এত পরিশ্রম, এত আয়োজন, তিন ঘন্টা বসিয়ে রাখার মত চিত্রনাট্য, অনিল কাপুর থেকে শুরু করে অমরেশ পুরি, পরেশ রাওয়াল সবার দুর্দান্ত অভিনয়, বিশাল সেট ডিজাইন, চমৎকার মিউজিক,বিশাল বাজেট- এতকিছুর পরেও সিনেমাটি বক্স অফিসে ফ্লপ হয়েছিল। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে...

জি সিনেমা দেখেছেন, আর এই সিনেমা দেখেননি- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। 

১৯৯৪ সালে রামগোপাল ভার্মা 'নায়ক' নামে সঞ্জয় দত্তকে নিয়ে একটি সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন, সেই সিনেমা আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে দেখেছিল একই নামে আরেকটি সিনেমা, সেটি নিয়েই আজকে আলাপ করব।

ডিরেক্টর শংকর সাউথ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিতে ততদিনে খুবই বিখ্যাত ডিরেক্টর, কিন্তু বলিউডে সেভাবে কেউ তাকে চিনতো না। তিনি চাচ্ছিলেন বলিউডে তার অভিষেকটা খুব জমকালোভাবেই হোক। এই কারণে 'নায়ক' সিনেমাটা তিনি খুব জোরেশোরেই কাজ করতে চেয়েছিলেন। নিজের কন্টেন্টের উপরে জোর বিশ্বাস থাকার পরেও তিনি কোন স্টার বা সুপারস্টারকে চাচ্ছিলেন নিজের সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য। এজন্যই প্রথমে আমির খানকে এপ্রোচ করেন। কিন্তু যে তামিল সিনেমা থেকে নায়ক সিনেমাটি রিমেক করা হচ্ছিল, সেটির ব্যাপারেই আমিরের বেশ কিছু ইস্যু ছিল। তাই নায়ক সিনেমাকে তিনি আর হ্যাঁ বলেননি। 

ডিরেক্টর এরপরে গেলেন শাহরুখের কাছে। শাহরুখ খুবই আগ্রহী ছিলেন, তবে সেই সময়ে নিজের প্রোডাকশন হাউজ থেকে নির্মিত ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্থানিতে রিপোর্টার ক্যারেক্টর প্লে করার পরে আরেকবার নায়ক সিনেমাতে টিভি রিপোর্টার ক্যারেক্টর প্লে করতে চাচ্ছিলেন না তিনি এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। ফলে তার তরফ থেকেও শংকরকে শুনতে হলো- 'না'। 

প্রোডিউসার বনি কাপুর এরপরে ডিরেক্টরকে নিজের ভাইয়ের নাম সাজেস্ট করেন। শংকর শুরুতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না অনিল কাপুরকে কাস্ট করার ব্যাপারে, তবে শেষমেষ কাস্ট করেন। সিনেমার কাজ শেষে তিনি বলেছিলেন- অনিলের মত পাংচুয়াল আর্টিস্ট আমি আমার জীবনে কমই দেখেছি। এরকম পাংচুয়াল আর্টিস্ট শুধুমাত্র সাউথ ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা যায়। 

নায়ক সিনেমার একটি দৃশ্যে অনিল কাপুর ও পরেশ রাওয়াল

নিজের ক্যারেক্টর শিবাজি রাও প্লে করার জন্য অনিল কাপুর ছয় থেকে সাত মাসের জন্য বিশেষ শারীরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। টক শো উপস্থাপকের রোল ভালভাবে আয়ত্ব করার জন্য নিয়মিত ল্যারি কিং, রজত শর্মা ও আরও অনেকের টক শো দেখেছেন। পাঠকের উদ্দেশ্যে জানিয়ে রাখি, শিবাজি রাও সাউথ সুপারস্টার রজনীকান্তের আসল নাম। 

সিনেমাতে কিউ টিভি নামের যে চ্যানেলে অনিল কাপুর কাজ করেন, সেই চ্যানেলের সেট বানাতে ডিরেক্টর ৭০০ টিভি আর টিভি ক্যামেরা জোগাড় করেছিলেন। সিনেমার একটি দৃশ্যের প্রয়োজনে সবগুলো টিভি ও টিভি ক্যামেরাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হয়। 

কাদামাটি মাখা অনিল কাপুরের একশন দৃশ্যটির মত একশন দৃশ্য  তখন পর্যন্ত হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে হয়নি। এই থ্রিডি একশন দৃশ্যটি শুট করার জন্য ডিরেক্টর ৩৬ টি ক্যামেরা ব্যবহার করেন। অনিল কাপুর উদোম শরীরে এরকম একটি দৃশ্য করতে খুবই ইতস্ততবোধ করছিলেন। শংকর তাকে বলেন- 'দরকার পড়লে আমি সিনেমার হিরো চেঞ্জ করব, কিন্তু এই দৃশ্য বাদ যাবে না।' এরপরে অনিল বাধ্য ছেলের মত দৃশ্যটি করে ফেলেন। 

ব্যক্তিগতভাবে এই সিনেমাতে আমার পছন্দের দৃশ্য হচ্ছে, অনিল কাপুরের বাসায় বোমা বিস্ফোরণের পর তার বাবা মায়ের মৃত্যু। ঐ দৃশ্যে অনিল কাপুরের অসহায়ত্ব দেখে প্রতিবার আমার চোখ ভিজে যায়। চোখের সামনে বাবা মায়ের মৃত্যু এভাবে দেখাটা কোন আদম সন্তানের পক্ষে সহ্য করা কঠিন।

কাদামাখা শরীরে বিখ্যাত সেই অ্যাকশন সিকোয়েন্স

এত পরিশ্রম, এত আয়োজন, তিন ঘন্টা বসিয়ে রাখার মত চিত্রনাট্য, অনিল কাপুর থেকে শুরু করে অমরেশ পুরি, পরেশ রাওয়াল সবার দুর্দান্ত অভিনয়, বিশাল সেট ডিজাইন, চমৎকার মিউজিক,বিশাল বাজেট- এতকিছুর পরেও সিনেমাটি বক্স অফিসে ফ্লপ হয়েছিল। এর কারণ আজও অজানা। সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমার স্টাইলে একশন দৃশ্য হয়ত হিন্দি সিনেমার অডিয়েন্স নিতে পারেনি- এটা একটা কারণ। 

তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, ২০ বছর আগে ৭ সেপ্টেম্বর সিনেমাটি রিলিজের চার দিন পরে দুনিয়া কাঁপানো একটা ঘটনা ঘটেছিল, আর সেটা হচ্ছে আমেরিকায় নাইন ইলেভেনের হামলা। এই ঘটনার সামনে দুনিয়ার কোন সুপারস্টার বা তার সেরা সিনেমার টিকতে পারার কথা না, কারণ সারা দুনিয়াতে তখন শুধু একটাই আলাপ- নাইন ইলেভেন। 

এতকিছুর পরেও সিনেমাটা প্রচন্ড পছন্দের। এক জি সিনেমায় এই সিনেমা যে পরিমাণে  প্রচারিত হয়েছে, তাতে টিভি রাইটস থেকে এই সিনেমার একটা লেভেলের লাভ উঠে গেছে। 

বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আশেপাশে একের পর এক দুর্নীতি দেখে আমাদের বেশিরভাগেরই কোন না কোনদিন একবার ইচ্ছে হয়- ইশ! একদিনের জন্য আমাকে ক্ষমতা দিলে দেখায়া দিতাম দেশ কীভাবে চালাতে হয়! ২০ বছর পর এখনও সিনেমাটা এত ফ্রেশ লাগার হয়ত এটাও একটা কারণ!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা