এমনও হতে পারে আরো চার বছর আমি কোনো সিনেমাই করবো না। তারমানে এই না ভাল স্ক্রিপ্ট পেলে আমি প্রত্যাখান করবো। আসলে আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। এমন না যে, সিনেমা না করলে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। জীবনে করার মতো আরো অনেক কাজও তো থাকতে পারে, তাই না?
সিনেমা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন। ফিরবেন কিনা জানা ছিল না। তবুও তার ভক্ত এতটুকুও কমেনি। বরং, দিনে দিনে বেড়েছে বহু গুণ। কারণ, তিনি যে সিনেমাগুলোর অংশ হয়েছিলেন, যেসব সিনেমায় অভিনয় করেছেন, সেসব শুধু বক্স অফিসেই হিট ছিল তা নয়। সেসব সিনেমা মালায়ালাম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিরই সেরা মাস্টারপিসগুলোর তালিকায় থাকবে সবসময়। আর অল-টাইম হিটস সিনেমা উপহার দেয়া এই নায়িকাও থাকবেন দর্শকের কাছে অল-টাইম প্রিয় অভিনেত্রী, এমনটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই।
বলছি মালায়ালাম সিনেমাপ্রেমীদের অন্যতম এবং কারো কারো সবচাইতে প্রিয় অভিনেত্রী "দ্য এক্সপ্রেশন কুইন" নাজরিয়া নাজিমের কথা। এমনিতেই মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির বিশেষত্ব হচ্ছে খুব বাস্তবতা ঘেরা জীবনমুখী সিনেমা বানানো। এখানকার সিনেমা অলীক কোনো অবিশ্বাস্য অবাস্তব জগতের গল্প নয়। একদম চেনা কিছু গল্পের অসাধারণ উপস্থাপন যা দেখার পরে রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ। এখানে যারা অভিনয় করেন তাদেরও ন্যাচারাল সহজাত সৌন্দর্যটাই পর্দায় দেখানো হয়। আর এই ন্যাচারাল সৌন্দর্যের সংজ্ঞা যদি আপনি পেতে চান, তাহলে নাজরিয়া নাজিমের সিনেমার চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে!
ব্যাঙ্গালোর ডেইজ সিনেমায় প্রথম দেখি নাজরিয়া নাজিমকে। অনেক তারকার এই সিনেমায় সবার মতো নাজরিয়াও নিজের জাত চিনিয়েছেন। তবে সবচেয়ে মনে রাখার মতো ব্যাপার হলো রুপবতী এই অভিনেত্রীর এক্সপ্রেশন। এতো সুন্দর করে তিনি প্রত্যেকটা দৃশ্যের সাথে তাল মিলিয়ে অভিব্যক্তি দেন যে অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু এক্সপ্রেশন দেখলেও মন ভরে যাবে। আর এই কারণে সিনেমার গ্রুপগুলোতে বেশ ঝড় উঠে নাজরিয়া নাজিমকে নিয়ে। অনেকে শুধু এই অভিনেত্রীর জন্যই ভালবেসে ফেলে মালায়ালাম সিনেমা। কারো কারো কাছে নাজরিয়া নাজিম তাদের 'ক্রাশ'।
নাজরিয়া বিশ বছর বয়সেই বিয়ে করেন আরেক মালায়ালাম তারকা ফাহাদ ফাসিলকে। ভক্তরা এই বিয়ের খবরে খানিকটা মন খারাপ করেন। কারণ, বিয়ের পর নতুন কোনো সিনেমায় চুক্তি করেননি নাজরিয়া। দীর্ঘদিন তিনি এক প্রকার অবসরে ছিলেন। অনেকে ভেবেছে, এটা বুঝি স্বামীর মন রক্ষা করা সিদ্ধান্ত। কারো কারো মনে প্রশ্ন জমেছে, ফাহাদ ফাসিলই কি নাজরিয়াকে অভিনয় করতে দিচ্ছেন না?
কিন্তু, নাজরিয়া নিজেই এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করেন গণমাধ্যমে। বিয়ে এবং সিনেমার ক্যারিয়ার নিয়ে তিনি সেসময় কথা বলেছিলেন। নাজরিয়া-ফাহাদের বিয়ে এরেঞ্জড ম্যারেজ হলেও তারা একে অপরের প্রতি ভালবাসা উপলব্ধি করায় মূলত এই বিয়ে হয়। নাজরিয়া বলেন, "বিয়ের প্রস্তাবটা অনেকটাই গতানুগতিক বিয়ের মতোই হয়েছিল, আমরা প্রেমে পড়ি এবং আমাদের অভিভাবকদের কাছে বিয়ের সম্মতি চাই। যদিও আমি খুব বেশি কথা কথা বলিনি তার সাথে। (হাসি) কিন্তু, কোনোভাবে আমাদের ভালবাসাঅবাক হয়ে গিয়েছিল। আমি গাট ফিলিং থেকেই মনে করেছি যে, হ্যাঁ, সে আমার মানুষ।"
উল্লেখ্য, নাজরিয়া ব্যাঙ্গালোর ডেইজে ফাহাদের বিপরীতেই অভিনয় করেছিলেন। সেখান থেকেই প্রাথমিকভাবে নাজরিয়ার প্রতি স্পেশাল অনুভূতি তৈরি হয় ফাহাদ ফাসিলের। একদিন শুটিংয়ের ব্রেকে নাজরিয়া এবং ফাহাদ বসেছিলেন একটা রুমে। হঠাৎই নাজরিয়াই ফাহাদকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসেন, ফাহাদ কি তাকে বিয়ে করতে চায় কিনা? নাজরিয়া সারাজীবনের জন্য ফাহাদকে ভালবাসার দায়িত্ব নিতে চান! ফাহাদ তখন উপলব্ধি করলেন, তিনি আসলে নাজরিয়াতে মুগ্ধ এবং তাকে আসলেই চান।
এভাবে সরাসরি কথা বলাটা তার ভাল লেগেছে। তারপর পারিবারিকভাবেই বিয়ের আয়োজন হয়। তবে বিয়ের পর নাজরিয়া সিনেমা করতে পারবেন না এমন কোনো মানসিকতা দেখাননি ফাহাদ। বরং, ফাহাদ এমনও বলেছেন যখন নাজরিয়া কাজ করবেন তিনি রাজি আছেন ঘরের কাজে সাহায্য করতে! নাজরিয়া বলেন, "বিয়ের পর সিনেমায় কাজ করা নিয়ে ফাহাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু, আমি এখনি নতুন কোনো সিনেমায় চুক্তি করবো কিনা সিদ্ধান্ত নেইনি।"
এই সিদ্ধান্ত নিতে নাজরিয়ার লেগেছে চার বছর। চার বছরের সিনেমায় স্বেচ্ছা অবসর ভেঙ্গে নাজরিয়া এই বছরই আবার ফিরে আসেন অভিনয়ে। অঞ্জলি মেননের 'কুডে' নামক একটি সিনেমার মাধ্যমে আবারো দর্শকদের অপেক্ষার পালা ফুরিয়ে ফিরে আসেন তিনি। এবং যথারীতি এখানেও ফাটিয়ে দিয়েছেন, প্রশংসিত হয়েছে তার অভিনয়, সিনেমাটি পেয়েছে বক্স অফিস সাফল্য। তবে এর আগেই তিনি তার জাদুকরী অভিনয় স্বত্তা আর রুপের মোহনীয়তা দিয়ে অদ্ভুত আবেশে, আবেগে জড়িয়েছেন সিনেমাপ্রেমীদের। হয়ত এ কারণেই তার সিনেমা থেকে নেওয়া বিরতি কষ্ট দিয়েছে দর্শকদের।
নাজরিয়ার সিনেমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল শিশুশিল্পী হিসেবে। ২০০৬ সালে তার অভিনীত অভিষেক সিনেমাটির নাম পালুনকু (Palunku)। আর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তিনি মালায়ালাম সিনেমা জগতে পা রাখেন ২০১৩ সালে ম্যাড ড্যাড সিনেমা দিয়ে। তবে নায়িকা হিসেবে সিনেমায় আসবার আগে তিনি একটি ইসলামি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে কাজও করেছেন। ২০১৪ সালেই নাজরিয়া প্রাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। এবছর তিনি বেশ কয়েকটি সফল সিনেমায় কাজ করেন। ওম শান্তি ওশানা এবং ব্যাঙ্গালোর ডেইজ তার মধ্যে অন্যতম।
ব্যাঙ্গালোর ডেইজ সিনেমাটি তিন সমবয়সী কাজিনের গল্প। সেখানে নিভিন পৌলি, দুলকার ছিলেন নাজরিয়ার কাজিন। তাদের স্বপ্ন ছোটবেলা থেকে, তারা স্বপ্নের শহর ব্যাঙ্গালোর এক্সপ্লোর করবেন একদিন। সেই সুযোগ আসে নাজরিয়ার বিয়ের মাধ্যমে। তিন কাজিনের রিইউনিয়ন হয়। সিনেমায় নাজরিয়ার সাথে বিয়ে হয় ফাহাদের। নাজরিয়ার আর্টের শখ, মানুষের সাথে মেশার প্রবল ইচ্ছে। কিন্তু এসব পছন্দ করতেন না ফাহাদ। একটা টানাপোড়েন চলতে থাকে। এইদিকে তিন কাজিনের ভিন্ন ভিন্ন গল্প এগুতে থাকে। এতো অসাধারণ সিনেমা যে, এটি দেখবার পর এখনো সেই মুগ্ধতা রয়ে গেছে মনের মধ্যে৷
ওম শান্তি ওশানাতে নাজরিয়া নিজেকে অন্য লেভেলে নিয়ে যান। এতো সুন্দর এক্সপ্রেশন হতে পারে একজন নারীর যে ভাল না বেসে থাকা যায় না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেসব এক্সপ্রেশন কার হৃদয়কে নাড়া না দেবে! ওম শান্তি ওশানা দেখে যারা প্রেমের তথাকথিত সিনেমাকে অপছন্দ করেন তারাও হয়ত প্রেমে পড়ে যাবেন। কারণ, নাজরিয়ার সরলতা, অভিব্যক্তি, অভিনয়। এই দুটি সিনেমা তাকে কেরালা স্টেট এওয়ার্ড এনে দেয়।
মালায়ালাম সিনেমার হার্টথ্রুব কুইন হলেও নাজরিয়ার জন্মেছিলেন আরব আমিরাতে। সেখানে ইংরেজি মাধ্যমে একটি স্কুলে পড়াশুনা করতেন। পরে পুরো পরিবার ভারতে চলে আসায় এখানে নতুন জীবন শুরু হয় এই অভিনেত্রীর। চেয়েছিলেন বিজন্যাস নিয়ে পড়াশুনা করতে। কিন্তু, ২০১৩ সালে একটি কলেজে ভর্তি হয়েও লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি, সিনেমার তুমুল ব্যস্ততায়।
'কুডে' সিনেমা দিয়ে ফিরে আসার পর এখন নাজরিয়া নিয়মিত অভিনয়ে থাকবেন এমনটাই সবাই চায়। কামব্যাক সিনেমাটি দেখে সবাই আরো বেশি করে উপলব্ধি করেছে নাজরিয়া নাজিমের প্রয়োজনীয়তা। দুলকার সালমান সহ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সবাইকে নাজরিয়ার নতুন সিনেমার প্রশংসা করেছেন, নাজরিয়ার ফিরে আসায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
তবে নাজরিয়ার ভাবনারা খানিকটা উদাসীন হয়ত। তিনি বলেন, এমনও হতে পারে আরো চার বছর আমি কোনো সিনেমাই করবো না। তারমানে এই না ভাল স্ক্রিপ্ট পেলে আমি প্রত্যাখান করবো। আসলে আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। এমন না যে, সিনেমা না করলে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। জীবনে করার মতো আরো অনেক কাজও তো থাকতে পারে, তাই না?
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নিজের কোনো স্বপ্নের চরিত্র আছে কিনা যেখানে অভিনয় করতে চান। নাজরিয়া জানান, না নেই। কারণ, তারপর আপনি কি করবেন তাহলে? সিনেমাটাই একটা স্বপ্ন, এটাকে যদি আমি ভালবাসি তার মানে আমি প্রসেসটাকে ভালবাসি। অন্য কোনো কারণ, নেই। স্বপ্নের চরিত্রে অভিনয়ের চেয়ে প্রত্যেকটা ক্যারেক্টারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত যাতে এটাই স্বপ্নের চরিত্র হয়ে যায়, প্রসেস ঠিক থাকলে সেটা সম্ভব। নাজরিয়া এই থিউরিতে বিশ্বাসী। জীবনদর্শনে, সিনেম্যাটিক ভাবনায় মালায়ালাম অভিনেতা, অভিনেত্রীরা বরাবরই দারুণ, নাজরিয়াও তার ব্যতিক্রম নন।
তবে, মালায়ালাম অভিনেত্রীদের মধ্যে স্যোসাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি ফলোয়ার থাকা সত্ত্বেও, এত প্রশংসিত হয়েও নাজরিয়া যখন সিনেমায় কাজ করাতে লম্বা বিরতি নিতে চান সেটা ভক্তদের জন্য হতাশাজনকই বটে। তবে, অপেক্ষা বাড়িয়েও যদি নাজরিয়া হারিয়ে না যান, সিনেমা করেন মাঝে মধ্যে, তবেই অপেক্ষা স্বার্থক। নাজরিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে খারাপ লাগবে না নিশ্চিৎ। নাজরিয়া তো ভক্তদের কাছে এভারগ্রিন এক্সপ্রেশন কুইনই থাকবেন, সবসময়!