নূরুল আলম আতিক: প্রচারের বাইরে থাকা মেধাবী এক নির্মাতা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

শুরু থেকেই আতিকের কাজের ধরন ছিল একদম আলাদা। কেবল গল্পের বিষয়বস্তু নয়, চিত্রনাট্য এবং নির্মাণশৈলীও ছিল ব্যতিক্রমধর্মী, নিজস্ব...
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কিংবা অমিতাভ রেজার মতো বাংলা টেলিভিশনে তাদের সময়কার আরেকজন প্রতিভাবান নাট্যপরিচালক হচ্ছেন নূরুল আলম আতিক। আজ কথা বলবো ক্রিটিক চয়েজে সর্বমোট ছয়বার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার বিজয়ী নূরুল আলম আতিককে নিয়ে।
তবে আমাদের জেনারেশনের কাছে এই ভদ্রলোক অনেকটাই অচেনা। কারন বেশ কিছু বছর যাবত তার তেমন কোনো নাটক/সিনেমা আমরা পাইনি। ২০১০ সাল থেকে তিনি সিনেমা বানানো শুরু করেন। জয়া আহসান অভিনীত 'ডুবসাঁতার' (২০১০)। এরপর তার আর আর কোনো সিনেমা মুক্তি পায় নি। তবে এই কবছরে তিনি মোট ৩টা সিনেমা নিয়ে কাজ করছেন। সিনেমাগুলো হচ্ছে 'মানুষের বাগান', 'পেয়ারার সুবাস' আর 'লাল মোরগের ঝুঁটি'। এগুলার মধ্যে 'পেয়ারার সুবাস' সিনেমাটির শুটিং পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলছে।
সিনেমার কথা বাদ দিলে, নূরুল আলম আতিক ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমাদেরকে প্রচুর টিভি নাটক উপহার দিয়েছেন। তারমধ্যে ইউটিউবে পাওয়া যায় এমন কয়েকটি এক-ঘন্টার নাটক হচ্ছে- চতুর্থ মাত্রা, বিকল পাখির গান, সাইকেলের ডানা, সিন্ডারেলা, অদৃশ্যমানব, অ্যা জার্নি বাই বোট, বারো ভুতের কেচ্ছা ইত্যাদি। মেজবাউর রহমান সুমনের মতো আতিকের নাটকগুলোতেও একটি পরিচিত মুখ হচ্ছে আমাদের জয়া আহসান।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন নূরুল আলম আতিককে নিয়ে লিখছি? কেন তিনি আলাদা?

তার আগে বলি, আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমার সবচে পছন্দের বাংলা নাটক কোনটি? উত্তর হিসেবে 'বিকল পাখির গান' নাটকটির নাম বলতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না।
কাজের ধরণ
শুরু থেকেই তার কাজের ধরন ছিল একদম আলাদা। কেবল গল্পের বিষয়বস্তু নয়, স্ক্রিপ্ট এবং নির্মাণশৈলীও ছিল ব্যতিক্রমধর্মী, নিজস্ব। পর্দায় সহজ সুন্দর গল্পকে উপস্থাপন করেছেন সহজভাবেই। টেকনিকালিটির চেয়ে দৃশ্যের ইনহ্যারেন্ট বা নিজস্ব সহজবোধ্যতাকে তিনি বেশি প্রায়োরিটি দিয়ে থাকেন। তার কিছু কাজে যাদুবাস্তবতার (ম্যাজিক রিয়েলিজম) একটা বড়সড় প্রভাব লক্ষ করা যায়। মানুষের বিশ্বাস, চিন্তাভাবনা, সন্দেহপ্রবনতা, কুসংস্কার- সবকিছুই তার নিজের জীবন এবং চারপাশের মানু্শের উপর প্রভাব ফেলে। সেই প্রভাব নুরুল আলম আতিকের নাটকের স্ক্রিপ্টে পড়েছে বারবার। সেই প্রভাবের কারনে তার নাটকের গল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কখনো সেই প্রভাবটাই হয়ে গেছে নাটকের মূল বিষয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, তার নিজস্ব দর্শনটাই তাকে আলাদা করেছে বাকিদের থেকে।
'অ্যা জার্নি ভাই বোট' নাটকের একটা সিকোয়েন্সের কথা বলি। এই নাটকের একপর্যায়ে মূল চরিত্র অঞ্জনের ধারনা জন্মায় যে, তাদের নৌকাভ্রমণ থেকে পলাতক মাঝি তার স্ত্রীকে রেইপ করেছে এবং তার স্ত্রী সেটা গোপন রেখেছে। ফলে নৌকাভ্রমণ-পরবর্তী সময়ে তার স্ত্রীর সম্বন্ধে তার ভাবনার একটা পরিবর্তন ঘটে এবং তাদের সংসারে তার প্রভাব পড়ে। কিন্তু এখানে কথা হচ্ছে, অঞ্জনের ভাবনাকে এখানে কোনো কল্পনাদৃশ্যের মাধ্যমে দেখানো হয় নি। গল্পের সিকুয়েন্সের স্বাভাবিক প্রবাহে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ নৌকাভ্রমনের ঐ পর্যায়ে দেখানো হয় তার স্ত্রী ধর্ষিত হয়েছে। ফলে দর্শক হিসেবে আমাদের মনে হবে অঞ্জনের ভাবনাটা সত্য। কিন্তু নাটকের শেষে গিয়ে সেই ভুল ভাঙবে।
জাদুবাস্তবতার বিষয়ে 'বিকল পাখির গান' নাটক থেকে একটা উদাহরণ দেই। এই নাটকে শেষের দিকে একটা দৃশ্যে দেখানো হয়, বিমান দূর্ঘটনার কারনে একটা বাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। মহল্লার একজন ফকির টাইপের লোক সেটা আগে জানতে পেরে বাড়ির সবাইকে ম্যাজিক করে বাইরে নিয়ে আসে। এবং এই সবকিছু খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখানো হয়। অর্থাৎ এখানে দর্শকদের বুঝে নিতে হবে, যে মানুষের কুসংস্কার বা মানুষ যেমনটা ভাবে তেমনটা ওখানে দেখানো হয়েছে। পরিচালক এখানে হাতে ধরে কোনোকিছু বুঝিয়ে দেবেন না। তাই স্বাভাবিকভাবে ঐ দৃশ্যগুলি দেখিয়ে নাটক শেষ করা হয়েছে।
আবার ধরুন, নতুন প্রেমে পড়লে কিংবা প্রেমে পড়া সেই মেয়েটি হঠাৎ উধাও হয়ে গেল, একটা ছেলের রাতের (এমনকি দিনেরও) অনেকটা সময় কাটে ভাবনায়; মিষ্টি কল্পনায় বা মন-কেমন দুশ্চিন্তায়। ঠিক সেভাবে 'সিন্ডারেলা' নাটকের অনেকটা অংশ জুড়ে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন কল্পনাদৃশ্য।

