
মহানগর দিয়ে মোশাররফ করিম অভিনয়ের নতুন একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিলেন, নিজের জন্যে তো বটেই, অন্য অভিনেতাদের জন্যেও। আয়নাবাজিতে যেমনটা করেছিলেন চঞ্চল চৌধুরী, অজ্ঞাতনামায় যেটা করেছিলেন ফজলুর রহমান বাবু...
এক
রিওডি জেনিরো, ব্রাজিল। ১৯৯৩ সাল। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচ, আগের ম্যাচে বলিভিয়ার কাছে হেরে জটিল একটা সমীকরণের মুখে দাঁড়িয়ে আছে স্বাগতিক দল। বিশ্বকাপের টিকেট পেতে হলে উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটা শুধু জিতলেই চলবে না, অন্তত দুই গোলের ব্যবধানে হারাতে হবে প্রতিপক্ষকে। নইলে এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মূল পর্বে দর্শক হয়ে থাকতে হবে তিনবারের জুলেরিমে ট্রফি জয়ীদের।
ব্রাজিলের জার্সি গায়ে সেদিন নামলেন এমন একজন, যাকে বাছাইপর্বে এর আগের সাত ম্যাচেই দেখা যায়নি। কোচ আলবার্তো পেরেইরার সঙ্গে ঝামেলা করে যিনি জাতীয় দলে মোটামুটি ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন। সেই রোমারিও ম্যাচের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, উরুগুয়েকে তিনি উড়িয়ে দেবেন। রোমারিও কথা রেখেছিলেন। সেদিন ব্রাজিল জিতেছিল ২-০ গোলে, দুটো গোলই এসেছিল তার পা থেকে। সেই দুই গোলে ভর করে ব্রাজিল কেটেছিল আমেরিকার টিকেট। পরে তো প্রায় একক নৈপুণ্যে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপটাও জিতিয়েছিলেন রোমারিও, জীবন্ত কিংবদন্তীর তালিকায় লিখেছিলেন নিজের নাম।
দুই
খেলোয়াড়ি জীবনে রোমারিও বেশ ঢাক-ঢোল পেটানো টাইপের মানুষ ছিলেন। মোশাররফ করিমের সেই অভ্যাস নেই, চুপচাপ তিনি নিজের কাজটা করে চলেন। স্বভাবে বৈপরিত্য থাকলেও, আশফাক নিপুণের পরিচালনায় হইচইয়ের ওয়েব সিরিজ মহানগরে তিনি যেন রোমারিও হিসেবেই আবির্ভূত হলেন। প্রায় 'ওয়ান ম্যান আর্মি' হয়ে টেনে নিয়ে গেলেন পুরো গল্পটাকে, সাড়ে তিন ঘন্টাজুড়ে পর্দায় দাপিয়ে বেড়ালেন, মুগ্ধ করলেন, আর জাগিয়ে তুললেন একরাশ আফসোসও। এই মানুষটাই কেন... থাক, আজ আর সেসবে না যাই, মহানগরে থাকি।

ওসি হারুন, স্বভাবে অসৎ, কিন্তু নিজের কাজটা খুব ভালো বোঝেন। বাকিরা যদি ডালে ডালে চলে, তিনি চলেন পাতায় পাতায়। অসম্ভব কনফিডেন্ট, স্মার্ট, এবং নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল একটা চরিত্র। আশফাক নিপুণ অসম্ভব যত্ন নিয়ে ওসি হারুনের চরিত্রটাকে তৈরি করেছেন, তার সংলাপে এনেছেন অভিনবত্ব। সম্ভবত বাংলা নাটক বা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেই নেগেটিভ শেডের কোন ক্যারেক্টারকে এত নিখুঁতভাবে পোর্ট্রে করা হয়নি আজ পর্যন্ত।
সেই চরিত্রটাকে কি অদ্ভুত দক্ষতায় পর্দায় ফুটিয়ে তুললেন মোশাররফ করিম! মনের ধূর্ততা যেন পুরোটা সময় জুড়ে খেলা করলো তার চোখে, যে চোখ দেখে সত্যিটা আন্দাজ করা যায় না; বোঝা যায় না, এই মানুষটার ভেতরে আসলে কি চলছে! তার শঠতা, তার কপটতা দেখে মানুষটার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নিচ্ছে, তাকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে- দর্শক হিসেবে কাউকে এমন অনুভূতির মুখোমুখি করতে পারাটা একজন অভিনেতার সবচেয়ে বড় সার্থকতা। ওসি হারুনের চরিত্রে মোশাররফ করিম সেই মিশনে শতভাগ সফল।
