আমাদের জানা নেই, 'মানি হেইস্ট' এর শেষ সিজনের চমৎকারিত্ব সিরিজটির সাথে 'কালজয়ী' তকমা এঁটে দিতে পারবে কী না। তবে জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে তারা যে অহেতুক দীর্ঘ করতে চান নি তাদের নির্মাণ, থেকেছেন যে নির্লোভ, সেজন্যে একটা বিশেষ ধন্যবাদ অবশ্যই প্রাপ্য তাদের...

শিল্পসংস্কৃতির সাম্প্রতিক কালে 'ওয়েব সিরিজ' এর চেয়ে রমরমা অবস্থানে আর কোনো বিনোদন-উৎস আছে বলে বিশ্বাস হয় না। প্রতিদিনই একেকটা স্ট্রিমিং সাইটে বৈচিত্র্যময় নানা সিরিজের খবর আসছে। দর্শকেরাও খুশি। মনের আঁশ মিটিয়ে তারা দেখতে পারছেন সব, বিস্তারিত বর্ণনায়। নির্মাতারাও তৃপ্ত। সেন্সরের চোখরাঙানি নেই, আড়াই ঘন্টার মধ্যে শেষ করার তাগাদা নেই, তারাও গল্প বলে যাচ্ছেন অবাধ স্বাধীনতায়। সবমিলিয়ে উইন-উইন সিচুয়েশন। 

তবে একেকটা 'ওয়েব সিরিজ'এ যেহেতু বিনোদন এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনেক দিকও জড়িত থাকে, তাই এরকম অনেক ওয়েব সিরিজ চোখে পড়েছে, যারা খুব আশাব্যঞ্জকভাবে শুরু করেছিলো যাত্রা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যাদের মান কমেছে। কিন্তু তারা তবুও ইলাস্টিকের মতন টেনে লম্বা করেছে ক্লিশে গল্পের সিজনগুলো। নিজেদের ব্যবসা ধরে রাখার জন্যে জড়ভরতের মতন প্রশস্ত করেছে সব। আখেরে নিজেদের নামই খানিকটা ডুবিয়েছে তারা৷ 

তবে এক্ষেত্রে বিশ্বসেরা সিরিজ 'ব্রেকিং ব্যাড' এর কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। যখন 'ব্রেকিং ব্যাড' এর সমাপ্তি টানা হয়, এই সিরিজ তখন মাত্র পঞ্চম সিজনে। আইএমডিবি রেটিং ও হু হু করে বাড়ছিলো। দর্শকেরা ধরেই নিয়েছিলো, আরো দুই-তিন সিজন অনায়াসেই যেতে পারবে বিবি। কিন্তু ভিন্স গিলিগান চেয়েছিলেন, যেটা যেখানে শেষ হওয়ার, সেটাকে সেখানে শেষ করাই সার্থকতা৷ ফলে, খ্যাতির চূড়ায় থাকা অবস্থানেই যাত্রার ইতি টানে ব্রেকিং ব্যাড৷ নির্ধারিত সময়ে সমাপ্তি টানার এই পরিমিতজ্ঞান এই সিরিজকে রূপান্তরিত করে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাল্ট ক্লাসিকে। 

ঠিক একই বিষয় লক্ষ্য করি, বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টিভি সিরিজ 'লা কাসা দে পাপেল' এর ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালে নেটফ্লিক্সে প্রথম সিজন মুক্তির পরেই যা  কাঁপিয়ে দেয় গোটা পৃথিবী৷ খুব অল্পসময়ের মধ্যেই বিশাল এক ফ্যানবেজ জুটে যায় তাদের। প্রফেসর, বার্লিন, টোকিও, নাইরোবি, ডেনভার পরিণত হয় একেকজন সুপারস্টারে। এ বছরে আসতে চলেছে এই সিরিজের পঞ্চম ও সর্বশেষ সিজন। যে মালমশলা এখনো এই সিরিজের আছে, তা দিয়ে অনায়াসে আরো তিন-চার সিজন টানা যেতো, দর্শকেরাও চাচ্ছিলেন সেটা। কিন্তু নির্মাতাদের একটাই কথা- 

জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ সীমায় থেকেই শেষ করতে চাই যাত্রা! 

মানি হেইস্টের সবচেয়ে বড় তারকা; দ্য প্রফেসর

গত সিজন যে ক্লিফহ্যাঙ্গারে থেকে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে দর্শকদের প্রত্যাশা ছিলো, এত সহজেই হয়তো ক্ষান্ত হচ্ছেনা দুর্দমনীয় এই ডাকাতেরা। কিন্তু সেই প্রত্যাশার বাড়াভাতে ছাই দেয়া 'সিজন ফিনালে'র এই ঘোষণার পেছনে নির্মাতাদের যুক্তিও ফেলনা না। তারা মনে করেন, প্রত্যেক শো' এর একটা মোমেন্টাম থাকে। কতটুকু কি বজায় রেখে সামনে এগোলে সেই মোমেন্টাম নষ্ট হবে না, সেটা বুঝতে পারাটা জরুরি। অনেক সিরিজই আছে, যারা পিক মোমেন্টামে থাকা সত্বেও শুধুমাত্র 'কার্টেন কল' এর সঠিক সময় না বোঝার জন্যে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই। এভাবে টাইমিং না বুঝে এগোলে যা হয়, বছরের পর বছর ধরে সিজন একের পর এক আসবে। কিন্তু, দাগ কাটার সেই বিষয়টি থাকবে না। সেই রোমাঞ্চটি থাকবে না। ভালো কাজের সেই সুনামটি আর থাকবে না। 'লা কাসা দে পাপেল' সে কারণেই পায়ের চিহ্ন মুছতে চাচ্ছে এই বেলায়। নির্মাতাদের এই কথা যেন 'ব্রেকিং ব্যাড' এর ভিন্স গিলিগানকেই মনে করিয়েই দেয়! 

চলছে শেষ সময়ের শুটিং! 

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তার এক লেখায় একবার লিখেছিলেন-

একজন ভালো লেখকের সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি জানেন- কোথায় গিয়ে থামতে হয়।

বিশ্বখ্যাত সব বই, সিনেমা, সিরিজের ক্ষেত্রেও একই বিষয় লক্ষ্য করি। সমাপ্তির চমৎকারিত্বের কারণেই এই নির্মানগুলো হয়ে যায় কালজয়ী, ক্লাসিক। আমাদের জানা নেই, 'মানি হেইস্ট' এর শেষ সিজনের চমৎকারিত্ব সিরিজটির সাথে 'কালজয়ী' তকমা এঁটে দিতে পারবে কী না। তবে জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে তারা যে অহেতুক দীর্ঘ করতে চান নি তাদের নির্মাণ, থেকেছেন যে নির্লোভ, সেজন্যে একটা বিশেষ ধন্যবাদ অবশ্যই প্রাপ্য তাদের। সিজন ফিনালের জন্যে অপেক্ষা। শেষটায় দাগ কাটার মতনই এক সমাপ্তি চাই তাদের কাছ থেকে।

তাহলেই মধুরেণসমাপয়েৎ। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা