উইল স্মিথের চড়ের আগেও অজস্র অঘটন দেখেছে অস্কার
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ক্রিস রককে উইল স্মিথের চড় মারাই হোক কিংবা হোক 'মুনলাইট' এর বদলে 'লা লা ল্যান্ড' এর নাম পড়ে ফেলা- এসব দুর্ঘটনা বাদেও 'অস্কার' এর আছে এমন সব বিতর্ক, যা নিয়ে যত জানা যায়, ততই চমক বাড়ে, বাড়ে অবিশ্বাসও...
এবারের অস্কারে কথা বলার বিষয় ছিলো বহুকিছু নিয়ে। যে সিনেমাকে এবারের 'বেস্ট ফিল্ম' হিসেবে নির্বাচিত করা হলো, সেটি আসলেই 'অস্কার' পাওয়ার যোগ্য কি না, আলোচনা হতে পারতো তা নিয়ে। অ্যানিমেশন ক্যাটাগরিতে যে সিনেমা পুরস্কার পেলো, সেটির চেয়ে ভালো সিনেমা ছিলো কী না পাইপলাইনে, আলোচনার বেশ ভালো প্রসঙ্গ ছিলো সেটিও। আবার, এবারের অস্কারের 'লাইভ প্রোগ্রাম' থেকে যে বাদ দেয়া হলো ৮টি অস্কার অ্যাওয়ার্ড, তীব্র সমালোচনা হওয়া উচিত ছিলো তা নিয়েও। কিন্তু সেসবের কোনোকিছুই না হয়ে, উইল স্মিথ- ক্রিস রকের থাপ্পড়-কান্ড নিয়ে যেভাবে বুঁদ হয়ে রইলো অস্কার, হলিউড সহ তাবড় বিশ্ব, তাতে চমকাতেই হলো ক্ষণেক্ষণে। আবার অনেকে এও ভাবলেন, অস্কারের মত কুলীন মঞ্চে এরকম উদ্ভট ঘটনা বোধহয় এটাই প্রথম! যদি কেউ সত্যিই এরকমটা ভেবে থাকেন, তাহলে বলতেই হবে- ভেবেছেন পুরোপুরি ভুল। 'অস্কার' মাঝেমধ্যেই মূল আলোচনা বাদ দিয়ে এরকম উটকো ঘটনায় জলঘোলা করেছে। অতীতের ঘুলঘুলিতে উঁকি দিলেই পাওয়া যাবে সেসব। এবং সেখান থেকে বাছাই করা কিছু ঘটনাই আজকের উপজীব্য।

বর্ণবাদ
সাল ১৯৪০। অস্কারের মঞ্চে প্রথমবারের মতন পুরস্কার জিতলেন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান অভিনেত্রী। হ্যাটি ম্যাকড্যানিয়েল। বিখ্যাত সিনেমা ‘গন উইথ দ্য ওয়াইন্ড” এ দুর্দান্ত অভিনয়ের সুবাদে সে বছরের অস্কারে ‘বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্ট্রেস’ ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন তিনি। এবং এই পুরস্কারপ্রাপ্তির বিশেষ অংশটুকু বাদ দিয়ে পুরোটাই হয়ে থাকে হ্যাটি ম্যাকড্যানিয়েলের জন্যে এক বিব্রতকর অভিজ্ঞতা। যে সময়ের কথা বলছি, বর্ণবাদ সে সময়ে আমেরিকায় ক্রমশই বিস্তার করছে থাবা। যে থাবার মুখোমুখি হতে হয় হ্যাটি ম্যাকড্যানিয়েলকে। তাও অস্কারের আয়োজনেই। অস্কার কমিটি যে হোটেলে অতিথিদের রাখার ব্যবস্থা করেছিলো, সেখানে ঢুকতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় কৃষ্ণাঙ্গ এ অভিনেত্রীকে। এখানেই শেষ না। অস্কারের মূল আয়োজনের সময়েও তাকে বসানো হয় আলাদা টেবিলে। অনেকটা ‘একঘরে’ করে রাখার মতই রাখা হয় তাকে পুরোটা সময়ে। হ্যাটি ম্যাকড্যানিয়েলের এ গ্লানিময় অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে শোনার পরে অনেকেই নিন্দামুখর হয়েছিলেন কর্তাব্যক্তিদের উদাসীনতা ও এরকম বিদ্বেষমূলক আচরণ নিয়ে। যদিও তাতে পাল্টায়নি কিছুই!
