গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ডসে তিনি পেয়েছিলেন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। সেই অসাধারণ এ্যাওয়ার্ড উইনিং স্পিচটি জায়গা করে নিয়েছিল ইউটিউবের নাম্বার ওয়ান ট্রেন্ডিং-এ! সেখানে কী বলেছেন অপরাহ উইনফ্রে?

ছোট্ট একটি মেয়ে। বস্তির ঘুপচি ঘরে বাস। এতটুকুন বয়সেই সমাজের কুৎসিত চেহারাটা দেখে নিয়েছে। বুঝে গেছে পৃথিবীতে কিছু মানুষকে জীবন মৃত্যুর মাঝে অনেকটা সময় ধরে যুদ্ধ করে যেতে হয়। এরই মাঝে বিজয়ী বীরের বেশে ফিরে আসার ক্ষমতা যার আছে সে-ই তো পারে এগিয়ে যেতে। বলছি সেই অপরাজেয় নারী অপরাহ উইনফ্রের কথা।

১৯৫৪ সালের ২৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপিতে জন্ম নেন তিনি। কিশোরি মায়ের গর্ভে জন্ম তার। শিশুকালেই হন নির্যাতনের স্বীকার। নির্যাতন সইতে না পেরে পালিয়ে যান বাড়ি থেকে। এমনই বিভীষিকাময় শৈশব নিয়ে বড় হয়েছেন অপরাহ। সেই অপরাহই হয়েছেন পরে গিয়ে পৃথিবীর প্রথম বিলিয়নিয়ার আফ্রিকান আমেরিকান। গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ডসে তিনি পেয়েছেন সিসিল বি ডিমিলে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। সেই এ্যাওয়ার্ড উইনিং স্পিচে অপরাহ তুলে আনেন বর্ণবৈষম্য, নারীদের প্রতি সমাজের মনোভাব ও যৌন হয়রানির মতো ইস্যুগুলোকে। ইউটিউবে থাকা সেই ভিডিওর মূল অংশ বাংলা অনুবাদ করে দেয়া হলো পাঠকদের জন্য- 

১৯৬৪ সালে যখন আমি খুব ছোট, মিলওয়াকিতে আমার মায়ের বাড়ির লিনোলিয়াম ফ্লোরে বসে দেখছিলাম এনা ব্যানক্রফট ৩৬ তম একাডেমি এওয়ার্ডে সেরা অভিনেতার পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন। তিনি খামটি খুললেন এবং পাঁচটি শব্দ বললেন যা সত্যি সত্যিই ইতিহাস গড়েছিল সেদিন- দ্য উইনার ইজ সিডনি পয়টার। আর তখন পুরস্কার নিতে এলেন আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটি। আমার মনে আছে তার টাই ছিল সাদা আর চামড়া- অবশ্যই কালো। এবং আমি এর আগে কখনোই একজন কালো মানুষকে নিয়ে এমন উদযাপন দেখিনি। আমি অনেক অনেকবার চেষ্টা করেছি বোঝানোর জন্য যে একটা ছোট কালো মেয়ের জন্য সেই মুহূর্ত কতোটা গুরুত্ব বহন করেছিল, একটা ছোট মেয়ে যে সস্তা একটা সিটে বসে দেখে তার মা অন্য মানুষের বাসা পরিষ্কার করে ক্লান্তিতে জর্জরিত হয়ে বাড়ি ফেরে। তাই বোঝানোর জন্য আমি যা করতে পারি তা হল ‘লিলিজ অফ দ্য ফিল্ড’ থেকে সিডনির বলা কথাই কোট করতে পারি- আমেন, আমেন, আমেন, আমেন! 

স্পিচ দেওয়াকালীন সময় অপরাহ উইনফ্রে

১৯৮২ সালে সিডনি ঠিক এখানেই সিসিল বি ডিমিলে এ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন গোল্ডেন গ্লোবে এবং এটা আমাতে এসেই শেষ হয়ে যায় নি, কারণ এই মুহূর্তে কিছু ছোট ছোট মেয়ে আমাকে দেখছে, তারা দেখছে যে আমি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে একই পুরস্কার পেয়েছি। এটি একটি সম্মান- এটি যেমন সম্মান তেমন একটি সুযোগও এই সন্ধ্যা আপনাদের সবার সাথে কাটানোর, এবং সেসকল অসাধারণ পুরুষ ও নারীদের সাথেও যারা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, চ্যালেঞ্জ করেছে ও সহ্য করেছে আর এই স্টেজ পর্যন্ত আমার যাত্রা সম্ভব করেছে। 

রেসি টেইলর নামে একজনের নাম আমি জানি যা আপনাদেরও জানা দরকার বলে আমি মনে করি। ১৯৪৪ সালে রেসি টেইলর ছিলেন একজন তরুণী স্ত্রী, একজন মা; যিনি একদিন এলাবামার এক চার্চ থেকে বাড়ি ফেরত আসছিলেন আর ৬ জন অস্ত্রধারী পুরুষ তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে আর চোখ বেঁধে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে যায়। তারা তাকে হুমকি দিয়েছিল যে যদি কখনো কাউকে সে তাদের কথা বলে তাহলে তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু তিনি এই ঘটনা নিয়ে এনএএসিপিতে রিপোর্ট করেন এবং এই কেসের দায়িত্ব দেয়া হয় আরেক সাহসী নারী রোজা পার্কসকে। তারা দুজনে মিলে এই ঘটনার জন্য বিচার দাবী করেন।

কিন্তু বিচার আসলে সম্ভব ছিল না জিম ক্রোর যুগে। সেসব লোকেরা যারা সেই নারীটির জীবন ধ্বংস করতে চেয়েছিল তাদের কখনোই বিচারের আওতায় আনা যায়নি। সেই রেসি টেইলর দশ দিন আগে মারা গেছেন তার ৯৮ তম জন্মদিনের কিছুদিন আগে। তিনি বেঁচে ছিলেন ঠিক যেমনটা আমার বেঁচে আছি, বহু বছর ধরে এমন একটা সংস্কৃতিতে যা ক্ষমতাধর পুরুষরা খুবই বাজেভাবে ধ্বংস করে আসছে। দীর্ঘ একটা সময় ধরে নারীদের কণ্ঠ শোনা হয়নি, বিশ্বাস করা হয়নি তারা সাহস করে সেই ক্ষমতাধর পুরুষদের নিয়ে বলা সত্ত্বেও।

আমি সেসব ক্ষমতাধর পুরুষদের জানিয়ে দিতে চাই- তোমাদের সময় শেষ! তোমাদের সময় আসলেই শেষ! তাদের সময় শেষ এবং আমি আশা করি- আমি কেবল আশাই করতে পারি যে রেসি টেইলর এই হার না মানা সত্যকে জেনেই মৃত্যুকে আপন করে নিয়েছেন, যেমনটা আপন করে নিয়েছে সেসময়ে নির্যাতিত হওয়া আরও অনেক নারী, এবং এখনো যারা নির্যাতিত হচ্ছে তারাও।

অপরাহ উইনফ্রে

এই সত্য ১১ বছর পর রোজা পার্কের হৃদয়ের কোন গহীন কোণেও ছিল হয়তো যখন তিনি মন্টগোমেরির বাসে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং এটা এখনো আছে প্রতিটি নারীর মাঝেই যখন তারা বলে ওঠে- me too আর সেই প্রতিটি পুরুষ যারা সে কথা শোনার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার ক্যারিয়ারে আমি সবসময় সেরাটা চেষ্টা করেছি কীভাবে পুরুষ ও নারীর ব্যবহার করা উচিত সেটা বোঝাতে, সেটা টেলিভিশনে হোক কিংবা ফিল্মে। বলতে যে আমরা কীভাবে অপমান সহ্য করেছি, কীভাবে ভালোবেসেছি ও ক্ষোভে ফেটেছি, কীভাবে আমরা মুখ থুবড়ে পড়েছি, কীভাবে আমরা পিছিয়ে গিয়েছি, কীভাবে আমরা চেষ্টা করেছি এবং কীভাবে আমরা আবার ফিরে এসেছি।

আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং দেখানোর চেষ্টা করেছি এমন কিছু মানুষকে যারা জীবনের কিছু রুঢ় অন্ধকার সত্যকে খুব কাছ থেকে দেখেছে, কিন্তু তাদের সবার মাঝেই একটা গুণ ছিল আর তা হল আলোকিত এক সকাল দেখার আশা রাখা, একদম আঁধার কালো রাত হলেও। তাই সকল নারীদের বলছি যারা দেখছো আজ, এক নতুন দিন এসেছে দিগন্তে! এবং যখন সে নতুন দিন উদিত হবে তা হবে কিছু অসাধারণ নারীর জন্য, যাদের মাঝে অনেকেই আজ এখানে আছেন, এবং কিছু অসাধারণ পুরুষের জন্যও, যারা যুদ্ধ করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়েছে এমন একটা সময়ে নিয়ে যাবার জন্য যখন কাউকে আর কখনোই ‘me too’ বলতে হবে না। 

(লেখাটি রকমারির মেইল ক্যাম্পেইনে ব্যবহৃত হয়েছে)


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা