মুন্সিগিরি: জটিল রহস্য, সরল পুলিশ ও কিছু মানবিক গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

সব মিলিয়ে মুন্সিগিরি' বেশ উপভোগ্য এক গল্প। থ্রিলারের মধ্যে থেকেও একটু অন্য ঘরানার গল্প। 'মাসুদ মুন্সি' নামক চরিত্রটি যেমন ব্যক্তিগত-পেশাগত জীবনের নিয়ন্ত্রণ টানতে ব্যর্থ হয়ে ক্রমশ 'দ্য ফ্যামিলি ম্যান' এর শ্রীকান্ত তিওয়ারিকে মনে করাবে, তেমনি, এ ওয়েব ফিল্মের ক্লাইম্যাক্স জরাসন্ধের 'লৌহকপাট'কেও মনে করাবে...
কোমরে পিস্তল এবং হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে যে মানুষটিকে সারাদিন রহস্যের খাসমহলের মধ্যে খাবি খেতে হয়, চোখ দেখেই যে মানুষটিকে অকপটে অপরাধীর দুরভিসন্ধি পড়ে নিতে হয়, দাগী আসামীদের রোষানলের মুখে পড়ার শিরশিরে শঙ্কাকে উপেক্ষা করে যে মানুষকে দৌড়াতে হয় এ অন্ধকার থেকে সে অন্ধকার- সে মানুষটিরও নিশ্চয়ই এক স্বাভাবিক জীবন আছে। অভিমানী স্ত্রী'র মান ভাঙ্গানোর জন্যে শাড়ি কেনা আছে। বাজারে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে আলু-পটলের দরদাম করা আছে। ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি আছে। পর্দার সামনে রহস্য-খুন-রক্তপাতের ঠিক পেছনে এই মানুষের এই ভীষণ আটপৌরে গল্পগুলো কেউ কি বলেছে কখনো?
নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সাম্প্রতিক নির্মাণ 'মুন্সিগিরি' ওয়েব সিরিজ শুরু হয় এমনই একজন গড়পড়তা মানুষ এবং তার গড়পড়তা জীবনের কিছু গল্পের সুলুকসন্ধান দিয়ে। যাকে ঘিরে গল্প, তিনি ডিবির এডিসি। নাম- মাসুদ মুন্সি। অফিসের হাজার বায়নাক্কা সামলেও যাকে ঘরের দায়িত্ব পালন করতে হয় প্রতিদিন। ঘরের দায়িত্বে তিনি অসফল। কর্মক্ষেত্রেও যে খুব সফল, তাও বলা যাবে না। তিনি গোয়েন্দা পুলিশ, কিন্তু অতটা ক্ষুরধার মস্তিষ্কও নেই তার। ফেলুদার মতন তার মগজাস্ত্র সূঁচালো না। 'শার্লক হোমস' এর মতন এক দৃশ্য দেখেই তিনি একগাদা ডিটেইলস খুঁজে বের করতে পারেন না। প্রযুক্তির লুকোচুরিতেও অতটা সড়গড় নন তিনি। তিনি বলেন-
টেকনোলজি ব্যবহার কইরা আসামীর পেছনে পেছনে দৌড়ানো...নিজেরে কেমন যেন ধইঞ্চা মনে হয়।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত কোনো মানুষ যদি প্রযুক্তি নিয়ে এরকম মন্তব্য করেন, তাহলে তার যোগ্যতা নিয়ে সংশয় হয়। যেটা শুধু দর্শকের না। খোদ ডিবি অথোরিটিরও হয়। মাসুদ মুন্সি তাই চাঞ্চল্যকর কেস খুব একটা পান না। পাতি গুণ্ডাদের পেছন দৌড়াদৌড়িতেই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় অধিকাংশ সময়। আর বাদবাকি সময় বরাদ্দ থাকে সহকর্মীদের সাফল্য দেখে চুপসে যাওয়ায়।
'মুন্সিগিরি'তে 'মাসুদ মুন্সি'র ক্যারেক্টার শুরু থেকেই এমনভাবে ডেভেলপ করা হয়, তাকে নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে না৷ ঈষৎ স্থুল দেহ, প্রাচীন চুলের কাট এবং অপরাধী ধরার আদ্যিকালের ফরম্যাট অনুসরণ করা মানুষটিকে মনে হয় টাইপরাইটারের মতোন। বেমানান। শুরু থেকেই তাই ভেতরে একটা প্রশ্ন ক্রমশ ঘুরপাক খায়, এই মানুষটিই যদি গল্পের প্রোটাগনিস্ট হয়, তাহলে গল্পের ভবিষ্যৎ কী?

যাই হোক, গল্প এগোয়। মাসুদ মুন্সি আচমকাই পেয়ে যান তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর কেস। কেসটির সারসংক্ষেপ অনেকটা এরকম- রেললাইনে পাওয়া গিয়েছে এক লাশ। যে লাশের সাথে সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন লেখকের। এই রহস্যময় লাশের সাথে যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে দুটি বিশেষ বইয়েরও। এখানেই শেষ না। লাশের সাথে সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে বেশ ক'জন মানব-মানবীরও।
মাসুদ মুন্সি কেস পাওয়ার পর শুরু করেন একেবার গোড়া থেকে। অর্থাৎ রেললাইনে লাশপ্রাপ্তির স্থান থেকে শুরু হয় 'সূক্ষ্ম সাল শস্য' কিংবা অনুসন্ধান। ক্রমশ গল্পে ডালপালা গজায়। গল্পের মূলস্রোতে একাধিক চরিত্র, ঘটনা, সাসপেন্স যুক্ত হয়। যে গল্প শুরু হয়েছিলো ছোটখাটো এক প্রেক্ষাপটে, সে গল্প ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে গভীর থেকে গভীরতর সব স্থানাঙ্কে। সেইসব স্থানাঙ্ক ঠিক কীরকম? জানা যাবে গল্পে।

প্রথমেই বলে রাখি, প্রখ্যাত লেখক শিবব্রত বর্মণের উপন্যাস 'মৃতেরাও কথা বলে' বেশ জটিল গোছের কোনো উপন্যাস না। এই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত 'মুন্সিগিরি'র রূপান্তরও বেশ ছিমছাম৷ গল্প শুরু থেকে যেভাবে এগিয়েছে কিংবা খুব ঝাপসা এক গল্প ক্রমশ যেভাবে স্পষ্ট হয়েছে দর্শকের সমুখে, তাতে নির্মাতার মুন্সিয়ানা বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্যণীয়। কোনো সেকেন্ডেই অধৈর্য হয়ে উশখুশ করার সুযোগ নেই অতটা। কিন্তু এখানে সতর্কতাও আছে খানিকটা। আগেই বলেছি গল্প জটিল না। কিন্তু এই অ-জটিল গল্পেও কিছু জটিল দৃষ্টিবিভ্রম আছে। দর্শককে তাই একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করতে হবে কাহিনীর পরম্পরা। নাহয় শেষে এসে মেলাতে গিয়ে খানিকটা বেগ পেতে হতে পারে। তাছাড়া দেড় ঘন্টায় গল্প শেষ করতে গিয়ে নির্মাতাকে শেষদিকে এসে খুব তাড়াতাড়ি অনেককিছুর মীমাংসা করতে হয়েছে। সেক্ষেত্রেও তাই কাহিনীর প্যাঁচ ধরার জন্যে অতিরিক্ত মনোযোগের বিকল্প নেই।
অভিনয়ে চঞ্চল চৌধুরী বরাবরই দারুণ। শুরুতেই তার উপর দর্শকের অনাস্থা থেকে যে গল্পের যাত্রা শুরু, পরবর্তীতে সেই তিনিই যখন প্রোটাগনিস্ট হয়ে দর্শকের আস্থা অর্জন করে নিচ্ছেন... এই প্যারাডাইম শিফটের জন্যে 'মাসুদ মুন্সি'রূপী চঞ্চল চৌধুরী আলাদা ধন্যবাদ অবশ্যই পাবেন। 'মাসুদ মুন্সি'র স্ত্রী 'পারভীন' চরিত্রে শবনম ফারিয়াও সপ্রতিভ। আলাদাভাবে মুগ্ধ করেছেন 'সুরাইয়া' চরিত্রে পূর্ণিমা। জীবনযুদ্ধে পোড় খাওয়া এক নারীর যে সংগ্রাম-লড়াই, তা চাহনি-কথাবার্তা-ব্যক্তিত্বে স্টাবলিশ করার যে জটিল পদ্ধতি, তার পুরোটুকুই করেছেন এই অভিনেত্রী। স্ক্রিপ্টে খুব বেশি জায়গা পান নি তিনি। কিন্তু যতটুকু পেয়েছেন, ছাড় দেননি একটুও। বাকিরাও ভালো। গাজী রাকায়েত, শহিদুজ্জামান সেলিম, ইমতিয়াজ বর্ষণ কিংবা অন্যরাও প্রাসঙ্গিক। সাবলীল। খারাপ বলার সুযোগ নেই।

'মুন্সিগিরি'র গল্প, অভিনয়, স্টোরি টেলিং কিংবা ক্যামেরার কাজ... সবই ভালো। খামতি শুধু দৈর্ঘ্যে। সিনেমার দৈর্ঘ্য আরেকটু বাড়লে পুরোপুরি তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যেতো। তবে তা যেহেতু হয়নি, সে প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। এটুকু বাদ দিলেও 'মুন্সিগিরি' বেশ উপভোগ্য এক গল্প। থ্রিলারের মধ্যে থেকেও একটু অন্য ঘরানার গল্প। 'মাসুদ মুন্সি' নামক চরিত্রটি যেমন ব্যক্তিগত-পেশাগত জীবনের নিয়ন্ত্রণ টানতে ব্যর্থ হয়ে ক্রমশ 'দ্য ফ্যামিলি ম্যান' এর শ্রীকান্ত তিওয়ারিকে মনে করাবে, তেমনি, এ ওয়েব ফিল্মের ক্লাইম্যাক্স জরাসন্ধের 'লৌহকপাট'কেও মনে করাবে। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার।
শেষে এসে তাই এটাই বলার, কেউ যদি ছিমছাম গোছের এক থ্রিলার দেখতে বসতে চান, তাদের জন্যে অবশ্যই এই ওয়েব ফিল্ম রেকোমেন্ডেড। সময় ভালো কাটবে। কিন্তু যারা ক্ষণেক্ষণে টুইস্ট পেতে চান কিংবা হিচককীয় ক্লাইম্যাক্সে চক্ষু চড়কগাছ করতে চান, তাদের জন্যে এ নির্মাণ না। তাই আগে থেকেই প্রত্যাশার পারদ মনুমেন্টের ডগায় না নিয়ে যাওয়াটাই হবে প্রাসঙ্গিক।
আশা থাকবে, নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী 'মুন্সিগিরি'র দ্বিতীয় কিস্তি নিয়ে খুব তাড়াতাড়িই হাজির হবেন। সেজন্যেই অপেক্ষা। সে সাথে, পরবর্তী পর্বের জন্যে আগাম শুভকামনা।