ষাট থেকে সত্তরের দশক চলছে। পুরো পৃথিবী কাবু হয়ে আছে লিভারপুলের চার ছেলের বানানো একটি ব্যান্ড গ্রুপের ম্যানিয়ায়। দুর্দান্ত সব লেখা-গানে মাতোয়ারা দর্শক, প্রতিনিয়ত নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে ব্যান্ড মিউজিক। যার সাথে আমরা আজও পরিচিত, হ্যাঁ 'বিটলস ম্যানিয়া'র কথাই বলছি।

জন লেনন, পল ম্যাকার্টনি, জর্জ হ্যারিসন এবং রিঙ্গো স্টার পৃথিবী কাঁপিয়ে জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক ইতিহাসেরসেই বিটলস ম্যানিয়ার ঢেউ এসে লেগেছিলো কলকাতার পথেঘাটেওকিন্তু সেই সময় বিশ্ব মিউজিক শোনাটা আজকের মতো এতো সহজ ছিল না নিশ্চিতভাবেইতাই তা জোগাড় করতেই কাঠখড় কম পোড়াতে হতো না

কিন্তু এসব ধাঁচের গান নিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের আগ্রহ ছিল অন্যরকম এবং একটু বেশিইএমনিতেই ছেলেবেলা থেকে পরিবারে বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্রে হাতেখড়ি হয়েছিলোতাই গানের সাথে আত্মার সম্পর্কের জায়গা থেকেই নতুনত্বের খোঁজে সবকিছু সামলিয়ে তিনি তা ঠিকই জোগাড় করতেন এবং অন্যদেরও সেই বিশ্ববিখ্যাত 'বিটলস' এর গান শোনাতেনএভাবেই যখন বাংলার আবহাওয়ায় ক্লাসিক্যাল মিউজিকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ চলছিলো, তখন পশ্চিমার রক মিউজিকের সাথে পরিচিত পর্যায় থেকে এক নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি

বাংলা গানের মধ্যে তখন একতরফাভাবে রমরমা রোমান্টিসজমের ফ্যান্টাসিও চলছে, তাতে বুদ গানের শ্রোতারাওসেই শ্রোতাদের নতুন আবহের গানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার লড়াইটা তাই অতটা সহজ ছিল নাকিন্তু গৌতম চট্টোপাধ্যায় বৃত্ত ভাঙার অভ্যাসটা হয়তো ছোটবেলা থেকেই রপ্ত করেছিলেন কোনোভাবে, এটিই তাঁকে কালজয়ীর আসনে বসিয়ে গেছে

স্বপ্নটা বরাবরই বিপ্লবের ছিল, পারিপার্শ্বিকতাও খানিকটা তাইসমাজের শৃঙখল ভাঙতে বিদ্রোহের নেশায় মত্ত একদলকোনোভাবে এদিক ওদিক থেকে আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নকশাল জীবনে জড়িয়ে গেলেন তরুণ গৌতমগ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্নে বিভোর তিনিবুকে রেডবুক পুড়ে, মিশে গেছেন মাঠের কৃষকের সাথেকৃষকের সাথে ধান মাড়াই শেষে গেয়েছেন নবান্নের গানকিন্তু বিপ্লবের চূড়ান্ত ফলাফল কি এতই সহজে আসে?

অপরদিকে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ও তাদের আজ্ঞাবহ প্রশাসনও পিছিয়ে নেইযে করেই হোক দফারফা করা হবে একবুক দ্রোহের স্বপ্নকে, সেই চেষ্টা রাতদিন চালিয়ে যাচ্ছে তারাবেহালার বাড়িতে মায়ের সাথে দেখা করতে ফিরতেই গ্রেফতার হলেন, সাথে আরো দুই সহযোগী৷ এক বন্ধুকে তাদের সামনে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করার খবরও শোনা গেছে হরহামেশাদীর্ঘ দেড় বছর পর নানা শর্তে ছাড়া পেলেন তিনিএক পশলা রাজনৈতিক স্বপ্নের অপমৃত্যু যদিও হয়েছিলো, তবে পরবর্তীতে গানের মাঝে সুদিন ফিরে আসার ইঙ্গিতটা তিনি দিয়েই রেখেছিলেন, যা তার রাজনৈতিক চেতনার একপ্রকার চমৎকার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি

চল্লিশের দশকে জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'ঘোড়া' কবিতায় লিখেছিলেন, 'মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে'তার ঠিক তিন চারেক-দশক পর তথা ১৯৭৪ সালের কথাএক বিকেলের জমজমাট আড্ডায় সেই কবিতা আবৃত্তি শেষে দলের নাম 'মহীনের ঘোড়াগুলি' রাখার প্রস্তাব করে বসলেন রঞ্জণ ঘোষালমুহুর্তেই লুফে নিলেন গৌতমএকবার নয়, বরং কয়েকবার নাম পাল্টিয়ে অবশেষে সেই নামেই থিতু হলেন তারা

ব্যান্ডের সদস্যরা

আসলে সপ্তর্ষি, তীরন্দাজ নামগুলোও যেন আর জমছিলো না৷ সবার চেয়ে খানিকটা আলাদা হওয়ার আচ্ছন্ন প্রবণতা পুরো দলেরই হয়তো বরাবরই ছিল। পাশাপাশি নিজেদের মেধা এবং উপলব্ধিগুলোকেও তারা কাজে লাগাতে পারছিলো যথাযথভাবেআচ্ছা এই দলের সদস্যদের নামগুলোও একটু জেনে নেয়া যাকগৌতম চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জণ ঘোষাল, তাপস দাশ, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এব্রাহাম মজুমদারকে নিয়েই এই সাত সদস্যের দল!

শুরু হলো এক ধরনের আনুষ্ঠানিক পদযাত্রাবিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট আয়োজনে তারা হাজির হচ্ছেন, গাইছেন নিজেদের বানানো গানএদিকে গানগুলোতে যেন তৈরি হয়েছিলো পশ্চিমা ধারার সঙ্গীতের সাথে বাঙালিয়ানা ও বাঙালির জীবনের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণপুরোপুরিভাবে নতুন আঙ্গিকে কলকাতার নাগরিক জীবন ভেসে আসছে গানেপ্রেম-দ্রোহ-বিপ্লব-একাকীত্ব থেকে শুরু করে নাগরিক কোলাহলের ভীড়ে নানান সংকট, সবকিছুর জায়গা যেন তারা তুলে ধরছেন নিজেদের গানের ভেতর

ষাট দশকের বব ডিলানের 'আরবান ফোক' কিংবা জিম মরিসন ও সিগারের গাওয়া গণমানুষের গানগুলোর ধারাকেই এক আদর্শিক মাপকাঠিতে নব চিন্তায় বাঙালির জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলো গৌতম ও তাঁর বন্ধুরা। কিন্ত সবচেয়ে বড় কথা, তাদের গানের মধ্যে ছিল অদ্ভুত প্রগতিশীলতার স্পর্শগৌতম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সাঙ্গরা ছিলো তাদের সময় ও প্রজন্মের মনোজগতের চেয়ে কয়েক দশক এগিয়েঅন্তত মহীনের কম্পোজগুলো তাই প্রমাণ করে

ধরুন হারমোনিয়াম ছাড়াও কেবলমাত্র গিটারের তারে যে একটি গান হতে পারে, গৌতম চট্টোপাধ্যায় ছাড়া কে প্রথম দেখিয়েছিলেন! একটি গিটার হাতে লাতিন আবহে কলকাতার কোনো বাড়ির ছাদে বসে একাকীত্বের পারদে যেভাবে নিজের লেখা গান 'আমার প্রিয় ক্যাফে' গাইলেন, আহা কি চমৎকার! আবার তারাই 'চৈত্রের কাফন' এর মতো গান সৃষ্টি করেছেন

এভাবেই মহীনের ঘোড়াগুলি-র গান প্রগ্রেসিভ রক, ল্যাটিন, ব্লুজ এর সাথে মিশে গেল দেশীয় ফোক গানের ধাঁচ ও সুর, আর কথার মধ্যে একরাশ ভিন্নধর্মী স্বপ্ন ও অবিরাম বাস্তবতাযার ফলে সমাজের যেকোনো শ্রেণীর মানুষ যেকোনো পর্যায়ে বসেই সেই গানগুলোর সাথে আজও নিজের বাস্তবিক অভিজ্ঞতা ও চেতনাকে সম্পৃক্ত করতে পারে৷ জীবনমুখী গানগুলোর শ্রেষ্ঠত্বই বুঝি এখানেই

গৌতম চট্টোপাধ্যায়

১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালের ছয় বছরের প্রথম অধ্যায়, তিনটি এলবাম এর মধ্যে আটটি গান ও পাশাপাশি রেকর্ড ছাড়া আরো কিছু গানএতটুকুই সম্বল ছিল তাদেরকারণ কলকাতার দর্শকরা সেই সময়ে মহীনের ঘোড়াগুলিকে সঠিক ও যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিলোগতানুগতিক গান শুনতে অভ্যস্ত শ্রোতারা শুধু মহীনের ঘোড়াগুলিকে পাশ কাটিয়ে গেছেন তা নয়, বরং মাঝে মাঝে কিনা শ্রোতাদের সমালোচনা ও বিরক্তির প্রকাশে নানা চিঠিপত্রও এসেছিলো তাদের কাছে

আকাশবাণীতে তাদের গানকে কোনো গানই নয় বলে পরিহাস করা হয়েছিলোসংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭), অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ--(১৯৭৮) এবং দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯) এই তিনটি অ্যালবাম প্রকাশিত হলেও, অ্যালবামের বিক্রির কাটতি অতটা ছিল নামূলত ফরেন মানি দিয়েই নিজেদের গানগুলোর রেকর্ড করে বাজারে ছাড়তে পেরেছিলেন তারাযা বেকার বিল্ডিং থেকে শুরু হওয়া তাদের পথচলাকে ততটা মসৃণ হতে দেয়নি

যদিও বিষয়গুলোকে এতো গুরুত্ব কখনো দেয়নি গৌতম ও তাঁর দলবরং পুরো বিষয়কে মজারচ্ছলেই দেখতেন তারাএর মধ্যে, বেশ কিছু শো করে তাক লাগিয়েছিলো মহীনের ঘোড়াগুলিওসেই সময়ে তাদের আয়োজনে রবীন্দ্রসদনে হওয়া শো এর প্রশংসা এখনো অনেকে করে থাকেন, এমনকি কেউ কেউ কলকাতার মিউজিক সেটিকে মাইলস্টোন হিসেবেই ধরে৷ একটি বাংলা ব্যান্ডের লাইভ শোতে, গীটার, ড্রামস, স্যাক্সোফোনের সাথে ভায়োলিন, পিয়ানো, বাঁশি সব একাকার হয়ে গিয়েছিলোভিন্নধর্মী আয়োজনে পিলে চমকে দিয়েছিলো অনেকরইতারপরও অহেতুক রোমান্টিসিজমে ভোগা মধ্যবিত্ত বাঙালির রুচি তখনো ততটা বদলায়নি বা পাকাপোক্ত হয়নি যে মহীনের গানের ধাঁচকে তারা গ্রহণ করতে পারবেপারেওনি, একথা আজ সকলে অকপটে স্বীকারও করেন

১৯৮১ সালে ভেঙে যায় মহীনের ঘোড়াগুলিব্যান্ড সদস্যরাও নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, আড়ালে চলে যান সকলেসিনেমার জন্য গান লেখার পাশাপাশি গৌতম চট্টোপাধ্যায়ও মনোযোগ দেন ফিল্মিং এসেখানেও অনবদ্য তিনিনিজের বানানো প্রথম ফিচার সিনেমা 'নাগমতী'র মাধ্যমে জিতলেন জাতীয় পুরষ্কারও

তবে মহীনের ঘোড়াগুলি ফিরেছিলো বটেশোনা যায় আশির দশকে শেষের দিকে সুব্রত ঘোষাল নামে প্রেসিডেন্সির এক তরুণের উদয় ঘটেমহীনের কিছু গান শুনে সে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে যায় যে, কলকাতা ঘুরে গৌতম চট্টোপাধ্যায়কেও খুঁজে বের করে ফেলেনমহীনের মিউজিক নিয়ে এক তরুণের আগ্রহবোধ নাড়া দেয় গৌতমকেকেননা এইযে তাদের সৃষ্টি, এগুলো তো তরুণদের আত্মিক তাড়নাতেই বানানো৷ আবার ফেরার পালা মহীনের ঘোড়াগুলির

অতঃপর ১৯৯৫ সালের বইমেলায় মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত 'আবার বছর কুড়ি পরে' এলবামটি মুক্তি দিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায় যেন নব্বইয়ের পাগলামো তরুণ প্রজন্মকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিলেনশুধু তাই নয়, নিজেদের গানের বাইরেও বেশ কিছু তরুণদের সমন্বয়ে তাদের গানকে প্লাটফর্ম দিলেন নিজেদের এলবামে

১৯৯৫ সালে পুনরায় নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া- 'আবার বছর কুড়ি পরে'

এপার বাংলা, ওপার বাংলা সকলে গ্রোগ্রাসে খেল সেই গানগুলোকে, সুরগুলোকেমহীনের ঘোড়াগুলি হয়ে উঠলো নতুন পথ-প্রদর্শক, মর্যাদা পেল বাংলা ব্যান্ড প্লাটফর্মের প্রথম ব্যান্ডেরএভাবে গৌতম চট্টোপাধ্যায় আবির্ভূত হলেন এক নতুন অভিভাবকরূপেসকলের প্রিয় মণিদা, সকলের প্রিয় মহীনের ঘোড়াগুলি। আজও মহীনের গান বাঙালির হৃদয়ে তোলে প্রেম ও দ্রোহের বাদ্যআজও গানের নব উন্মাদনায় মহীনের ঘোড়াগুলি হয়ে উঠে অবিচ্ছেদ্য অনুপ্রেরণাপ্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে মহীনের গানগুলোকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে ধারণ করে চলেছে, গানগুলো নিয়ে তৈরি করে চলেছে নিজস্ব ভাবনার সীমাহীন জগৎ

গৌতম চট্টোপাধ্যায় তাঁর মহীনের ঘোড়াগুলি নিয়ে কেবল আঁকতে চেয়েছিলেন বিপ্লবের লাল রংবব ডিলান থেকে রবি শংকর, সবটাই গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা আনতে চেয়েছিলেন নিজেদের সংগীতের প্রাণে'পৃথিবীটা নাকি' গানটিতে মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে একটি বোকা বাক্সতে বন্দী হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখেছিলেনতীব্র অভিমানে গৌতম বলেছিলেন এরা বোকা বাক্সতে বুঁদ, এদের জন্য আর কী গাইবো! স্বপ্ন বেচার চোরা কারবারদের ভীড়ে নিজের অস্তিত্ব বিলীনের শঙ্কায় ভুগেছিলেনভেবে দেখেন, প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও সেই গানের প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু কমে যায়নিতারপরেও বাঙালির স্পন্দনে তারা আরো বেশি রয়ে গেছে, তাদের না থাকাজুড়ে, একবিন্দুও সরে যাওয়া হয়নি!

'হায় ভালোবাসি' গানে মহীনের ঘোড়াগুলি গেয়েছিলো আমাদের সবকিছুই ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু যখন দেখি তারা মাঠে প্রান্তরেবন্দরে কাজ করছে তখন আর কিছুই ভালো লাগে নাআমাদের তাকানো উদাসী পথে তখন কেবলই বিষাদ ভেসে উঠেএজন্য মহীনের ঘোড়াগুলি সুদিনে ফিরে আসার কামনাও করেছেএই যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে গানের মাঝে বিপ্লবের সুপ্ত বাসনা, এতো গভীর ও সহজাত আবেগের ভাষায় আর বাংলার কোন ব্যান্ড গরীব-মেহনতি মানুষের কথা এতো চমৎকারভাবে বলেছে? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা