প্যান ইন্ডিয়ান ফিল্ম: দ্য নেক্সট বিগ থিং!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ভারতীয় সিনেমাগুলোর অধিকাংশই প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা। কেজিএফ (চ্যাপ্টার টু), আরআরআর এর মতো তুমুল প্রত্যাশিত সিনেমাগুলো আসবে সামনে। ভারতের সংস্কৃতি জগতের যে প্রাদেশিক কাঁটাতার, এই সিনেমাগুলো সেগুলোকে ক্রমশ অদৃশ্য করবে, ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মধ্যবর্তী উত্তাপ কমাবে, প্রত্যাশা এটাই!
'পুষ্পা: দ্য রাইজ' সিনেমা নিয়ে বেশ অনেকদিন ধরেই তুমুল মাতামাতি হচ্ছে। দর্শকেরা অপেক্ষা করে আছেন, কবে 'পুষ্পা' মুক্তি পাবে, এবং তারা সশরীরে সিনেমাহলে গিয়ে এই সিনেমা চাক্ষুষ পরিদর্শন করবেন। তাদের এ উৎসাহের পারদকে আরো কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে এ সিনেমা-সংশ্লিষ্ট মানুষজনও। নির্মাতা সুকুমার যেমন বললেন, এই সিনেমার পরে হিরো আল্লু আর্জুন কে মানুষ অন্য পরিচয়ে চিনবে। এমনিতেই তাকে 'স্টাইলিশ স্টার' ডাকা হয়। নির্মাতার দাবী, এ সিনেমার পরে আল্লু অর্জুন 'আইকন স্টার' নামে জনপ্রিয় হবেন।
এতসব শুনেটুনে এটা ভাবার মোটেও দরকার নেই, এই সিনেমায় একাই রাজত্ব করবেন তিনি। 'পুষ্পা' সিনেমার সাম্প্রতিক পোস্টারে ফাহাদ ফাসিল এর লুক আবার এটাও বুঝিয়ে দিচ্ছে, টক্কর হবে সমানে সমানে। এমনিতেও চোখ দিয়ে অভিনয় করেন বলে বেশ সুখ্যাতি আছে তার। চকচকে কামানো মাথা আর অন্তর্ভেদী চোখের কটাক্ষ নিয়ে যে অবতারে এলেন তিনি, পিলে চমকানোর উপক্রম হলো। তেলেগু সিনেমায় প্রথমবারের মতন অভিষেক হচ্ছে ফাহাদ ফাসিলের। অভিষেকের তোড়জোড় যে দুর্দান্ত আয়োজনে এগোচ্ছে, তা পোস্টার থেকে দ্রষ্টব্য। তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির আল্লু অর্জুন এবং মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির ফাহাদ ফাসিলের এই দ্বৈতশৈলী দেখার জন্যে সবাই যে মুখিয়ে থাকবে, তাতেও সন্দেহ নেই একবিন্দু।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা ভিন্ন। ভাষাজনিত এ জটিলতার কারণে অনেক সময়েই দেখা যায়, কোনো একটা ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা মুক্তির পরে শুধুমাত্র স্থানীয়রাই তাৎক্ষণকিভাবে সে সিনেমা দেখতে পারছেন। অন্য প্রদেশের মানুষেরা সে সিনেমা দেখার এবং বোঝার সুযোগ পাচ্ছেন দেরীতে, তাও অনেকক্ষেত্রে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে, ডাব এবং সাবটাইটেলের দিকে! নির্মাণ-সংক্রান্ত বানিজ্যের ক্ষেত্রে ভাষাজনিত এই জটিলতা বেশ বড়সড় এক প্রতিবন্ধকতা। এটার কথা ভেবেই ভারতে বেশ কিছু বছর ধরে একটা মুভমেন্ট হচ্ছে। মুভমেন্টের নাম- প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা মুভমেন্ট। এই মুভমেন্টের মোদ্দাকথা এটাই, সিনেমা একাধিক ভাষায় মুক্তি দিতে হবে। এবং যেসব সিনেমাকে 'প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা' বলে আখ্যা দেয়া হবে, সেসব সিনেমা হিন্দি, তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম সহ বহু ভাষায় মুক্তি পাবে৷ প্রথমে যে সিনেমার কথা বললাম; পুষ্পা- এই সিনেমাটিও প্যান ইন্ডিয়ান ঘরানার সিনেমা।
ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, প্রথম প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমার নাম- মহিষাসুরমর্দিনী। তেলেগু এ সিনেমা মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। মোট আটটি ভাষায় মুক্তি পাওয়া এই বিশেষ সিনেমার পরে বহুদিন 'প্যান ইন্ডিয়ান ফিল্ম' নিয়ে ভারতে সেরকম কোনো কাজ হয় নি। ২০১৫ সালে প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা আবারও আলোচনায় আসে। এস এস রাজমৌলির 'বাহুবলি: দ্য বিগেনিং' সিনেমা মুক্তির পরে নতুন করে জোরালো আলাপ শুরু হয়৷ দঙ্গল, এম এস ধোনি, বাহুবলি টু: দ্য কনক্লুশন... সিনেমাগুলোতে সফলভাবে 'প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা'র কাঠামো অনুসরণ করা হয়। দর্শকেরা ইতিবাচকভাবে নেন ব্যাপারটি। তেলেগু সুপারহিট 'কেজিএফ' মুক্তির পরে 'প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা' কনসেপ্ট পৌঁছে যায় এমন এক অবস্থানে, যেখান থেকে অবনতির আর কোনো জায়গাই থাকে না আর। 'কেজিএফ: চ্যাপ্টার ওয়ান' মুক্তির পরে তেলেগু প্রযোজকেরাও এ ধরণের সিনেমাতে অর্থলগ্নি করা শুরু করেন জোরেসোরে।
প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমার জনপ্রিয়তা বাড়ছেই। 'পুষ্পা' নিয়ে মানুষের তুমুল আগ্রহের কথা আগেই বললাম। এ বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই সিনেমা- কেজিএফ (চ্যাপ্টার টু) এবং আরআরআর... দুটিই প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা। এবং তারা মুক্তি পাবে একাধিক ভাষায়। এ প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় বলে রাখা ভালো, প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমায় একাধিক ভাষা যেমন থাকে, একাধিক ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতাও থাকে। যেমন- 'পুষ্পা' সিনেমাতে তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির আল্লু অর্জুন এবং মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির 'ফাহাদ ফাসিল' স্ক্রিন শেয়ার করবেন। রাজমৌলির 'আরআরআর' এ তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির এনটি রামা রাও জুনিয়র এবং রাম চরন এর পাশাপাশি থাকবেন বলিউডের অজয় দেবগণ এবং আলিয়া ভাট। 'কেজিএফ: চ্যাপ্টার টু'তে বেশ বড়সড় ভূমিকায় থাকবেন সঞ্জয় দত্ত। সে সাথে রাভিনা টেন্ডনও আছেন এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ এক অংশে।
এই সিনেমাগুলো ছাড়াও এ বছরে আরো বেশকিছু প্যান-ইন্ডিয়ান সিনেমা আসার কথা রয়েছে। পুরি জগন্নাথ পরিচালিত এবং বিজয় দেবরকোণ্ডা অভিনীত সিনেমা 'লাইগার, যে সিনেমার অন্যতম প্রযোজক হিসেবে আছেন করন জোহর, সেটি মুক্তি পাবে এ বছর। তেলেগু এবং হিন্দিতে একসাথে মুক্তি পাবে এই সিনেমা। প্রভাস অভিনীত 'সালার' সিনেমা আসবে সামনে, যেটি তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, কন্নড় ভাষাতে মুক্তি পাবে একসাথে। আদিপুরুষ বা রাধেশ্যাম সিনেমার কথাও বলা যেতে পারে, প্যান ইন্ডিয়ান ঘরানার এ সিনেমাগুলো মুক্তি পাবে আগামী বছর।
প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমার এই যে জোয়ার, এখান থেকে একটা বিষয় দ্রষ্টব্য, ভারতে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে কোলাবোরেশান এর এই কনসেপ্ট বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এবং কোলাবোরেশানের এই উদ্যোগে বলিউডকেও পাওয়া যাচ্ছে ফ্রন্টলাইনে। বর্তমানে বলিউডে মানসম্মত সিনেমার যে বেশ বড়সড় এক মন্দা চলছে, তা সবারই জানা। বলিউড আর্টিস্টরা তাই আজকাল প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমাগুলোতে নিয়মিত অভিনয় করছেন এবং বেশ সফলও হচ্ছেন। একটা সময়ে অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিকে যেভাবে 'তুচ্ছাতিতুচ্ছ'জ্ঞান করতো বলিউড, সেখান থেকে সরে এসে এখন তাদেরকেই অংশ নিতে হচ্ছে অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির সিনেমাশিল্পের সাথে...একে হয়তো পোয়েটিক জাস্টিসও বলে!
সামনে আসা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাগুলোর অধিকাংশই প্যান-ইন্ডিয়ান সিনেমা। এবং দর্শকেরা এই ঘরানার সিনেমাগুলোকে বেশ ভালোভাবেই সমাদর জানাচ্ছেন, উষ্ণ আপ্যায়ন করছেন। এবং এই নির্মাণগুলোর কারণেই ভারতের সংস্কৃতিজগতের যে প্রাদেশিক কাঁটাতার, সেগুলো ক্রমশ অদৃশ্যও হচ্ছে। তাছাড়া এক ইন্ডাস্ট্রির সাথে আরেক ইন্ডাস্ট্রি সংযুক্ত হওয়ার ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও অভিজ্ঞতার আদানপ্রদানও হচ্ছে। এই কনসেপ্টের আরো সৌকর্য বাড়লে, তা যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির উন্নতিকেই ত্বরান্বিত করবে, তা বলা মোটেও বাহুল্য না। এবং বর্তমানের এই অস্থিতিশীল সময়ে দাঁড়িয়ে, এরকম পারস্পরিক সহাবস্থানই কাম্য, প্রত্যাশিত।