অস্কার প্রত্যাখান
সাল ১৯৩৬। সেবারের অস্কারে থ্রিলার ড্রামা 'দ্য ইনফরমার' এর জন্যে চিত্রনাট্যকার ডুডলি নিকলস'কে 'বেস্ট স্ক্রিনপ্লে অ্যাওয়ার্ড' এর জন্যে মনোনীত করা হলো। প্রসঙ্গত জানাই, 'দ্য ইনফরমার' প্রখ্যাত লেখক লিয়াম ও'ফ্লেহার্টিস এর বিখ্যাত উপন্যাস, যে উপন্যাসের উপজীব্য আইরিশ যুদ্ধ।
বিস্ময়ের ব্যাপার, এই অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাখান করেন ডুডলি নিকলস। এবং ইতিহাসের তিনিই প্রথম মানুষ, যিনি 'অস্কার অ্যাওয়ার্ড' রিফিউজ করেন৷ এর পেছনে নিহিত থাকে স্পষ্ট এক কারণও। কারণটি হচ্ছে, চিত্রনাট্যকারদের সংগঠন। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে আমেরিকান স্ক্রিন-রাইটাররা বিশ্বাস করতেন, অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে প্রচুর দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়৷ অ্যাকাডেমির সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষজন যে প্রতিভার দাম দিতে পারেনা, সেটাও ছিলো তাদের অভিমত। এবং এসবেরই পরিপ্রেক্ষিতে, 'অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড' প্রত্যাখান করে বেশ দারুণ এক প্রতিবাদই করেন ডুডলি নিকলস। যিনি পরবর্তীতে 'অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সাইন্স' এ এক বিবৃতি পাঠান এবং বলেন-
আমি যদি এই পুরস্কার গ্রহণ করি, তাহলে তা চিত্রনাট্যকারদের যে সংগঠন, সেখানের সহস্রাধিক সদস্যের সাথে বেইমানি করা হবে। তাই, আমি এই অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে পারবো না৷
এবং এভাবেই মঞ্চস্থ হয় ইতিহাসের প্রথম অস্কার-প্রত্যাখানের উপাখ্যান।
ডাবল রিজেকশন
কাল্ট ক্ল্যাসিক 'দ্য গডফাদার' দেখেছে অথচ 'ভিটা কর্লিওনি' চরিত্রে মার্লন ব্রাণ্ডোর অভিনয়ে মুগ্ধ হননি, এমন সিনেমাপ্রেমী বোধহয় খুব কমই আছে। বিশেষ এ চরিত্রে যে অভিনয় মার্লন ব্রাণ্ডোর, তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায়ও ছিলোনা। এবং অস্কার এর 'বেস্ট অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ড' এও বিজয়ী হবেন ব্রাণ্ডো, এটাও ছিলো অনুমিত। যদিও বিস্ময় এটাই, ব্রান্ডো এই পুরস্কার গ্রহণ করতে গেলেন না। তিনি না গিয়ে, তার পক্ষে আরেকজনকে পাঠালেন। মজার ব্যাপার, যাকে তিনি পাঠালেন, সেও পুরস্কারটি গ্রহণ করলো না। শুধু যে পুরস্কার প্রত্যাখান করেই ক্ষান্ত হলেন, এমনও না। তিনি ব্রাণ্ডোর ব্যক্তিগত একটা চিঠিও পড়লেন। যে চিঠির মূলবক্তব্য এটাই- হলিউড আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের সাথে যে রূঢ় বৈষম্য করে, সেটার প্রতিবাদ হিসেবেই ব্রাণ্ডো প্রত্যাখান করেছেন অ্যাওয়ার্ড। আরো চমক, এই একই অস্কারের মঞ্চ প্রত্যাহার করেন আল পাচিনোও। তার ভাষ্যমতে, তাকে যে 'বেস্ট সাপোর্টিং ক্যারেক্টর' এ নমিনেশন দেয়া হয়েছে, তা অসম্মানজনক। কারণ, তার স্ক্রিনটাইম মার্লন ব্রাণ্ডোর চেয়েও বেশি!

ধিক্কার জানাই, মিঃ বুশ!
আমেরিকার জাতীয় ইতিহাসের স্মরণীয় তারিখ 'নাইন ইলেভেন' এর পর অতিক্রান্ত হয়েছে দুই বছর। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তখন জর্জ ডব্লিউ বুশ। ক্ষণেক্ষণেই ইরাক আক্রমণ করছেন তিনি। ইরাকের সাথে যুদ্ধ লেগেই আছে আমেরিকার। থামারও নামগন্ধ নেই। এরকম এক সময়ে ২০০৪ সালের অস্কার মঞ্চস্থ হলো। 'বেস্ট ডকুমেন্ট্রি' ক্যাটাগরিতে নিজের নির্মাণ 'বোলিং ফর কলম্বাইন' এর জন্যে অস্কার জিতলেন মাইকেল মুর। পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠলেন তিনি। মাইক হাতে নিয়ে কথা বলতে বলতে আচমকাই শুরু করলেন প্রেসিডেন্ট বুশের সমালোচনা। ইরাক যুদ্ধ যে অযথাই হচ্ছে, বিনা কারণে যে আমেরিকানদের যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে, এটাই ছিলো তার বক্তব্য। এবং এই কাজের জন্যে তিনি বুশকে 'শেম অন ইউ, মিঃ বুশ' বলেও তিরস্কার করতে লাগলেন। মানুষজন মুরের বক্তব্যে যখন অনেকটাই হতভম্ব, তখনই বেজে উঠলো নেপথ্যের সঙ্গীত। মুরের বক্তব্য ধামাচাপা পড়ে গেলো। যদিও পরবর্তীতে এ ঘটনার রেশ গড়িয়েছিলো বহুদূর।
আমি কখনো অস্কার পাইনি!
২০০৭ সালের অস্কার। সে বছরের অস্কারে 'বেস্ট ডিরেক্টর অ্যাওয়ার্ড' এর বিজয়ীর নাম ঘোষণা করার জন্যে মঞ্চে উঠলেন তিন মহারথী। ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, স্টিভেন স্পিলবার্গ এবং জর্জ লুকাস। মঞ্চে উঠে প্রথমেই কপোলা বললেন-
আমরা তিনজন এখানে উপস্থিত, কারণ আমরা জানি, নিজেদের সিনেমার জন্যে অস্কার জেতার আনন্দটুকু কতখানি নিখাদ।
স্পিলবার্গও এ কথাকে সমর্থণ করলেন। কিন্তু চমকে দিলেন লুকাস। তিনি বললেন-
আমি কখনো কোনো অস্কারই পাইনি!
এ কথার মধ্যে তীব্র ভর্ৎসনাও ছিলো। সেটা জানার জন্যে একটু ঘাঁটতে হবে অতীত। উডি অ্যালেন যেবার 'অ্যানি হল' এর জন্যে অস্কার জিতেছিলেন, সেবার লুকাসের ম্যাগনাম ওপাস 'স্টার ওয়ার্স'ও ছিলো নমিনেশন তালিকায়। এবং 'স্টার ওয়ার্স'কে বাদ দিয়ে 'অ্যানি হল'কে পুরস্কৃত করায় 'অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড' এর বেশ সমালোচনাও হয়েছিলো সেবার। এবং লুকাস তার করা বিশেষ এ উক্তির মাধ্যমে পুরোনো সে ক্ষতকেই যেন একটু খোঁচা দিয়েছিলেন!
#OscarsSoWhite
২০১৬ সালের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে নানা ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পাওয়া ২০জন পুরুষের প্রত্যেকেই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। বর্ণবৈষম্যের এ প্রকট ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে অনেকেই সেবার বয়কট করেছিলেন অস্কারের মঞ্চ। এদিকে, সেবারের অস্কারের হোস্ট ছিলেন আবার ক্রিস রক। তিনি তার স্যাটায়ারিক্যাল মনোলগে তীব্র তিরস্কার করেন এই বিষয়টির। 'অস্কার'কে 'হোয়াইট পিপল'স চয়েজ অ্যাওয়ার্ডস' বলেও ব্যঙ্গ করেন তিনি। এমনকি, 'অস্কার যদি হোস্টের নমিনেশন দিতো, তাহলে যে তিনিও বাদ পড়তেন প্রথমেই, সেটা শ্লেষাত্মক স্বরে জানান তিনি। ক্রিস রকের 'ওপেনিং মনোলগ' বেশ কড়াভাবেই সমালোচনা করেছিলো অস্কারের এ পক্ষপাতমূলক বর্ণবাদের। পাশাপাশি, #OscarsSoWhite হ্যাশট্যাগেও ভরে গিয়েছিলো সোশ্যাল মিডিয়া।

দ্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড.... হোয়াট?
