ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি পরিচালকদের নির্মিত অজস্র দুর্দান্ত সিনেমা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সব চলচ্চিত্র উৎসবে নিয়মিতই অংশ নেয়। মানচিত্রের যে খণ্ডের মানুষেরা এত সুন্দর সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, সে খণ্ডই কেন বারবার ভিজে ওঠে উত্তপ্ত তরলে, সে প্রশ্নের উত্তর বরাবরই অজানা...

একটি দেশ ভেঙ্গে দুটো টুকরো; ইসরাইল-ফিলিস্তিন। আটচল্লিশের পর থেকে সময়ে অসময়ে দ্বন্দ্বে মেতেছে তারা। বলাই বাহুল্য, যে দ্বন্বের কখনোই মধুরেণসমাপয়েৎ ঘটেনি। তিক্ততা, বিদ্বেষ, শোণিত স্রোত ক্রমশই বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়েও ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তিই দেখি যেন আমরা। হামলা, পালটা হামলায় ফুঁসছে একে অন্যের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা মানচিত্রের নিকটতম প্রতিবেশিরা। এরকমই এক ডামাডোলে লিখতে বসেছি, ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মিথস্ক্রিয়ার গল্পে নির্মিত পাঁচটি সিনেমা নিয়ে। এ সিনেমাগুলো দেখে হয়তো দুই অঞ্চলের দ্বন্দ্বমুখর প্রাচীন ইতিহাসের সেরকম স্বচ্ছ জ্ঞান পাওয়া যাবে না, তবে নিকটবর্তী এই দুই অংশের মানুষের যাপিত জীবনের খানিকটা ধারনা পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। সেটাই উদ্দেশ্য। সেজন্যেই কলম ধরা। 

শুরু করা যাক। 

1. Wedding in Galilee 

মাইকেল খেলেফি'র লেখা ও পরিচালনার 'ওয়েডিং ইন গালিলি' বা 'উরস-আল-জলিল' সিনেমার কনসেপ্ট বেশ সুন্দর। এক ফিলিস্তিনি অধিবাসী তার ছেলের বিয়ের সময়ে দুই অঞ্চলের মধ্যে চলমান কারফিউ সাময়িকভাবে স্থগিত করার জন্যে ইসরাইলি মিলিটারির কাছে আবেদন জানায়। মিলিটারিরা সে প্রস্তাবে রাজি হয় একটাই শর্তে- এই বিয়েতে তারাও আসবে। ছেলেটির বাবা রাজি হয়। এই রাজি হওয়া নিয়ে শুরু হয় বিপত্তি। ছেলে বিরক্ত হয় বাবার এই আপোষকামিতায়। ফিলিস্তিনের বিয়েতে ইসরাইলি সামরিক জান্তাকে নিমন্ত্রণ জানানোতে খুশি হতে পারেনা কেউই। 

ঘনিয়ে আসে বিয়ের দিন। যথারীতি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর কিছু অফিসারও আসেন বিয়েতে। উৎসব আর প্রথাপালনের মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে বিয়ের অনুষ্ঠান। তবে এরমধ্যেও থমথমে অস্বস্তির বাতাবরণও কাটেনা মোটেও৷ আচমকা কিছু মাথা গরম আরব-যুবক আক্রমণ করে বসে ইসরাইলি অফিসারদের৷ দুইপক্ষের হাতাহাতি আর আঘাত-পাল্টা আঘাতে নিমেষেই 'বিয়ে-বাড়ি' পরিণত হয় রণক্ষেত্রে৷ গল্প এরপর যেতে থাকে অপ্রত্যাশিত সব সড়কে। এই গল্পের সাথে ক্রমশ যুক্ত হয় যৌনতা, আকাঙ্খা, হতাশা...নানা উপকরণ।

এই সিনেমাটিকে অনেকেই 'নগ্নতা'র অজুহাতে এড়িয়ে চলেন। তবে মূল গল্প, ঘটনার পারস্পরিকতা এবং ডার্ক মেটাফোর... সবকিছু বিবেচনায় এ সিনেমা অবশ্যই 'ওয়াচলিস্ট' এ থাকার মতন। 

2. Paradise Now 

দুইজন ফিলিস্তিনি যুবকের গল্পই এই সিনেমার উপজীব্য। এই দুই যুবক যখন সুইসাইড বোম্বার হিসেবে যাচ্ছে একটি মিশনে, তখন তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। সে কথাবার্তায় ক্রমশ উঠে আসে জীবনদর্শন, আদর্শ, যাপিত সমাজব্যবস্থা নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। 