কমেডিধর্মী 'অদৃশ্য মানব' নাটকটি বানিয়েছেন এমন একটা চরিত্রকে কেন্দ্র করে যাকে কেউ দেখতে পায় না, অথচ সে সবাইকে দেখতে পারে। আসলেই, মানু্ষের অদৃশ্য হবার ক্ষমতা থাকলে সে সবসময় অসৎকাজই করত। এই যেমন আমি অদৃশ্য হতে পারলে, ব্যাংক ডাকাতি করে বড়োলোক হয়ে যেতাম।
প্রথম নাটকেই তিনি নিয়েছিলেন বড় একটা চ্যালেঞ্জ। শহীদুল জহিরের 'চতুর্থ মাত্রা'র মতো মাথার উপর দিয়ে যাওয়া একটা গল্প নিয়ে নাটক বানিয়েছেন, যে নাটকটাকে নিজের মত করে অনেকভাবে ভাবা যায়। 'বারো ভুতের কিচ্ছা' নাটকটি পুরোটা ভুতেদের গল্প। 'সাইকেলের ডানা' নাটকটি কিছুটা অস্বাভাবিক, নিজের মতো থাকা একটা ছেলের গল্প, যাকে সবাই অলুক্ষুণে মনে করে, যার সাথে দেখা হলে নাকি সবার অমঙ্গল হয়। মাস্ট ওয়াচ একটা নাটক।
পুরস্কার সমূহ
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে, নুরুল আলম আতিককে নিভৃতচারী শিল্পী বলেই মনে হয়। তিনি যেন একটু আড়ালেই থাকতে চান। ২০০০ সালে তিনি আবু সাইয়ীদ পরিচালিত 'কিত্তনখোলা' সিনেমার চিত্রনাট্যকার হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। অমিতাভ রেজা পরিচালিত 'একটি ফোন করা যাবে প্লিজ' নাটকের চিত্রনাট্যের জন্য মেরিল প্রথম আলো পুরষ্কার জেতেন। এছাড়া তার নিজের চতুর্থ মাত্রা, বিকল পাখির গান, সাইকেলের ডানা নাটকসমুহের পরিচালনা ও স্ক্রিনপ্লে'র জন্য ৫টি মেরিল প্রথম আলো পুরষ্কার জিতেছেন।
এই লেখাটির মাধ্যমে আমি নূরুল আলম আতিক ভাইয়ের কাজের প্রতি একটা ছোট্ট ট্রিবিউট দেবার চেষ্টা করেছি। শিল্পীর সার্বিক সুস্থতা কামনা করছি।
ফিচার্ড ইমেজ কৃতজ্ঞতা- লাল জীপের ডায়েরি