মাসান, গুঞ্জন স্যাক্সেনা, লুডু কিংবা স্ত্রী... চরিত্রের ব্যাপ্তি ক্ষুদ্র হোক কিংবা দীর্ঘ, পঙ্কজ ত্রিপাঠী যে মুগ্ধ করবেন, তা মেনে নিয়েই পর্দার সামনে বসে সবাই। সাময়িক সময়ের জন্যে পর্দায় এসেও অভিনয়ের মায়াজালে আটকে ফেলার যে ইন্দ্রজাল, সেটা পঙ্কজের চেয়ে ভালো আর কে-ই বা জানে?
পঙ্কজ ত্রিপাঠীকে যতটা না মনে হয় অভিনেতা, তার চেয়েও বেশি মনে হয় দার্শনিক। তার সাক্ষাৎকার, কথাবার্তা, সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি দেখলেই বিষয়টি খানিকটা হলেও ধরতে পারা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নিজের অন্তর্গত এ দর্শনগুলোকে তিনি বরাবর নিয়ে আসেন তার অভিনয়েও। এ কারণে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর অভিনীত চরিত্রগুলো বরাবরই স্বকীয় দ্যোতনা দেয়। তাছাড়া একেবারে 'শূন্য' থেকে শুরু করার কারণেই কী না জানা নেই, তিনি তার অবস্থানের মূল্য বোঝেন। অভিনয়ে তাই তার থাকে পূর্ন, অখণ্ড মনোযোগ। অভিনয়-শিল্পকে তিনি বরাবর দেন পূর্ণ মর্যাদাও। লিড রোল হোক কিংবা সাপোর্টিং কাস্ট, যখনই যেভাবে সুযোগ পাওয়া যায়, স্বকীয় অভিনয়-শৈলীতে ভর করে দর্শকের আকর্ষণ আদায় করে নেওয়ার কাজে কখনোই ভুল করেন না। এটাই তার চমৎকারিত্ব।
তবু একটা বিষয়ে কৌতূহল তো থাকেই। খুব অল্পসময়ের জন্যেও যখন পর্দায় আসেন, এই নাতিদীর্ঘ সময়ে কিভাবে ঠিক পৌঁছে যান দর্শকের অন্দরমহলে? সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যে আজ তাই কথা বলা পঙ্কজ ত্রিপাঠী অভিনীত এমন সব চরিত্র নিয়ে, যারা সাইড ক্যারেক্টার হয়েও কিছু ক্ষেত্রে টপকে গিয়েছে প্রোটাগনিস্টকে। অভিনয়-শৈলীর সৌকর্যে অচ্ছুৎ করেছে বাকি সবাইকে।
১. মাসান
'মাসান' সিনেমার নানা দিক নিয়ে নানারকম কথাবার্তাই হয়। প্রেম, বিরহ, আবেগ, ভিকি কৌশল, সঞ্জয় মিশ্র, রিচা চাড্ডা, কাশী... এ সিনেমা নিয়ে কথা বলার অনুষঙ্গের অভাব নেই মোটেও। তবুও 'সাধ্য জি' হয়ে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর অল্প সময়ের যে অভিনয়, তা ভোলার দুঃসাহসও করা যাবে না। খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে এসে যে অভিনয় তিনি করলেন এ সিনেমায়, অনবদ্য!
২. মিমি
'মিমি' সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ছিলেন কৃতি শ্যানন। এ সিনেমা মুক্তির পরে কৃতি শ্যাননের প্রশংসাও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু 'ড্রাইভার ভানু' চরিত্রে ত্রিপাঠী না থাকলে এ সিনেমা হোঁচট খেতে পারতো বহু জায়গাতেই। পাল্লা দিয়েই প্রোটাগনিস্ট এর সাথে অভিনয় করেছেন তিনি। 'ওয়ান ম্যান আর্মি' হয়ে সিনেমার কিছু অংশ একাই টেনে নিয়েছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী, তুখোড় অভিনয় দক্ষতায়।
৩. লুকা ছুপি
'লুকা ছুপি'তে পঙ্কজ ত্রিপাঠীকে বড় রোল অফার করা হলেও তিনি সে অফার প্রত্যাখান করেন। এবং শেষমেশ বেছে নেন 'বদমাশ বাবুলাল' চরিত্রটিকে। এবং কেন এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্রকে বাছলেন তিনি, এ বিষয়ে তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, বাবুলাল চরিত্রটির মধ্যে দারুণ কিছু লেয়ার আছে। এই লেয়ারড চরিত্রে অভিনয় করার শখ থেকেই এ চরিত্র বেছে নেয়া তার।
৪. লুডো
এ সিনেমায় একগাদা তারকার সমাবেশ। অভিষেক বচ্চন, আদিত্য রায় কাপুর, রাজকুমার রাও, সানিয়া মালহোত্রা সহ যারাই ছিলেন এই নির্মাণে, সবাই-ই দারুণ অভিনয় করেছেন। 'কেহ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান' এ পরিসংখ্যানে তবুও সবাইকে টপকে পঙ্কজ ত্রিপাঠী এবং তার দুর্দান্ত কমেডি ছিলো ফ্রন্টরোলে। যে অত্যাশ্চর্য অভিনয় তিনি করেছেন এ সিনেমায়, তা নিয়ে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আলাদা করে আর কীই বা বলার থাকতে পারে?
৫. গুঞ্জন সাক্সেনাঃ দ্য কার্গিল গার্ল
গুঞ্জন সাক্সেনার বাবা 'অনুপ সাক্সেনা' চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর অভিনয় চোখে লেগে থাকবে অনেকেরই। প্রগতিশীল এক বাবা, যিনি মেয়ের স্বপ্নপূরণে মেয়ের সাথে লেগে থাকেন ছায়ার মতন, এ সিরিয়াস চরিত্রে যে অভিনয় পঙ্কজ ত্রিপাঠী করেছেন, তা অন্য কেউ এত নিখুঁতভাবে করতে পারতেন কী না, তা প্রশ্নবিদ্ধ এক বিষয়!
৬. বারেলি কি বরফি
'গুঞ্জন সাক্সেনা'র অনুপ ত্রিপাঠীর সাথে মিলে যায় 'বারেলি কি বরফি'র নরোত্তম মিশ্র। এ চরিত্রে আবারও অত্যাশ্চর্য অভিনয় করেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী। মেয়ের ইচ্ছে-পূরণে যে বাবা সবসময় বন্ধুর মত হাত বাড়িয়ে দেয়, সেরকম এক বাবার চরিত্রে ত্রিপাঠীর অভিনয় দুর্দান্ত তো ছিলোই। পাশাপাশি এ চরিত্র যেসব সামাজিক বার্তার সুলুকসন্ধান দিয়েছে, সেগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবমিলিয়ে 'নরোত্তম মিশ্র' অনেকদিন চোখে লেগে থাকার মতই এক চরিত্র।
৭. নিউটন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রহসন নিয়ে নির্মিত 'নিউটন' সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ছিলেন রাজকুমার রাও। তবুও যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন ত্রিপাঠী, সব আলো একাই কেড়ে নিয়েছেন। 'আত্মা সিং' নামের এক প্যারামিলিটারি অফিসার হয়ে তার যে অভিনয়, তাতে বিমুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিলোও না।
৮. স্ত্রী
'স্ত্রী' সিনেমার 'রূদ্র ভাইয়া'র কথা মনে আছে? সেই রূদ্র ভাইয়া যিনি হুটহাট একেকটা মজার কথা বলে আলগোছে হাসির বোমা ফাটিয়ে দিতেন, তাকে এত সহজে ভোলাও তো যাবে না। এ সিনেমায় রাজকুমার রাও তো দুর্দান্ত করেছেনই, কিন্তু যতক্ষণ 'রূদ্র ভাইয়া'রূপী পঙ্কজ ত্রিপাঠী ছিলেন পর্দায়, সবার সব আকর্ষণ নিজের দিকেই টেনে নিয়েছেন।
৯. ফুকরে রিটার্নস
পুলকিত শর্মা, আলি ফজল কিংবা মনজোত সিং এর মতন লিড ক্যারেক্টারকে টপকে 'বরুণ শর্মা'রূপী পঙ্কজ ত্রিপাঠীই যে বাজিমাত করেছেন এখানে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারোরই। সিনেমার কিছু ক্ষেত্রে এমনও মনে হয়েছে, ত্রিপাঠী একাই টেনে নিয়েছেন গল্পকে। 'ফুকরে রিটার্নস' সিনেমা হিসেবে দারুণ। ত্রিপাঠীর অভিনয় সিনেমাকে ছাপিয়ে আরেক কাঠি এগিয়ে দারুণ।
১০. নীল বাটে সান্যাটা
এ সিনেমায় 'প্রিন্সিপাল শ্রীবাস্তব'রূপী পঙ্কজ ত্রিপাঠীর চরিত্রের ব্যাপ্তি খুবই সংক্ষিপ্ত। তবুও এই নাতিদীর্ঘ ব্যাপ্তিতেও যে অভিনয় ত্রিপাঠীর, অনবদ্য। ফুলহাতা শার্ট ইন করে পরা, বুক পকেটে কলম, চুল পরিপাটি করে আচড়ানো, হাসিমুখ এবং মুখে নিরন্তর মোটিভেশনাল ডায়লগ...প্রিন্সিপাল শ্রীবাস্তব যেন বিন্দুতে সিন্ধু হয়েই ধরা দেন আমাদের কাছে৷ করেন মুগ্ধ।
একজন অভিনেতার সার্থকতা সেখানেই, যখন তিনি মূখ্য হয়ে ওঠেন অভিনয়ের গভীরতায়। ব্যাপ্তি যাই হোক, অভিনয়-শৈলীর উৎকর্ষের সূত্র ধরে যখন একজন অভিনেতাকে নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা হয়, তখন ধরে নিতেই হয়, সে অভিনেতা অভিনয়ের গুণগতমানে টপকে গিয়েছেন অনেককেই। সে সূত্র মেনে এ কথা ধ্রুবসত্যি, সমসাময়িক অভিনেতাদের মধ্যে মেধার দিক থেকে পঙ্কজ ত্রিপাঠী প্রথম সারিরই বাসিন্দা। অভিনয়ের অদৃশ্য সুতোয় দর্শককে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখার যে অসাধারণ ক্ষমতা তার, সে ক্ষমতা সামনে উত্তরোত্তর বাড়ুক, এ প্রত্যাশাই রইলো।