পর্দাজুড়ে দারুণ সব অভিনেতার উপস্থিতি, কখনও লুৎফর রহমান জর্জ, কখনও শাহেদ আলী, কখনও শ্যামল মাওলা, মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, খায়রুল বাশার বা মম। কিন্তু তাদের সামনে মোশাররফ করিম সূর্যের মতো জ্বলেছেন শুরু থেকে শেষ অব্দি। নিজের জাত অভিনেতার স্বরূপটা উন্মোচন করেছেন পুরোপুরি। যেন দর্শককে আহবান জানিয়েছেন- 'এসে দেখো, আমি কি করতে পারি!' মোশাররফ করিম যেন ডন ব্র্যাডম্যান হয়ে গেলেন কয়েক ঘন্টার জন্য। ক্যারিয়ারজুড়ে ব্র্যাডম্যান যেভাবে নিজের দলকে টেনে নিয়েছেন ব্যাট হাতে, উপহার দিয়েছেন উত্তুঙ্গ পারফরম্যান্স, মোশাররফ করিমও সেটাই করলেন মহানগরে।

ওসি হারুন সম্ভবত মোশাররফ করিমের ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা রোল। ছোটখাটো একটা মানুষ, অথচ আশেপাশের পরিবেশের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। যখন ঘটনার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে, তখন তিনি যেমন দোর্দন্ড প্রতাপশালী, ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদের ফোন পেয়ে কাঁচুমাচু করে কথা বলার মুহূর্তগুলোতেও তিনি যেন অসম্ভব ধুরন্ধর। আইনের রক্ষকের পোশাক পরে ভক্ষক হবার সময়গুলোতেও তিনি দারুণ একটা সম্মোহনী ক্ষমতা নিয়ে আকর্ষণ করেন সবাইকে। আবার তার চরিত্রের একদম আলাদা একটা দিক প্রকাশিত হবার মুহূর্তেও তিনি যেন অদ্ভুত একটা মায়াডোরে বেঁধে ফেলেন দর্শককে, তার জন্য বুকের ভেতর কোথাও যেন বিষাদের সুর বাজে।
এতগুলো শেড, চরিত্রের নানামুখী চড়াই উৎরাইগুলো নিয়ন্ত্রণ করাটা খুব কঠিন। মোশাররফ করিম সেটা অবলীলায় করেছেন। পর্দায় চিরচেনা মোশাররফ করিম একটা মুহূর্তের জন্যেও ছিলেন না, ওসি হারুনকেই পাওয়া গেছে আদ্যোপান্ত। যখনই তিনি মুখ খুলেছেন, ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট তৈরি হয়েছে। একটা পর্যায়ের পর তো তার মুখে 'দুইটা জিনিস মনে রাখবা...' শুনলেই আগ্রহ বেড়ে গেছে, এবার তিনি কি বলবেন এটা ভেবে।
তিন
মহানগর রিলিজের আগে হইচই তাদের প্রচারণায় মোশাররফ করিমকে 'কিংবদন্তী অভিনেতা' হিসেবে উল্লেখ করেছিল। সেটি নিয়ে অহেতুক বিতর্কও হয়েছিল খানিকটা। যদিও মোশাররফ করিম নিজে এই বিতর্ক নিয়ে মুখ খোলেননি, তিনি কেবল ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কাজটাই করে গেছেন, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও ফোকাসটা নড়ে যেতে দেননি একটুও। সেই কাজ দেখার পর তাকে 'কিংবদন্তী' খেতাব দিতে চাওয়া দর্শকের পাল্লাই ভারী হবার কথা।
মহানগর দিয়ে মোশাররফ করিম অভিনয়ের একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিলেন, নিজের জন্যে তো বটেই, অন্য অভিনেতাদের জন্যেও। আয়নাবাজিতে যেমনটা করেছিলেন চঞ্চল চৌধুরী, অজ্ঞাতনামায় যেটা করেছিলেন ফজলুর রহমান বাবু। এই স্ট্যান্ডার্ডটা ছোঁয়া যে কোন অভিনেতার জন্যেই চ্যালেঞ্জিং। মেথড অ্যাক্টর না হলে সম্ভব নয় কারো পক্ষে। এই স্ট্যান্ডার্ড মোশাররফ করিম ধরে রাখবেন, বাকিরাও তাকে ছোঁয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, দর্শক হিসেবে এটাই চাইবো সবসময়।