'মহানগর' নিয়ে কথা শেষ হয়নি, এরইমধ্যে এই জুলাই মাসেই আসতে চলেছে আরো কিছু নতুন নির্মান। জি-ফাইভ এর 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন', চরকি'র 'মরীচিকা' এবং 'ঊনলৌকিক', বিঞ্জ এর 'পঁচিশ' নিয়ে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে তীব্র আলোচনা...

খুব বেশি পিছিয়ে যেতে হবে না, গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান যদি খেয়াল করা হয়, দেখা যাবে, দেশীয় সংস্কৃতি খুব ক্লিশে এক আবর্তে নিয়মিত ঘুরপাক খাচ্ছিলো। প্রেম-প্রাপ্তি-প্রত্যাশা'র আদ্যিকালের কাঠামোর গতানুগতিক চক্রে নাকাল হচ্ছিলো সব। সে সাথে অবশ্যই কুরুচিপূর্ণ কিছু নাটক প্রসব হচ্ছিলো, যেসব নাটকে কিছু নোংরা, চটুল কথা বলে দর্শক টানার বিস্তর চেষ্টা চলছিলো। একশ্রেণির দর্শকও তৈরী হয়েছিলো, যারা এই ধরণের নাটকগুলোর তীব্র অনুরাগী ছিলেন। সে এক ভীষণ বিভীষিকার সময়। যেকোনো সমাজের জন্যে নিয়মিত যেমন ডাল, চাল, আলু লাগে, সেরকমভাবেই সুস্থ কিছু নির্মাণও লাগে, নাহয় মস্তিষ্কের বিকাশ হয় না... এই স্বাভাবিক বিষয়টি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম আমরা সবাই। অতীতের সেই সময়ের দিকে তাকালে তাই ভীতির উদ্রেক হয়। তবে কোনো সময়ই চিরকালীন নয়। গানেই যেমন আছে- আগুনের দিন শেষ হবে একদিন, অনেকটা সেরকমই, দেশীয় সংস্কৃতি চেষ্টা করেছে ঘুরে দাঁড়াতে এবং অনেকটা তারা সফলও। কুটিল সেই ঘূর্ণিপাক থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছে এদেশের নির্মান, তেমনটি বলার দুঃসাহস করি না। তবে,আশা একটাই, পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। 

এমন নয় যে, বিগত সেই সময়ে ভালো কাজ হয়নি। অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু গতানুগতিক সমীকরণের বাইরের সে কাজগুলো জনসম্মুখে আসে নি। খুব বেশি প্রচার-প্রসারণা হয় নি। সেরকমভাবে মাতামাতি হয়নি। একটা সময় ছিলো, দেশের নির্মানগুলো দেশের মানুষই ঠিকঠাক দেখার সুযোগ পেতো না; বাইরে যাওয়ার কথা তো বহুদূরের প্রশ্ন! সেই দৃশ্যপটেও এসেছে দারুণ পরিবর্তন। হালের 'মহানগর' ওয়েব সিরিজ নিয়ে যেমন বলিউডের 'ফিল্ম কম্পানিয়ন' রিভিউ দিচ্ছে, কলকাতার বাঘা বাঘা পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লেখালেখি হচ্ছে, 'কন্ট্রাক্ট', 'তাকদীর' বা 'জানোয়ার' এর মতন ওয়েব সিরিজগুলো নিয়ে ভারতের বাংলাভাষী দর্শকেরা, বোদ্ধারা নিয়মিত কথা বলছেন। উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা, ওটিটি কন্টেন্টে আমাদের যে উত্থান, তাকে সমীহই করছে সবই। দেশের সব তারকা, সব মহীরুহরা আদাজল খেয়ে নেমেছেন, তাদের শক্তির দুর্দান্ত প্রদর্শনী তারা দেখাচ্ছেন দেশীয় নানা নির্মানে। সবমিলিয়ে এমন এক সুস্থ তাণ্ডব শুরু হয়েছে, আগের সময়ের নির্মান-জনিত আক্ষেপের খেদ মিটে যাচ্ছে, তছনছ হচ্ছে যাপিত হতাশা৷ 

'মহানগর' নিয়ে প্রশংংসা কমছেই না! 

সবচেয়ে আশার বিষয়, কাজ থেমে নেই। একের পর এক নির্মান আসছে৷ 'মহানগর' নিয়ে কথা শেষ হয়নি, এরইমধ্যে এই জুলাই মাসেই আসতে চলেছে আরো কিছু নতুন নির্মান। ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম 'জিফাইভ' এ আসতে চলেছে গুনী নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী'র 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন।' একঝাঁক তারকায় ভরা সমসাময়িক কিছু বিষয় নিয়ে নির্মিত সেই ওয়েব সিরিজের ট্রেলারেই মুগ্ধ হয়েছে অধিকাংশ দর্শক। শুধু এখানেই শেষ না- স্ট্রিমিং সাইট 'চরকি'তে আসবে ওয়েব সিরিজ মরীচিকা, অ্যান্থোলজি সিরিজ ঊনলৌকিক। এই দুই নির্মানেও তারকার কমতি নেই, কমতি নেই দুর্দান্ত প্রচারণার ভাবনাতেও। পোস্টার-ট্রেলার-টিজারে সবখানেই 'পালটে যাওয়া নির্মান' এর সুর। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম 'বিঞ্জ' এ আসতে চলেছে মাহমুদ দিদার এর 'পঁচিশ।' পলিটিক্যাল ড্রামা জনরার এই কাজ নিয়েও আশাবাদ কম না। তেমনি আশাবাদ জারি রয়েছে, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম 'আরটিভি প্লাস' এ প্রচারের অপেক্ষায় থাকা সঞ্জয় সমাদ্দারের 'অমানুষ' নিয়েও। 

'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন' এর ট্রেলার মুগ্ধ করেছে সবাইকে! 

একের পর এক দারুণ নির্মানের খবর আসছে, এই সংবাদ যেমন আশাব্যঞ্জক, তেমনি কাজগুলো যে দেশে-বিদেশে যথাযথ সমর্থন পাচ্ছে, অবহেলায় পড়ে থাকছে না...এটাও ইঙ্গিত দেয়, সুস্থ এক সময়ের। নির্মানগুলো নিয়ে নির্মাতা, কুশীলবেরা যেভাবে অভিনব সব প্রচারণায় নামছেন, সেটাও প্রশংসাযোগ্য এক বিষয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয়, যেসব থিম ভেবে নির্মাতারা এই নির্মানগুলো বানাচ্ছেন, সেটি। সমাজের যাপিত অসঙ্গতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে এই নির্মানগুলোকে দুর্দান্ত এক প্রতিবাদের ক্ষেত্রই বানিয়েছেন নির্মাতারা। সত্যজিৎ রায় যেমন বলতেন, ভাষা বদলায়, বদলায় ক্যামেরার চোখও। সেরকমভাবেই পালটে যাচ্ছে নির্মানের ভাষা, ক্যামেরার চোখে উঠে আসছে সমাজ পাল্টানোর জ্বাজ্জল্যমান সব ইঙ্গিতও। 

পাল্টে যাওয়া সংস্কৃতির এই দুর্বার স্রোতটা থাকুক। দেশের সংস্কৃতিক্ষেত্রে এতদিন ধরে জমা হয়ে থাকা যাপিত জঞ্জাল ধুয়েমুছে বিলীন করতে এই স্রোত আরো বহুদিন থাকা প্রয়োজনও। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা