
এক গল্পকারের গল্প যখন অন্য গল্পকার নিজের মতো করে সাজান, তখন পুরো ব্যাপারটা কেমন হয় সেটা দেখার ইচ্ছে ছিল। একটা এক্সপেক্টেশন তো ছিলই, সত্যি বলতে গেলে সেই এক্সপেক্টেশনকে ছাড়িয়ে গেছে মরণোত্তম...
শিরোনাম দেখে ভড়কে যাবার দরকার নেই। পুরো লাইনটা শুনুন আগে- বিগত কিছু সময়ে বাংলা চলচ্চিত্র কিংবা নাটকে বই থেকে হওয়া অন্যতম সেরা এডাপ্টেশন মরণোত্তম। হ্যাঁ, অন্তত আমার সেরকমটাই মনে হয়েছে। একে তো বই থেকে এডাপ্টেশন খুব কমই হয়েছে এই সময়ের মাঝে তার ওপর কখনোই বইয়ের সাথে জাস্টিস করতে পারে নি অধিকাংশ ভিজুয়্যাল ফিকশন। এই ঈদে আমি সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলাম যে ভিজ্যুয়াল ফিকশনের জন্য, সেটি হল- মরণোত্তম। আমার জন্য ডাবল ট্রিট ছিল কেননা লেখক সাদাত হোসাইন ও পরিচালক সঞ্জয় সমদ্দার দুজনই গল্পের মানুষ, গল্প বলতে ভালোবাসেন। তাই এক গল্পকারের গল্প যখন অন্য গল্পকার নিজের মতো করে সাজান তখন কেমন হয় সেটা দেখার ইচ্ছে ছিল। একটা এক্সপেক্টেশন তো ছিলই, সত্যি বলতে গেলে সে এক্সপেক্টেশনকে ছাড়িয়ে গেছে মরণোত্তম।
মরণোত্তম গল্পের শুরুটা হয় আসাদ ও রফিকের সাথে। দুজন গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকে। তখনও নাটকের নাম, কলাকুশলী কিছু দেখানো হয় নি। প্রথম তিন মিনিটের সে কথোপকথন সত্যি বলতে আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে। পুরো টেলিফিল্মের টোন সেখানেই সেট হয়ে গেছে। এরপর পরিচালক টেলিফিল্মের নাম ও কলাকুশলীদের এনেছেন। দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন শুরুতেই সঞ্জয় সমদ্দার। তিনি যেন শুরুতেই স্টেটমেন্ট দিয়ে গেছেন যে তিনি সাদাত হোসাইনের গল্পটাকে এভাবেই দেখেছেন। আমার যেহেতু বইটি পড়া তাই আমারও ভালো লেগেছে ডিফারেন্ট ইন্ট্রো দেখে।
সাদাত হোসাইনের মরণোত্তম উপন্যাসে বেশকিছু স্ট্রং পয়েন্ট ও উইক পয়েন্ট ছিল। আমার একটা অভিযোগ ছিল যে প্রতিবাদের ভাষা কেন এতো ব্যাঙ্গাত্মক। সেই ব্যঙ্গকে সঞ্জয় সমদ্দারও ব্যবহার করেছেন, কবি আসাদের মুখ থেকে। কিন্তু ইমতিয়াজ বর্ষণের অভিনয়ের কারণেই হোক কিংবা সঞ্জয় সমদ্দারের ডিরেকশনের কারণে সেগুলো ওভার দ্য টপ মনে হয় নি। সাদাত হোসাইনের লেখা তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গগুলো কবি আসাদের মুখ থেকে ছুঁড়ির মতো ছুটে আসে যেন দর্শকের দিকে। আমাদেরও ভাবিয়ে তোলে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলো সম্পর্কে।
গল্পের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই দবির খাঁ মেমোরিয়াল স্কুলের ভগ্নদশা। স্কুলের সাইনবোর্ড খসে ‘দাবর খা’ হয়ে গেছে অযত্নে-অবহেলায়। স্কুল মাস্টার রফিক ও হেডমাস্টার আজিজ সাহেবের কথোপকথনে উঠে আসে স্কুলকে এমপিওভুক্ত করা নিয়ে তাদের স্ট্রাগলের কথা। সকল শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও কেবল নামের জন্য রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আজিজ মাস্টারের বাবার নামের এই স্কুলটি এমপিওভুক্ত হচ্ছে না। গ্রামের চেয়ারম্যানের নামে করে দিলেই সাথে সাথে এমপিওভুক্ত করে দিতেন তিনি। কিন্তু সৎ ও সরল আজিজ মাস্টার তার বাবার স্বপ্নের এই স্কুলকে অন্য কারও নামে করে দিতে চান না।
