে চেয়েছেন। দর্শক চাইলে তার মতো করে গল্পটাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন। হতে পারে সে ব্যাখ্যায় চঞ্চল সঠিক, হতে পারে তিশা। হতে পারে সবই বাস্তব, কিছু অলৌকিক; অথবা হতে পারে পুরোটাই কল্পনা, ঊনলৌকিক। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা