'নেটওয়ার্কের বাইরে' বেশ যত্নের এক কাজ। মানব অনুভূতির নানা সর্পিল টানেলে যেমন এই গল্প নিয়ে যাবে, তেমনি বার্তা দেবে বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তারও। এই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সম্পর্কহীনতার সময়ে দাঁড়িয়ে নির্মাণের  বৈপরীত্যের বার্তাটিই তাই মূল চমক...

সঞ্জীব চৌধুরী গেয়েছিলেন-

চোখটা এত পোড়ায় কেন
ও পোড়াচোখ সমুদ্রে যাও
সমুদ্র কী তোমার ছেলে?
আদর দিয়ে চোখে মাখাও! 

সমুদ্র-সান্নিধ্যের জন্যে উৎসব লাগে না। চোখ পুড়লেও মানুষ সমুদ্রে যায়। আবার জীবনের 'বুনোরস' খুঁজে পেতেও যায়। 'দারুচিনি দ্বীপ' সিনেমায় 'অয়ন' অথবা 'বল্টু ভাই' চরিত্রে মোশাররফ করিম যেমন একটা খালি প্লেট বাজিয়েই গেয়ে ফেললেন- 

লাফালাফি, ঝাঁপাঝাপি নৃত্য

মরা, আমরা, আমরা সমুদ্রের ভৃত্য...

সমুদ্রও উদার, অকৃপণ। আমাদের নানাবিধ অনুভূতিকে সে প্রশ্রয় দেয়। এই ক্ষুদ্র আমাদের সাদরে টেনে নেয় নিজ অন্দরমহলে। অনুপম রায় যেমন গেয়েছিলেন- 

হে সমুদ্র, আমিও ক্ষুদ্র

ফিরিয়ে নিলে নাও আমায়।

এই 'সমুদ্র'র প্রেক্ষাপটে সময়ে-সময়ে বহু সাহিত্য, নাটক, সিনেমা হয়েছে। সেগুলোর এক্সিকিউশন কখনো খুব দারুণ হয়েছে৷ কখনো অতটা না। গতকাল স্ট্রিমিং সাইট 'চরকি'তে আসা 'নেটওয়ার্কের বাইরে' ওয়েব ফিল্মটি প্রথম ক্যাটাগরির। সমুদ্রে ঘুরতে আসা একদল ছেলের জীবন-গল্পের যে এক্সিকিউশন মিজানুর রহমান আরিয়ান দেখালেন, তা দুর্দান্ত। গল্প, ন্যারেশন, এক্সিকিউশন স্টাইল, সিনেম্যাটোগ্রাফী, গান, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, কালার স্কিম...সবখানেই পরিমিতিবোধ ও পরিচ্ছন্নতার যে ছাপ দেখলাম, তা আসলেই মনে রাখার মতন।

মোটা দাগে, চার তরুণের যাপিত দিনপঞ্জির আঁকিবুঁকির রকমফেরে শুরু হয় এই নির্মাণ। এই চার তরুণ খুব ভালো বন্ধুও। তাদের মধ্যে একজন বিত্তশালীর সন্তান; প্রেমঘটিত টানাপোড়েন ছাড়া জীবনে অতটা সংকট নেই তার। দ্বিতীয়জন- দরিদ্র ঘরের সন্তান। চাকরির সন্ধানে জুতোর শুকতলা উবে যাচ্ছে, কিন্তু আরাধ্য চাকরি ধরা দিচ্ছে না। তৃতীয় বন্ধু বেশ মেধাবী, কয়েকদিন পরেই উচ্চশিক্ষার জন্যে যাচ্ছে বিদেশে। চতুর্থ বন্ধু 'গায়ক' হতে চায়। কিন্তু সুরের দেখা মিলছে না। এই চতুর্থ বন্ধুর পরামর্শেই সবাই মিলে একদিন পরিকল্পনা করে, তারা সমুদ্রস্নানে যাবে! 

চার বন্ধুর জীবনগল্পই বলে এই নির্মাণ! 

যাত্রাপথের খুনসুটি, সাময়িক সংকট, প্রণয়ের আভাস, মানসিক জটিলতা...যাপিত সব ঘটনা-দূর্ঘটনার নাগরদোলায় সওয়ার হয়ে তারা একসময়ে পৌঁছেও যায় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। কিন্তু তাদের জানা হয়ে ওঠে না, সেখানে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে প্রচণ্ড বিস্ময়৷ কী সেই বিস্ময়, তা এখানেই বলছি না। সে রহস্য খোলাসা হবে ওয়েব ফিল্মে।

প্রথম বিষয়, গল্প 'আউট অব বক্স' না। বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পিত নানা অনুষঙ্গ মিশিয়ে এখানে যে গল্প আমরা দেখি, সে গল্পের সাক্ষী আমরা আগেও বহুবার হয়েছি। তবে একই মাছের ঝোলও রান্নার গুণে, মশলার গুণে ছাপিয়ে যেতে পারে অতীতের সব প্রশংসাকে, সেটা এখানেও দৃশ্যমান। ছিমছাম এক গল্পকে যেভাবে ন্যারেট করা হয়েছে, তা খুবই ব্যালেন্সড। নন লিনিয়ার এ গল্পের মিশেলটাও বেশ দারুণ। কোনোখানেই গতি তাই ঝুলে যায়নি।  হাস্যরস, বিষাদ কিংবা মানব-অনুভূতির নানা জটিল সম্পাদ্য-উপপাদ্যকে যেভাবে আনা হয়েছে এখানে, সেগুলোও আরোপিত না। দুয়েকটি বাদ দিলে অধিকাংশ ঘটনাই খুবই বাস্তব। প্রাসঙ্গিক। 

দ্বিতীয়ত, কুশীলবদের ভূমিকা। এই নির্মাণে একগুচ্ছ অভিনয়-শিল্পী থাকবেন, তা ট্রেলার কিংবা পোস্টারেই বোঝা যাচ্ছিলো। শঙ্কা ছিলো, অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট না হয়ে যায় শেষে! কিন্তু নির্মাতা এখানেও দেখিয়েছেন বিচক্ষণতা। গল্পের কেন্দ্রে রেখেছেন চার তরুণকে৷ তারাই প্রোটাগনিস্ট। বাকিদের উপস্থিতি কালেভদ্রে। সাময়িক। তবে যারাই ছিলেন না কেন এই ওয়েব ফিল্মে, কারো অভিনয়েই বড়সড় কোনো খুঁত নেই। শরিফুল রাজ, নাজিফা টুশি, ইয়াশ রোহান, নাজিয়া হক অর্ষা, খায়রুল বাশার, তাসনিয়া ফারিন, জোনায়েদ বোগদাদী, তাসনুভা তিশা...সবার অভিনয়ই ভালো। নির্মাতা এখানেও পরিমিতিবোধের বেশ দারুণ প্রমান দিয়েছেন। রয়েসয়ে ব্যবহার করেছেন সবাইকে। 

কুশীলবদের একাংশ! 

তৃতীয়ত, এই ওয়েব ফিল্মের টেকনিক্যাল টিম নিয়ে আলাদা কথা বলা উচিত। শ্রুতিগ্রাহ্য গান, কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনের দারুণ দারুণ সব দৃশ্য,  ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের সাবলীলতা আর ঝকঝকে কালার টোন...এই বিষয়গুলো গল্প আর অভিনয়ের পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেটার দিকে আলাদা করে নজর দিলে, তা যে দুর্দান্ত ফলাফল নিয়ে আসে, সেটাই এখানে স্পষ্ট। তাছাড়া টিপিক্যাল 'কক্সবাজার' এর দৃশ্য না দেখিয়ে ক্যামেরার চোখ যে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ভেবেছে, একটু ভিন্ন বয়ানে এসেছে উদযাপনের নানা দিক, সেটাও প্রশংসার। 

সিনেম্যাটোগ্রাফী মুগ্ধ হওয়ার মতন!  

'নেটওয়ার্কের বাইরে' সবমিলিয়ে বেশ যত্নের এক কাজ। মানব অনুভূতির নানা সর্পিল টানেলে যেমন এই গল্প নিয়ে যাবে, তেমনি বার্তা দেবে বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তারও। এই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সম্পর্কহীনতার সময়ে দাঁড়িয়ে এই নির্মাণের বৈপরীত্যের গল্পটাই তাই মূল চমক। তারুণ্যনির্ভর এ নির্মাণ ঠিক সে কারণেই হয়তো ছুঁয়ে যাবে অজস্র তরুণ-হৃদয়, যেসব তরুণেরা হয়তো বন্ধুদের মদদপুষ্ট হয়ে যেতে পারে 'নেটওয়ার্কের বাইরে'ও। এ গল্প তাদের। আমাদের। সবার। বাংলা কন্টেন্টে এরকম ব্যালেন্সড, স্মার্ট ট্রিটমেন্ট আরো আসুক। শুভকামনা ও ভালোবাসা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা