
মিতভাষী এই গুণী শিল্পী আরো কাজ পান, আমরা সে প্রত্যাশাই করি। পর্দায় তাঁর যে সদর্প উপস্থিতি, তা ক্রমে ক্রমে ছাড়িয়ে যাক দেশ-বিদেশের যাপিত গণ্ডি। ফলে তো বটেই, মানুষ বৃক্ষকেও চিনুক একনামে...
'এমন ক্যারেক্টারই করতে চাই, যে, লোকে যেন শেষমেশ আমাকে চিনুক আর না চিনুক, আমার চরিত্রটিকে চেনে'
উপরের কথা কয়টি এমন একজন মানুষের, যার সাম্প্রতিক কাজ নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম 'হৈচৈ'তে আসা 'মহানগর' সিরিজে মোশাররফ করিমের দোর্দণ্ড অভিনয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষটি সঙ্গত দিয়েছেন তার নিজের চরিত্রটিকে। সিরিজটি শুরুই হয় যার 'হ্যালো, আমরা স্পটের কাছাকাছিই আছি, খবর সলিড তো' ডায়লগ দিয়ে৷ যারা আশফাক নিপুণের এই নির্মাণটি দেখেছেন, এতক্ষণেই হয়তো বুঝে ফেলেছেন কার কথা বলা হচ্ছে ৷ হ্যাঁ, এস আই মলয় এর কথাই বলছি। যে চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে মোস্তাফিজুর নূর ইমরান এখন আলোচনার মধ্যমণি। ব্যক্তি মোস্তাফিজুর নূর ইমরানে পরে আসা যাবে৷ আগে আসি 'মলয়' এর সুরতহালে।

'মহানগর' এর 'মলয়', পূতিগন্ধময় সিস্টেমের মধ্যে থাকা এক সৎ পুলিশ অফিসার৷ যার ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু যিনি এই সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও চেষ্টা করেন মানুষকে আগলে রাখতে৷ মানুষকে রক্ষা করতে। তবে তাই বলে যে তিনি অতীব শক্তিমান হয়ে যান সময়ে সময়ে, তা না৷ তিনি রক্তমাংসেই সীমাবদ্ধ৷ তার চৌহদ্দিও সুনির্দিষ্ট। সে চৌহদ্দির বাইরে পা বাড়ানোর দুঃসাহস তিনিও করেন না। পরিচালক যা ভেবেই এই 'এসআই মলয়' চরিত্রটিকে তৈরী করে থাকুন না কেন, এই চরিত্রটির রূপান্তর হয়েছে খুবই প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত। 'মহানগর' এ মোশাররফ করিমের ওরকম সর্বগ্রাসী অভিনয়ের পরেও তাই 'এসআই মলয়' চরিত্রকে ঠিক মুছে ফেলা যায় না। চরিত্রটির স্ক্রিনটাইম কম, আরো অজস্র কুশীলবের ভীড়ে তাকে সেভাবে মনে রাখার কোনো কারণও নেই, কিন্তু তাও তিনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন মস্তিষ্কের 'স্মৃতিদরজা'র ঠিক মুখে। পুলিশের উর্দি আর সিরিয়াস এক চেহারা নিয়ে৷

ঠিক এখানেই মোস্তাফিজুর নূর ইমরানের সার্থকতা। যিনি নিজের নাম নিয়ে চিন্তিত নন মোটেও, যিনি নিজের চরিত্র নিয়ে চিন্তিত। যিনি হয়তো সেই প্রবাদবাক্যকেই বিশ্বাস করেন- 'বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়'। হৈচৈ এর আগের কিছু ওয়েব সিরিজেও ছিলেন তিনি। 'একাত্তর' ওয়েব সিরিজে তার অভিনয় দেখে মুগ্ধও হয়েছিলাম। ইরেশ যাকের, তিশা, মিথিলা'র মতন অভিনয়শিল্পীদের পাশে আলাদা করে সেখানে নজর কেড়েছিলেন তিনিও। অবশ্য কোনো একটা চরিত্রে অভিনয়ের আগে যেভাবে মনপ্রাণ দিয়ে খাটেন, সে খাটুনি-লব্ধ পরম যত্নের অভিনয় দর্শককে আলোড়িত যে করবে, এতে আর আশ্চর্য কী!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও নাট্যতত্ত্বে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। থিয়েটারের নেশা অনেকদিন ধরেই। কিভাবে থিয়েটারের নেশায় মজে গেলেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। তবে তার নানা, মনসুর আলী পাইক ছিলেন তাদের বাগেরহাট অঞ্চলে অভিনয়ের একজন পথিকৃৎ। তাই বললে অত্যুক্তি হয় না, ইমরানের রক্তেই ছিলো থিয়েটার আর অভিনয়ের তীব্র টান! পরবর্তীতে যোগ দেন বাগেরহাট থিয়েটারে। থিয়েটারের বিভিন্ন শো'তেও দেখা যায় তাকে৷ যখনই যে চরিত্রে অভিনয় করেন, সে চরিত্রে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ একাত্তরের আর্মি অফিসার 'সিরাজ' অথবা 'মহানগর' এর 'এস আই মলয়' অথবা 'আলফা'র সেই 'কালি হিজরা'- একেক নির্মাণে ভিন্ন ভিন্ন সব অবতারে এসেছেন তিনি। অথচ কোনো চরিত্রই মিলে যায় না আগেরটির সাথে। আলাদা আলাদা দ্যোতনায় আচ্ছন্ন থাকে। টিপিক্যাল অভিনয়ের একঘেয়ে আবর্তে থাকতে চান না তিনি, আটকে যান নি তাই এখনও।

বাংলাদেশের শিল্পমাধ্যম এখন গুণী মানুষদের চিনছে। তাই ইমরান হাতে কাজ পাচ্ছেন একের পর এক। তিনি কাজ করছেনও, কিন্তু রয়েসয়ে৷ কারণ তিনি কাজে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে একটু ফুরসতও চান কাজের স্রোত থেকে। করার জন্যে করা না, ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান নির্মাণের চরিত্রকে। সে জন্যেই তার চেষ্টা ও ছুটে চলা নিরন্তর৷ স্মিতভাষী এ গুণী শিল্পী আরো কাজ পান, আমরা সে প্রত্যাশাই করি। পর্দায় তাঁর যে সদর্প উপস্থিতি, তা ক্রমে ক্রমে ছাড়িয়ে যাক দেশ-বিদেশের যাপিত গণ্ডি। ফলে তো বটেই, মানুষ বৃক্ষকেও চিনুক একনামে। মানুষ জানুক মোস্তাফিজুর নূর ইমরানকে। শুভকামনা নিরন্তর।