এরই মাঝে স্কুলের এক মেয়ে কোহিনূরকে উত্যক্ত করে চেয়ারম্যানের ছেলে রাকিব। কোহিনূর এসে আজিজ মাস্টারকে জানায় সে কথা। আজিজ মাস্টার গিয়ে জানায় চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যান আজিজ মাস্টারকে অভয় দেন যে তিনি এটির একটা ব্যবস্থা নেবেন। আজিজ মাস্টারও নিশ্চিন্তে বাড়িতে ফিরে আসেন। ওদিকে ভিন্ন একটি টাইমলাইনে আজিজ মাস্টারকে ঢাকায় দেখা যায়। তিনি আমরণ অনশন করতে এসেছেন স্কুলকে এমপিওভুক্ত করার জন্য। সেখানে এসে তার পরিচয় হয় আসাদের সাথে। আসাদ কবি, আজিজ মাস্টারের সাথে তার খাতির হয়ে যায় সহজেই। আসাদ তাকে বলে যে এসব করে কোন লাভ নেই। এখন ভাইরাল হতে হবে, ভাইরাল না হলে কেউ পাত্তা দেয় না। আজিজ মাস্টার অতোশত বোঝেন না। তিনি বারবার বলেন তার যৌক্তিক দাবি মানতে কেউ রাজি না কেন? আসাদ একইসাথে আজিজ মাস্টারের সরলতায় মুগ্ধ হয়, একইসাথে ব্যঙ্গ করে। তাকে বোঝায় যে এসবের কোন মূল্য নেই আর এই রাষ্ট্রযন্ত্রে।
মূল উপন্যাসেও লেখক নন লিনিয়ারভাবে তার গল্প বর্ণনা করেছিলেন। এখানে পরিচালক আরও একটি টাইমলাইন ভেঙে শুরুতেই তিন ভাগে ভাগ করে ফেলেন গল্প।
প্রথম টাইমলাইন- আসাদ আর রফিক গ্রামে আছে, কোথাও যাচ্ছে
দ্বিতীয় টাইমলাইন- আজিজ মাস্টার ঢাকায়, আমরণ অনশন করছেন
তৃতীয় টাইমলাইন- আজিজ মাস্টার গ্রামে, কোহিনূরকে উত্যক্ত করা নিয়ে বিব্রত হয়ে বিচার চেয়ে বেড়াচ্ছেন
এই তিন টাইমলাইনকে স্ক্রিনপ্লেতে আনতে বেশ বেগ পাওয়ার কথা। কিন্তু পরিচালক বেশ ভালোমতোই সে কাজটি করেছেন। দর্শকদের বুঝতে তেমন কোন অসুবিধাই হবে না যে কোন সময়ে কোন ঘটনাটা ঘটছে। মরণোত্তম টেলিফিল্মের মূল প্রাণ এর অভিনেতারা। আজিজ মাস্টার চরিত্রে বর্ষীয়ান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনকে দেখা সত্যিই দারুণ ব্যাপার ছিল। আমি জানি না ওনার চেয়ে বেটার কাস্টিং সম্ভব ছিল কীনা এই রোলে। আমার বারবার মনে হয়েছে যে ইলিয়াস কাঞ্চনের জন্যই আসলে এই চরিত্রটি লেখা। ইলিয়াস কাঞ্চনের চোখের অসহায়ত্ব, মমতাবোধ, সরলতা প্রতিটি দিক যেন উঠে এসেছে এই চরিত্রের মাধ্যমে।
গ্রামের চেয়ারম্যানের চরিত্রে আরেক মহীরুহ শহিদুজ্জামান সেলিমও ছিলেন সপ্রতিভ। স্কুলের মাস্টার রফিক চরিত্রে সুজন হাবিবকে দারুণ লেগেছে। কোহিনূর চরিত্রে মাহিমাকে মানিয়ে গেছে। রাকিব চরিত্রে ইফতেখার ইমাজ খুবই ভালো অভিনয় করেছে। ওনার স্ক্রিনটাইম আরও বেশি থাকা উচিত ছিল। তবে এই টেলিফিল্মে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছেন আমাকে ইমতিয়াজ বর্ষণ। ঊনপঞ্চাশ বাতাসে ওনাকে যখন দেখেছিলাম তখন ওনার ক্যালিবার বেশ লিমিটেড মনে হয়েছিল। কিন্তু মরণোত্তমে এসে তিনি আমার ভুল ভেঙে দিলেন। ওনার কাছে যদিও সবচেয়ে ভালো ডায়লগগুলো ছিল, কিন্তু সেগুলো ডেলিভারিও তিনি করেছেন দুর্দান্তভাবে। উনি বেছে বেছে এরকম ভালো কাজ করুক, প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেল ইমতিয়াজ বর্ষণের প্রতি।
মরণোত্তম, এখনো পর্যন্ত বঙ্গ বব থেকে আসা আমার চোখে সেরা কাজ। উপন্যাসকে টেলিফিল্মের স্ক্রিপ্টে কনভার্ট করা ও স্ক্রিনপ্লে সাজানো বেশ কঠিন একটা কাজ। তার ওপর লেখকের শক্তিশালী সব ডায়লগগুলোকে প্রপারলি ডিস্ট্রিবিউট করা মুখের কথা না। সাদাত হোসাইন বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, অন্যদিকে সঞ্জয় সমদ্দার দারুণ দারুণ সব টেলিফিল্ম বানিয়ে এরই মাঝে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তাদের এই কোলাবরেশন সত্যিই দারুণ আগ্রহ জাগানিয়া।
এরকম কাজগুলো নিয়মিত হোক। বই থেকে হোক আরও অনেক অনেক সিনেমা, নাটক, টেলিফিল্ম। কতো গল্প, কতো উপন্যাস আছে আমাদের সাহিত্যে, সেগুলোও উঠে আসুক পর্দায়। সিনেমা হোক কিংবা সাহিত্য সবজায়গায় মড়ক লেগেছে গান ধরা শকুনের দল টের পাক তাদের সুরের মরণ হয়েছে, সে গানের জন্য মরণোত্তম। ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠছে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা-ভিজ্যুয়াল ফিকশন। তাদের জায়গা করে দেয়ার সময় এসেছে ওড়ার জন্য। উড়ুক।