মৃগয়া: যে সিনেমাটি পাল্টে দিয়েছিল মিঠুন চক্রবর্তীর জীবন
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সাংবাদিকরা মিঠুনকে জানালেন, 'আপনি মৃগয়ার জন্য বেস্ট অ্যাক্টরের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।' মিঠুনের তখন এতই অভাব যে তিনি তাদের বললেন, 'আমার অ্যাওয়ার্ড লাগবে না। আমাকে কিছু খাবার দিন...'
সাল- ১৯৭৫, স্থান- FTII (এফটিআইআই- ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট, ইন্ডিয়া)
পরিচালক মৃণাল সেন এফটিআইআইতে গেছেন একদিন। দিনটি অন্যান্য দিনের চেয়ে স্পেশাল ছিল। বেশ কিছু স্টুডেন্ট সিনেমা নিয়ে অনেক বছরের পড়াশোনার পর নিজেদের ডিপ্লোমা ডিগ্রি গ্রহণ করছিল সেদিন। বেশ একটা ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ এবং একই সাথে কিছুটা আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান বলা যায়। এতসব স্টুডেন্টদের মাঝখানে একটা ছেলে মৃণাল সেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার কারণ ছিল।
একমাত্র এই ছেলেটা সেখানকার উপস্থিত সকল মেয়ের সাথে বেহায়ার মত ফ্লার্ট করে যাচ্ছিল। একটা ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদানের অনুষ্ঠানে এসব করা যায় কিনা- এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই! সেখানে অনেক রথী মহারথীদের উপস্থিতি- সে ব্যাপারে সেই ছেলের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। মৃণাল সেন বিশ্বাস করতেন, একজন ভাল অভিনেতার অন্যতম গুণ হল তাকে সব বিষয়ে ওপেন হতে হবে আর যেকোনো ব্যাপারে কোন ধরনের ইতস্ততবোধ ছাড়াই বেহায়ার মত নিজের কাজটা করে যেতে হবে। হয়ত এই কারণেই শ্যাম বর্ণের সেই ছেলেটা সেদিন মৃণাল সেনের মাথায় স্থায়ী ছাপ রেখে গেলেন।
দুই বছর পরের কথা। মৃণাল সেন তার নতুন সিনেমার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মেইন রোলে কাকে নেবেন- ভাবতেই তার সেই দুই বছর আগের লম্বা, শ্যাম বর্ণের পেশীবহুল ছেলেটার কথা মনে পড়লো। তার মনে হয়েছিল, তার এই সিনেমার জন্য এরকম একজন রাফ এন্ড টাফ ছেলেই পার্ফেক্ট। মৃণাল সেন লম্বা এক চিঠি লিখলেন সেই ছেলেকে উদ্দেশ্য করে আর নিজের ক্যামেরাম্যান মহাজনকে পাঠালেন এই চিঠি দিয়ে সেই ছেলের খোঁজ করতে।
তিনদিন পর সেই ছেলে মৃণাল সেনের কাছে এলো। মৃণাল সেনের কাছে এসে সেই ছেলে কিছুটা গলাবাজি করা শুরু করল।
"আর বলবেন না মশাই! হেলেনের সাথে কয়েকটা শোতে নাচতে হচ্ছিল আমাকে। তাই আপনার চিঠি পড়ে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। আসলে সবাই আমার নাচ এত পছন্দ করে, আমাকে ছাড়তেই চায় না!"
মৃণাল সেন এইসব আলাপ শুনে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। একটা পর্যায়ে বলে বসলেন- আর একবার এই ধরনের আলাপ করলে আমি আমার সিনেমা থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব তোমাকে!
শ্যাম বর্ণের ছেলে চুপসে গেল। চুপচাপ এরপরে পরিচালকের কথা শুনে গেল বাধ্য ছেলের মতো। সিনেমায় কাজ করতে রাজি হলো। তবে একটা জায়গায় বেঁকে বসলো। সিনেমার জন্য লম্বা চুল কাটতে হবে। নিজের লম্বা চুল সেই ছেলের খুবই পছন্দের। পরিচালক নিজের জায়গায় অটল- ঐ চুল আমার ক্যারেক্টারের জন্য না। অবশেষে সেই ছেলে হার মানলো আর চুল কাটার শর্ত মেনে নিয়ে সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হল।
শ্যাম বর্ণের সেই ছেলের নাম ছিল মিঠুন চক্রবর্তী আর সেই সিনেমার নাম ছিল মৃগয়া। বেস্ট এক্টর আর বেস্ট ফিচার ফিল্মের ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছিল এই সিনেমা।
এই সিনেমায় কাজের ব্যাপারে পরবর্তীতে মিঠুন বলেছিলেন- লাক জিনিসটা সবচেয়ে জরুরি মিডিয়াতে কাজ পাওয়া আর টিকে থাকার জন্য। আপনার কাছে এক সমুদ্র পরিমাণ ট্যালেন্ট থাকলেও লাভ নেই যদি না লাক সেই ট্যালেন্টের সাথে বন্ধু হয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটে। আমি বিশ্বাস করি আমার ট্যালেন্ট ছিল তবে মৃণাল সেন আমাকে এই রোল অফার না করলে অন্যান্য স্ট্রাগলারদের ভীড়ে আমিও ইজিলি হারিয়ে যেতাম। আমার রোলটা ঠিকঠাকভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য মৃণাল সেন আমাকে যা বলেছিলেন, আমি তাই করেছিলান। তালডাঙ্গা নামে যে গ্রামে সিনেমার কিছু অংশের শুটিং হয়েছিল, সেই গ্রামের আদিবাসীদের সাথে আমি এক মাসেরও বেশি সময় থেকেছিলাম শুধুমাত্র তাদের ম্যানারিজম আয়ত্ত্ব করার জন্য।
এতকিছুর পরেও, এই সিনেমা এত প্রশংসা পাওয়ার পরেও, আমি ন্যাশনাল এওয়ার্ড পাওয়ার পরেও আমার কাজ পেতে কষ্ট হচ্ছিল। সাংবাদিকরা আমাকে যখন আমার বাসায় এসে জানালেন- আপনি মৃগয়ার জন্য বেস্ট এক্টরের এওয়ার্ড পেয়েছেন, আমার তখন এতই অভাব চলে যে আমি তাদের বললাম- আমার এওয়ার্ড লাগবে না। আমাকে কিছু খাবার দেন।
ঐ যে বললাম- লাক। লাক না থাকলে বাকিসব বৃথা। তবেও এটাও বিশ্বাস করি- পরিশ্রম করে গেলে একদিন না একদিন ভাগ্যবিধাতা আপনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হলেও হাসবেন!
১৯৭৬ সালের আজকের দিনে মুক্তি পায় মৃগয়া। এই সিনেমা দেখার পর আর এই সিনেমার হিরো মিঠুন চক্রবর্তীর অন্যান্য সিনেমা দেখার পর রাজস্থানে জন্ম নেয়া এক ছেলে তার মত চুল বড় রাখা শুরু করেন। কারণ তার বন্ধুরা তাকে বলত- এই, তোর চেহারা দেখতে অনেকটা মিঠুনের মত। ওর মত বড় চুল রাখলে তোকে হেব্বি মানাবে।
মিঠুনকে দেখে বড় চুল রাখা আর পরবর্তীতে অনেক বড় এক অভিনেতা হওয়া সেই মানুষের নাম ইরফান খান। তার গল্প আরেকদিন হবে...