২০১৭ সালের অস্কারে ঘটেছিলো অদ্ভুতুড়ে এক ঘটনা। 'বেস্ট পিকচার' অ্যাওয়ার্ডের নাম ঘোষণার জন্যে মঞ্চে উঠেছিলেন ফায়ে ডুনাওয়ে এবং ওয়ারেন বেটি। সেবার 'বেস্ট পিকচার' অ্যাওয়ার্ড পায় 'মুনলাইট' সিনেমা। কিন্তু কার্ড-বদলে সেটা হয়ে যায় 'লা লা ল্যান্ড।' অর্থাৎ, ভুল করে তারা বলে ফেলেন- 'বেস্ট পিকচার' এর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে 'লা লা ল্যান্ড।' পুরস্কার নিতে মঞ্চে আসে 'লা লা ল্যান্ড' এর পুরো টিম। পুরস্কার দেয়া হয়৷ তারা তা গ্রহণও করে। কিন্তু এরপরেই মঞ্চস্থ হয় চমক। ভুল সংশোধন করে আবার ঘোষণা করা হয় 'মুনলাইট' এর নাম। এই সিনেমাকে দেয়া হয় 'বেস্ট পিকচার' এর প্রকৃত পুরস্কার। ঘোষণা-বিভ্রাটের এই পুরো ঘটনাটি বেশ হাসির খোরাকই দিয়েছিলো উপস্থিত সবাইকে। বহুদিন ধরে আলোচনার শিরোনামও ছিলো ঘটনাটি।

কেলেঙ্কারির একশেষ
'কুইন' ব্যান্ড এর ভোকালিস্ট ফ্রেডি মার্কারির জীবনীকে উপজীব্য করে নির্মিত 'বোহেমিয়ান রাপসডি' সিনেমা নানা কারণে এমনিতেই বিতর্কিত ছিলো। এ সিনেমার পরিচালক ব্রায়ান সিঙ্গারের যৌন কেলেঙ্কারি কিংবা এ সিনেমায় 'এইডস' এর বিতর্কিত প্রেজেন্টেশন... সব নিয়েই ছিলো বিস্তর আলোচনা- সমালোচনা। তবে এতসব ঋণাত্মক আলোচনার পরেও এই সিনেমার এডিটর জন অটোম্যান পেয়ে যান 'বেস্ট এডিটিং' ক্যাটাগরিতে অস্কার। যদিও সব সিনেমাবোদ্ধা, এমনকি খোদ অটোম্যানও নিজের এডিটিংকে বলেছেন 'বিলো অ্যাভারেজ', তবুও সে কাজটিই কেন হলো 'অস্কার বিজয়ী', সেটার উত্তর নেই কারোর কাছেই। অস্কারের ইতিহাসের অন্যতম দুর্ঘটনা হিসেবেই থেকে যায় এই বিশেষ ঘটনাটি।
উপস্থাপক-বিহীন অস্কার
সাল ২০১৯। অভিনেতা কেভিন হার্টের করা কিছু বিতর্কিত সমকামীতা-সংক্রান্ত টুইটের জন্যে জনতার রোষানলে পড়েন তিনি। তাকে অস্কারের মঞ্চ থেকেও বাদ দেয়া হয়। পাশাপাশি, একাডেমি এও সিদ্ধান্ত নেয়, আগামী ২ বছরও তারা কোনো হোস্ট ছাড়াই পরিচালনা করবে তাদের অনুষ্ঠান৷ এবং সেটা তারা করেও। ২০২২ অর্থাৎ এবারের আয়োজনে টানা তিন বছরের শূন্যস্থান পূরণ করে হোস্ট আসেন মঞ্চে৷ যদিও সে হোস্টের সাথে উইল স্মিথ কি করলেন, সেটাও আমাদের জানা! বেশ ভালোভাবেই জানা!
এসবের বাইরেও আছে আরো ছোটখাটো অস্কার-দুর্ঘটনা। সেসব নিয়ে হয়তো বলা যাবে অন্য কোনোদিন। আপাতত এটুকুই। এখানেই ইস্তফা।