হানি আবু আসাদের সিনেমা 'প্যারাডাইজ নাউ'  দেখতে দেখতে দর্শক বুঝতে পারে, তারা ক্রমশই এই দুই চরিত্রের জন্যে সমব্যথী হচ্ছে, এই দুই চরিত্র যে ঘৃণ্য কাজ করতে যাচ্ছে, সেজন্যে তাদের উপরে বিতৃষ্ণা হবার কথা। কিন্তু, হয়ে যায় উল্টোটা। খুব দারুণভাবে এই বিষয়টা দর্শকদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়েছেন পরিচালক। যদিও অতিরিক্ত কোনো আবেগী দৃশ্য বা কথাবার্তা তিনি আনেননি পর্দায়। তবুও, কিছু রূঢ় সত্যই যেন ভেতরটা গলিয়ে দেয়ার জন্যে হয়ে যায় যথেষ্ট৷ 

কথোপকথনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বার্তা, কিছু নগ্ন সত্য, কিছু রাজনৈতিক নোংরামির সুরতহাল, কিছু মেটাফোর ছিলোই। সে সাথে ছিলো কিছু ড্রামাটিক টুইস্টও। কাহিনী আগে থেকে প্রেডিক্ট করতে চাইলেও, শেষে এসে একটু ধাক্কা পেতেই হবে। অন্তিম পরিণতি নিয়েও হতে হবে একটু গলদঘর্ম। এ সিনেমার তাৎপর্য এখানেই। সে সাথে এই অঞ্চলের সংকট নিয়ে সাধারণ দর্শককে সচেতন করারও এক প্রয়াস 'Paradise Now.' 

3. The Time That Remains 

বিখ্যাত পরিচালক এলিয়া সুলেমান এর 'দ্য টাইম দ্যাট রিমেইনস' বেশ জনপ্রিয় এক সিনেমা। 'কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল'এ দেখানো হয়েছিলো সিনেমাটি। আরো বেশ কিছু ফিল্ম ফেস্টিভালেও মনোনয়ন পেয়েছিলো 'দ্য টাইম দ্যাট রিমেইনস।' 

১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইসরাইলের উত্থান ও ব্যাপ্তির নানা দিক নিয়ে এই সিনেমা৷ তবে যদি কেউ ভেবে থাকেন, এই সিনেমায় ইতিহাস নিয়ে বিস্তর কপচানি আছে, ফিলিস্তিনি-ইসরাইলের দ্বৈরথ নিয়ে প্রচুর তথ্য আছে, তাহলে ভুল ভাবছেন। 

এ সিনেমায় পরিচালক তার বাবা-মা'র অভিজ্ঞতায় ইসরাইলের উত্থান ও বর্তমানকে ন্যারেট করেছেন। সে হিসেবে এটিকে সেমি-বায়োফিকশন বললেও বলা যেতে পারে। দুইজন মানুষের বয়ানে দেখানো হচ্ছে একটি দেশের উত্থানের গল্প। ১৯৪৮ সালের পরে কিভাবে সমাজ,সংস্কৃতি, অর্থনীতি পালটে গেলো এই দুই অঞ্চলের, আস্তে আস্তে কিভাবে বিষবাষ্প জমাটি হলো এই ভূগোলে, সেসবই নানা সুখস্মৃতি, অসুখস্মৃতি'র মলাটে দেখানো হলো পর্দায়। নষ্টালজিয়া, ইতিহাস, বিষাদ, গল্প...সবমিলিয়ে দুর্দান্ত। মুগ্ধ হবার মতই একটি কাজ। 

4. Amreeka

স্বামীর কাছ থেকে বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান অভিবাসী এক মা তার সন্তানকে নিয়ে পাড়ি জমান আমেরিকায়। একটু নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় পাড়ি দেন শত শত মাইল। আমেরিকার ছোট্ট শহর ইন্ডিয়ানায় আশ্রয় নেন এই দুই প্রাণী। মায়ের স্বপ্ন, সন্তানকে নিয়ে আস্তে আস্তে শক্তপোক্ত করবেন নিজেদের ঘাঁটি৷ আমেরিকাতেই টিকে থাকবেন আমৃত্যু 

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর, হয় আরেক। আমেরিকায় আসার পরেই তাদের সুখস্বপ্নে ছেদ আসে। নাইন ইলেভেনের ম্যাসাকার শেষ হয়েছে সম্প্রতি। আমেরিকার মানুষজন মুসলিম এবং আরব দেখলেই শিউরে উঠছেন। তীব্র ঘৃণার সংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সবখানে। 

আস্তে আস্তে এই অসহায় মা বুঝতে পারলেন, বড় অসময়ে এসেছেন তিনি এই দেশে। কিন্তু এখন কী করবেন? এই শ্বাপদসংকুল জনঅরণ্যে টিকেও বা থাকবেন কিভাবে! কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যান তিনি৷ গল্প শুরু এরপরেই। 

এরকম কনসেপ্টের আরো সিনেমা আছে। এই মুহুর্তে যেমন মনে পড়ছে 'The Reluctant Fundamentalists' সিনেমার কথা। সেই সিনেমাও ভালো লেগেছিলো। অনবদ্য 'Amreeka'ও। জাতিগত হিংসা, দ্বেষ কতটা চরমে উঠতে পারে, সেটারই এক সুলুকসন্ধান দেবে এই চলচ্চিত্র। 

5. Solomon's Stone 

ইসরাইলের পোস্ট অফিস থেকে আচমকা একদিন একটা চিঠি পায় ফিলিস্তিনি যুবক হুসেইন৷ যেখানে বলা হয়, তার জন্যে একটি জিনিস পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সে জিনিসটা পোস্ট-অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হলে তাকে খরচ করতে হবে ২০,০০০ ডলার! 

রামজি মাকদিসি'র ২৫ মিনিটের এই শর্টফিল্মটি বেশ ইন্টারেস্টিং। 'ডার্ক কমেডি' ঘরানার এই গল্পে কাহিনীর ঘনঘটায় হুসেইনের উত্থানপতনের গল্পও বেশ অন্যরকম৷ হুসেইন যখন পোস্ট অফিস থেকে এই খবর পায়, প্রবল কৌতূহলের বশেই সে শুরু করে বিশ হাজার ডলার জোগাড়ের কাজ। ঘরে যা ছিলো, সবকিছু বিক্রি করা শুরু করে সে৷ সহায়সম্বল, ঘটিবাটি সব। হুসেইনের মা তাকে লোভ করতে মানা করে। ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রি করতেও নিষেধ করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? হুসেইন ভাবে, এই পার্সেলেই আছে তার জীবন বদলের চাবিকাঠি। সেজন্যেই ক্ষিপ্রগতিতে সে এগোতে থাকে পার্সেলের জন্যে টাকা জোগাড়ের উদ্দেশ্যে৷ একপর্যায়ে সে টাকা সংগ্রহ করেও ফেলে। সেই বড়সড় বাক্সটিও নিয়ে আসে বাড়িতে। কিন্তু কী আছে বাক্সের ভেতরে? খুলতে গিয়েই চমক। 

এই শর্টফিল্মের কাহিনী বেশ অন্যরকম! 

এই শর্টফিল্ম ভালো লাগবে অনেক কারণে। ডার্ক কমেডির এক আলাদা মিশ্রন তো আছেই। সে সাথে ঘটনার ঘনঘটা ও ইনার কিছু মেসেজ এর কারণেও ভালো লাগবে 'সলোমন'স স্টোন।' 

ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি পরিচালকেরা দারুণ প্রতিভাবান। তাদের নির্মিত অজস্র সিনেমা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সব চলচ্চিত্র-উৎসবে নিয়মিতই অংশ নেয়। মানচিত্রের যে খণ্ডের মানুষেরা এত সুন্দর সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, সে খণ্ডই কেন বারবার ভিজে ওঠে উত্তপ্ত তরলে, সে প্রশ্নের উত্তর কারো কাছেই নেই। তবু আশা রাখি, এই প্রতিভাবান ভূখণ্ডে বুলেটের খোসা ছাপিয়ে গজিয়ে উঠবে মননশীলতার একেকটি বৃক্ষ। হয়তো একদিন এই সিনেমাগুলোই নিয়মিত বাড়তে থাকা সংঘাতের পরিস্থিতিকে থামিয়ে দেবে। স্তব্ধ করে দেবে ঘাতকের অস্ত্র। কায়মনোবাক্যে এটাই প্রার্থণা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা