সালমান খানের 'রাধে' সিনেমা ফ্লপ হয়েছে। তীব্র বিদ্রুপের শিকার হয়েছে সিনেমাটি। অক্ষয় কুমারের 'লক্ষ্মী' কিংবা সঞ্জয় দত্তের 'সড়ক- টু' নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। 'স্টারডম' কিংবা 'সুপারস্টার' তকমা গোত্তা খেয়ে পড়ছে ওটিটির মানদণ্ডের সামনে। স্ট্রিমিং সাইটের সামনে মূখ্য হয়ে উঠছে অভিনয়, গল্প, নির্মাণশৈলী। আর কেউ না। আর কিছু না...

'আয়নাবাজি' যখন ফার্স্ট ডে, ফার্স্ট শো দেখতে গিয়েছি সিনেমাহলে, কম হুজ্জত হয়নি। বলাকা সিনেমাহলের সামনের চাতালে কাকডাকা ভোর থেকেই গিজগিজ করছে মানুষ। সদ্যগজানো চিড়চিড়ে রোদ আর মানুষজনের ভীড় ঠেলেঠুলে অন্ধকার ঘর। সে ঘরের ওপাশে বিরাট রূপোলী পর্দা৷ সিনেমা ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে। চঞ্চল চৌধুরী পর্দায় সর্বব্যাপী অবয়বে ছুটোছুটি করছেন। আশেপাশের দর্শকসিট থেকে হাততালি-সিটি-হুল্লোড়। সে এক উৎসব উৎসব অবস্থা। 

যেকোনো সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পরেই উৎসব উৎসব এক ভাব হয় উপমহাদেশে। বাংলাদেশে এই উৎসবের মাত্রা খানিকটা কম হলেও ভারতে এই উৎসবই আবার মাত্রাছাড়া হয়ে যায়। শাহরুখ, সালমান বা আমির...এই খানদের মধ্যে যে কারো সিনেমা মুক্তি পেলেই মন্দিরে মন্দিরে পূজা, সিনেমাহলের সামনে ভক্তকুলের অপেক্ষার পশলা পশলা দৃশ্য মেলে। সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমার ক্ষেত্রে সে পাগলামি আরো এক কাঠি সরেস। রজনীকান্ত, মোহনলাল, ম্যামোথি কিংবা দুলকার-বিজয়ের সিনেমা মুক্তি মানেই হুল্লোড়, পাগলামি, উন্মাদনা।

কিন্তু গত দেড় দুই বছরের চিত্রপট যদি লক্ষ্য করা হয়, দেখা যাবে, মহামারীর প্রকোপে সামগ্রিক পরিস্থিতি পালটে গেছে অনেকখানি। মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়েছে মাস্ক, স্যানিটাইজার, গগলস। যাপিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কর্মক্ষেত্র-রেস্তোরা সব ঢুকেছে ঘরে। মোবাইল-ল্যাপটপ-ট্যাবলেটের বদান্যতায় সিনেমাহলও নিরিবিলি অবসরে ঢুকে পড়েছে মানুষের পকেটে। অগুনতি সিনেমাহল মাসের পর মাস বন্ধ। অনেক সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় স্থির হয়ে বসে থাকতে থাকতে দেহের নীচে শেকড়বাকড় গজিয়ে ফেলেছে। গরম-গরম সিনেমাগুলো আজকাল ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাচ্ছে। মানুষজন হাপুশ-হুপুশ করে সেগুলোকে গিলে নিচ্ছে ঘরে বসেই। 

'ওটিটি'র এই উত্থানে ভেঙ্গে যাচ্ছে খুব শক্তপোক্ত এক ন্যারেটিভও। যে ন্যারেটিভের মোদ্দাকথা- সুপারস্টার থাকলেই সিনেমা হিট! ওটিটির এই জাগরণ দেখাচ্ছে-  ভাটার টান শুরু হয়েছে তথাকথিত সুপারস্টারদের ফ্যানবেজেও! অমুক স্টার যে সিনেমাই করুক না কেন, তা সুপারহিট হবে, অমুক খানের বস্তাপঁচা সিনেমাও বক্স অফিস কাঁপাবে...এ বদ্ধমূল ধারণাগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে নিয়মিত। যে বিষয়টি টের পাচ্ছেন এই সুপারস্টাররাও। বলিউডের তিন খানের মধ্যে অন্যতম শাহরুখ খান যেমন নিজের অস্বস্তি লুকোননি মোটেও। স্বীকার করেছেন, ওটিটির এই দাপটে খানিকটা অস্তিত্ব-সংকটে তিনিও ভুগছেন। তার সমসাময়িক সব সহকর্মীরাই স্ট্রিমিং সাইটে চলে এসেছে। তিনিই এখনো আসেন নি। এটাই তার ভয়ের কারণ। 

যদিও এটা ভাবার কোনোই অবকাশ নেই, ওটিটির এই জাগরণে, কন্টেন্টের এই মহাসমুদ্রের মহাতরঙ্গের দাপাদাপিতে শাহরুখ খান কে সবাই ভুলে যাবে। কিন্তু বোঝার বিষয় এটাই, তাঁর মত দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী অভিনেতাও সে ভয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন, যে ভয় একজন মাঝারি মাপের অভিনেতার নিত্যসঙ্গী। ওটিটির চমক এখানেই। সিনেমাহলে যখন একটা সিনেমা আসে, চারপাশে অজস্র মানুষ, হাজারকম শব্দ, সিনেমাহলের আলো-আঁধারির গিমিক...সবমিলিয়ে যুক্তি-তর্ক সেখানে সাময়িক পক্ষাঘাতগ্রস্ত। অনেক মাঝারি মাপের সিনেমাও এই শোরগোলের ফাকতালে বাজিমাত করে বেরিয়ে যায়। জনপ্রিয় হয়। কিন্তু ওটিটি'তে যখন কোনো সিনেমা-সিরিজ আসে, অধিকাংশ সময়েই যেটা হয়, মানুষজন পূর্ন মনোযোগ দিয়ে দেখার অবকাশ পায় নির্মানটিকে। নির্মাণ ভালো না লাগলে সরিয়ে ফেলার পূর্ণ সুযোগ থাকে তার। যুক্তি, তর্ক, রুচিবোধ...সবকিছুর মিলিত ফলাফলে, ওটিটি'র কন্টেন্ট নির্দিষ্ট মানে না পৌঁছালে তা দর্শককে সন্তুষ্ট করতে পারে না। সুপারস্টার আর সস্তাগল্প দিয়ে আর যাই হোক, ওটিটি'তে টিকে থাকা যায় না। এটাই ধ্রুবসত্যি। 

এবং ঠিক এটাই গড়ে দিচ্ছে প্রধানতম পার্থক্য। এখন যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বর্তমান সময়ে সুপারস্টার আসলে কে, উত্তর হিসেবে কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম আসবে না। বর্তমান সময়ে সুপারস্টার যদি কেউ হয়ে থাকে, তা অবশ্যই গল্প, নির্মাণ, অভিনয়। বলিউডের অন্যতম গুণী অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ীও একমত পোষণ করেন কথাটির সাথে। 'ফ্যামিলি ম্যান-টু' এ দুর্দান্ত অভিনয় করে এ অভিনেতা এখন বেশ সদর্পেই টিকে আছেন ওটিটির এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে। তার অভিনীত 'সাইলেন্স: ক্যান ইউ হিয়ার ইট' এবং 'ডায়াল ১০০' মুক্তি পেয়েছে স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে৷ মনোজ বাজপেয়ী এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছিলেন- 

আজ যদি মুম্বাইয়ের রাজা কেউ হয়ে থাকে, তা হচ্ছে এই ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। তারাই রাজত্ব করছে এখন। 

'ফ্যামিলি ম্যান টু' এ দারুণ অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপেয়ী! 

কথাটা যে সর্বৈব সত্যি, তা মেনে নিচ্ছেন বাদবাকি অভিনেতারাও। অক্ষয় কুমারের 'লক্ষ্মী' সিনেমা মুক্তি পেয়েছে স্ট্রিমিং সাইটে। 'বেলবটম'ও খুব শীঘ্রই আসবে ওটিটি-সিনেমাহলে। সালমান খানের 'রাধে'ও একই পথের পথিক। অজয় দেবগন, স্ট্রিমিং সাইটের জন্যে ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেছেন। শাহরুখ খানও এক স্ট্রিমিং সাইটের ওয়েব সিরিজের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। শহীদ কাপুর ওয়েব সিরিজে কাজ শুরু করেছেন। পঙ্কজ ত্রিপাঠী কিংবা গজরাজ রাও এর মতন সিদ্ধহস্ত অভিনেতারা মহামারীর প্রথম থেকেই স্ট্রিমিং সাইটের সাথে যুক্ত আছেন।

এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়, সুপারস্টাররা ক্রমশ তাদের নির্মাণ নিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এলেই যে সেই নির্মাণগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে, বিষয়টি মোটেও সেরকম সোজাসাপ্টা নয়। সালমান খানের 'রাধে' সিনেমা ফ্লপ হয়েছে। তীব্র বিদ্রুপের শিকার হয়েছে সিনেমাটি। অক্ষয় কুমারের 'লক্ষ্মী' কিংবা সঞ্জয় দত্তের 'সাদাক টু' নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ, স্টারডম কিংবা 'সুপারস্টার' তকমা গোত্তা খেয়ে পড়ছে ওটিটির মানদণ্ডের সামনে। মূখ্য হয়ে উঠছে অভিনয়, গল্প, নির্মাণশৈলী। আর কেউ না। আর কিছু না। 

সালমান খানের 'রাধে' হয়েছে ফ্লপ! 

ওটিটির এই সময়ে বলিউডের কোনো একজন অভিনেতা যদি সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন বলে ধরা হয়, তবে সে অভিনেতা হবেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী। মির্জাপুর টু, গুঞ্জন সাক্সেনা, লুডু, মিমি...দারুণ দারুণ সব নির্মাণের ফ্রন্টলাইনে ছিলেন তিনি। মানুষজন ভূয়সী প্রশংসাও করছে তার অভিনয়ের। গুণী অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠীও যেমন জানাচ্ছিলেন এক সাক্ষাৎকারে- 

ওটিটির সামনে বক্স অফিস কিংবা পাগলামির কোনো দাম নেই। এখানে দর্শক একটা বিষয়ই শুধু জিজ্ঞেস করবে, সিনেমাটা ভালো নাকি খারাপ? মানুষজন এর বাইরে আর কিছু ভাববে না। ভাবছেও না। 

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম একাই কাঁপাচ্ছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী! 

নেটফ্লিক্স, অ্যামাজনেরা খুব নীরবেই যেন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কঙ্কাল খোলনলচে পালটে দিয়েছে। ওপেনিং ডে বিজনেস, বক্স অফিস, থোড়-বড়ি-খাড়া গল্পে সুপারস্টার কাস্ট করে দর্শককে বোকা বানানো, ...এই বিষয়গুলো ক্রমশই হারিয়েছে প্রাসঙ্গিকতা। মানুষ মুখের বদলে গুরুত্ব দিচ্ছে গল্পকে, অভিনয়ের সৌকর্যকে। কার কতটুকু জনপ্রিয়তা, কে কতটুকু এন্টারটেইনার...এসব অতীত হয়েছে। গত বছরের তুমুল জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ 'স্ক্যাম ১৯৯২' মুক্তির পর যেমন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এলেন প্রতীক গান্ধী। রাতারাতি অভিনয়ের সৌকর্য দিয়ে জনপ্রিয় হলেন। অথচ স্বাভাবিক সময় থাকলে এরকম জনপ্রিয়তা পেতে তাকে আরো কত কাঠখড় পোড়াতে হতো, সে বিলক্ষণ ভাবনার বিষয়। অথবা বলা যেতে পারে জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ 'পাতাল লোক' এর প্রোটাগনিস্ট জয়দীপ আহলাওয়াত এর কথাও। ওটিটির এরকম বাড়বাড়ন্ত না থাকলে, কতদিনে তিনি এরকম জনপ্রিয়তা পেতেন?

সুতরাং, এটা বলা হয়তো ভুল না, ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো একটা 'লেভেল প্লেয়িং ফিন্ড' তৈরী করে দিয়েছে সবার জন্যে। 'কেহ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান' এক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যেসব অভিনেতাকে স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে নিয়মিত দারুণ সব নির্মানে অনবদ্য অভিনয় করতে দেখছি, এই মানুষগুলোই আর কিছু বছর আগেও সামান্য লাইমলাইটের জন্যে বিস্তর হাপিত্যেশ করেছেন। ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো এই গুণী মানুষদের নিয়ে এসেছে ফ্রন্টলাইনে। তাদের দিচ্ছে যোগ্য সম্মানও। যদিও এ আশঙ্কা আছেই, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো আবারও সুপারস্টাররা বক্স-অফিসের প্রধান প্রভাবক হয়ে উঠবেন। হয়তো আবারও যেকোনো নির্মাণে মেধাকে ছাপিয়ে প্রোটাগনিস্ট হয়ে উঠবে জ্বলজ্বলে মুখ! তবে এও ঠিক, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কী হবে, সে আমরা কেউই জানি না। সবই অনিশ্চিত। তবে গুরুত্বপূর্ণ এটাই, 'ওটিটি' নামক চকমকি পাথরের সংস্পর্শে এসে দর্শকের রুচিবোধ, মস্তিষ্ক এবং চিন্তাভূমি আগের থেকে ঢের বেশি সজাগ হয়েছে, ক্ষুরধার হয়েছে।

স্ট্রিমিংসাইটগুলোই আজ গড়ে দিয়েছে পার্থক্য! 

শেষে এসে বলা যেতে পারে অক্ষয় কুমারের কথাগুলোই-

স্টার পাওয়ার বলে কিছু নেই। পাওয়ার হয় স্ক্রিপ্টের। স্ক্রিপ্ট ভালো হলে হ্যাঁ বলতে হবে, কাজ করতে হবে। ভালো গল্প হলে দর্শক অবশ্যই সাড়া দেবে।

ঠিক এই বিষয়টিকেই বাস্তব করে দেখিয়েছে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। গল্প, অভিনয় আর নির্মানশৈলীকে ফ্রন্টলাইনে রেখে সিনেমা-ইন্ডাস্ট্রির অর্থোডক্স সব ন্যারেটিভকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে তারা। বোঝাচ্ছে, নির্মাণের দক্ষতাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। আর কিছু না। আর কিছু প্রাসঙ্গিক হতেও পারে না! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা