পালাগানের জনপ্রিয় এক গায়িকার খোঁজ পেয়ে ইত্যাদি টিম গেল মানিকগঞ্জে। কিন্তু তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন সেই শিল্পী, বলেন, টিভিতে গান করার ইচ্ছা তার নেই। পরে হানিফ সংকেত অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজি করালেন...

২০০০ সাল, গ্রাম-গ্রামান্তরের লুকিয়ে থাকা প্রতিভাকে ইত্যাদির মঞ্চে উন্মোচন করতেন হানিফ সংকেত। সেই সুবাদেই তিনি সংবাদ পেলেন মানিকগঞ্জের এক কন্ঠশিল্পীর। পালাগান করে বেশ জনপ্রিয় এই গায়িকা ইত্যাদি টিম গেলে তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। বলেন, টিভিতে গান করার ইচ্ছা নেই। পরে হানিফ সংকেত অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজি করান। মোঃ রফিকুজ্জামানের কথায় ও সোহেল আজিজের সুরে ইত্যাদিতে বেজে উঠলো সেই  গান 'রিটার্ণ টিকেট হাতে লইয়া, আইসাছি এই দুনিয়ায়; টাইম হলে যাইতে হবে যাওয়া ছাড়া না উপায়...' 

গানটা প্রচারের পরপরই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, এই গান মুহুর্তেই হয়ে গেল শ্রোতাদের আকাঙ্ক্ষিত, আর মানিকগঞ্জের পালাগানের গায়িকা থেকে সারা বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যান সেই কন্ঠশিল্পী। 

এরপর ধীরে ধীরে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজের কন্ঠে যেমন 'ফাইট্টা যায়' গেয়েছেন,তেমনি গেয়েছেন 'আগে যদি জানতাম বন্ধু তুমি হইবা পর'। গ্রাম-বাংলার গানে অত্যন্ত জনপ্রিয়তার কারনে পেয়েছেন ফোক সম্রাজ্ঞীর খেতাব, তিনি বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী 'মমতাজ'।

'বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়, ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়- মমতাজের গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। গ্রাম-বাংলায় এই গান তখন হুলস্থুল ফেলে দিয়েছিল, এই গানের এলব্যাম 'প্রাণসই' ছিল সেই বছরের সবচেয়ে বিক্রিত এলব্যাম। যদিও চটুল কথার জন্য সঙ্গীতবোদ্ধারা এই গানের খুব সমালোচনা করেছিলেন, তারুণ্য দর্শকরাও হাসি তামাশা করে বলতেন,এটা নিম্নশ্রেণীদের গান। 

তবে ফাইট্টা যায় গানের তুমুল জনপ্রিয়তা বলে দেয় এই গানের আলাদা একটা মূল্য আছে। এরপর নান্টু ঘটক, আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেলো গো মরার কোকিলে- সহ প্রচুর জনপ্রিয় গান গেয়েছেন, অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন পালাবদল এনেছিলেন। প্রায় সব এলব্যাম ই প্রচুর বিক্রি হতো। 

মমতাজের বাবা ছিলেন বাউল শিল্পী, সংসারে অভাব থাকায় শৈশবেই বাউল গান গাইতেন। এরপর পালাগান, জারি গান সহ বহু গান গেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। এত জনপ্রিয়তার পরেও পালাগান ছাড়েননি, সেই সূত্রেই পরিচয় শাহ আলম সরকারের সাথে। যিনি মমতাজের বেশিরভাগ গানেরই রচয়িতা। 

'বান্ধিলাম পিরিতের ঘর, ভালোবাসার খুঁটির পর; আদরের দিলাম ঘরে চাল, ও মনরে সুখেতে রব চিরকাল', শাহ আলম সরকারের কথায় ইমন সাহার সুরে 'মোল্লা বাড়ির বউ' সিনেমার এই গান শুনে বিমোহিত হন নি এমন শ্রোতা পাওয়া যাবে না। মুগ্ধ করা এই গানের গায়িকার নাম শুনে অনেকেই আশ্চর্য হয়েছিলেন, চটুল সস্তা গান গেয়ে বেড়ানো গায়িকার এমন উচ্চশিল্পমূল্য গান গাওয়া যেন অভাবনীয়। সেটাই করে দেখালেন মমতাজ। এই গানের পর সংগীত বোদ্ধাদের থেকেও প্রশংসা অর্জন করে নিয়েছিলেন। 

মমতাজ বেগম

'খায়রুণ লো তোর লম্বা মাথার কেশ'- চলচ্চিত্রের গানেও নিজেকে স্বাতন্ত্র্য করেছেন মমতাজ, প্লেব্যাকে এটি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। এই ধারায় এসে নিজেকে আরো বৈচিত্র্য করে তুলেছেন। ইতিহাস সিনেমার 'মনে যদি পচন ধরে' থেকে মনপুরার গান 'আগে যদি জানতাম বন্ধু তুমি হইবা পর সব গানেই সমাদৃত হয়েছেন। প্লেব্যাকের পাশাপাশি অভিনয় ও করেছেন। হৃদয়ের বন্ধনের তুমুল হিট গান 'বধূ বেশে কন্যা যখন এলোরে', অন্য মানুষ সিনেমার 'বাজলো বাঁশি ছাড়লো গাড়ি'তে বিশেষ অভিনয়শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। 

সম্প্রতি সত্তা সিনেমার 'না জানি কোন অপরাধে' গান গেয়ে আরেকবার দর্শকনন্দিত হয়েছেন, দেবী সিনেমায় গেয়েছেন 'দোয়েল পাখির কন্যারে', ভয়ংকর সুন্দর সিনেমাটি দর্শকরা হয়তো ভুলেও মনে করতে চাইবেন না, তবে তাঁর গাওয়া 'ফিরবো না আর ঘরে' গানটি অবশ্যই মনে রাখবেন সবাই। গানের পাশাপাশি আরেক অভাবনীয় কান্ড করে বসেছিলেন 'মমতাজ' সিনেমায় নিজ চরিত্রে অভিনয় করে, ছবিটিও হয়েছিল বাণিজ্যিক সফল। বেশকিছু বিজ্ঞাপনও করেছেন। 

রমরমা অডিও ইন্ডাস্ট্রি এখন বিস্মৃতি, প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এখন জনপ্রিয় ইউটিউব নির্ভর মিউজিক ভিডিও গান। অনেকে হারিয়ে গেলেও তিনি ঠিকই তাল মিলিয়েছেন। প্রীতমের সুরে 'লোকাল বাস' এর মত জনপ্রিয় গান সেটাই প্রমাণ করে, এক কনসার্টে দেখা গেল তিনি র‍্যাপ গান ও গাইছেন, যেটা সত্যিই চমকপ্রদ। 

বান্ধিলাম পিরিতের ঘর গানের জন্যই জাতীয় পুরস্কার পেতে পারতেন, সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন তিনি। কিন্তু জুরি বোর্ডের অবিচক্ষণতার দরুন ভাগ্য সহায় হয়নি। এরপর নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ সিনেমার 'নিশিপক্ষী' গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। সত্তা সিনেমার 'না জানি কোন অপরাধে'র জন্য দ্বিতীয়বারের মত জাতীয় পুরস্কার জিতেছেন, সর্বশেষ পেয়েছেন মায়া: দ্য লস্ট মাদারের 'ডালিম গাছ' গানের জন্য। 

বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে দর্শক জরিপে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন দুইবার। এখানেও একটা বৈচিত্র্যময় ব্যাপার আছে। পত্রিকা কাটিং এর যুগেও যেমন তিনি পুরস্কার পেয়েছেন, তেমনই অনলাইনের যুগেও পেয়েছেন। 

ক্যারিয়ারে সস্তা, চটুল গান অনেক গেয়েছেন এটা সত্যি। তবে কিছু কিছু গানের জন্য তিনি অম্লান থেকে যাবেন সঙ্গীতভুবনে। শ্রোতাদের মাঝে তাঁর মতো জনপ্রিয় গায়িকা বাংলাদেশে খুব কম এসেছেন, তবে শ্রোতাদের মাঝেও তাকে নিয়ে কিছুটা দ্বৈত ভাব আছে। বিশেষ করে তারুণ্য ও উচ্চবিত্তদের মাঝে। তার গান সবাই শোনেন, তবে সেটা অনেকেই যেন তাচ্ছিল্যর মাঝেই প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।। এখনো কনসার্টে তিনি থাকলে দর্শক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, প্রাণ সঞ্চার করেন।

একেবারে প্রান্তিক থেকে উঠে আসা এই জনপ্রিয় গায়িকা পরবর্তীতে চোখের হাসপাতাল দিয়েছেন, তিনবার সাংসদ হয়েছেন। এখানেও তিনি অনেক সফল। ১৯৭৪ সালের আজকের এইদিনে জন্মগ্রহণ করা এই জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী আজ পেরোচ্ছেন জীবনের ৪৭ বছর, শুভকামনা রইলো। শুভ জন্মদিন, মমতাজ!


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা