
এদেশের নির্মাতারা এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করার সাহস করেন না। কারণ তারা জানেন, এখানে এক্সপেরিমেন্ট একটু অসফল হলে, গঠনমূলক সমালোচনা তো আসবেই না, আসবে অবিবেচক আচরণ ও আক্রমনাত্মক প্রতিক্রিয়া। এদেশীয় দর্শকেরা আর যাই করুক, গঠনমূলক সমালোচনা যে কোনোদিনই করবে না, তা বোধহয় দিনের আলোর মত সত্যি...
বিশ্বব্যাপী 'ডার্ক কমেডি' জনরার প্রবল জনপ্রিয়তা। কেউ কেউ একে ব্ল্যাক কমেডি বলেন। কেউ বলেন মরবিড কমেডি বা এজি হিউমার। সোজা বাংলায়- এমন সব বিষয় নিয়ে কৌতুক বা হাস্যরস, যেসব বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলা মানা। সমাজের নানা অসঙ্গতিকে 'ডার্ক হিউমার' এমনভাবে নিয়ে আসে পর্দায়, যা দেখে ভেতরে প্রবল হাস্যরসের সৃষ্টি হবে, সে সাথে সমাজের যাপিত কুসংস্কার নিয়ে ভেতরে খানিকটা চাপান-উতোরও তৈরী হবে।
সাউথ ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক 'সুপার ডিল্যাক্স' সিনেমা আমরা অনেকেই দেখেছি। এই সিনেমা 'ডার্ক কমেডি' জনরার এক দারুণ উদাহরণ। এত এত সোশ্যাল ট্যাবুকে কী সাটল ভাবে নিয়ে আসা হয়েছে পর্দায়, মুগ্ধ হয়েছি। 'দ্য ডিক্টেটর'ও একই জনরার আরেক দারুণ উদাহরণ। সম্প্রতি দেখলাম আরেক তামিল সিনেমা 'ম্যান্ডেলা।' মানুষের ভোটাধিকার ও ভোটের জন্যে বুভুক্ষুপনা'কে যেভাবে 'ডার্ক হিউমার' এর মিশেলে নিয়ে আসা হলো, দুর্দান্ত লেগেছে। সেভেন সাইকোপ্যাথস, দ্য লবস্টার...লিখতে গেলে অনেক উদাহরণই দেয়া যাবে।

এই জনরার সমস্যা হলো, যেহেতু আগুন (পড়ুন মারাত্মক সব সামাজিক ব্যাধি) নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয় এখানে, তাই ব্যালেন্স টা গুরুত্বপূর্ণ। খুব ভারী সামাজিক বার্তাও দেয়া যাবে না, আবার জোর করে হাসানোও যাবে না। মধ্যবর্তী এক ধূসর বিন্দুতে থাকতে হবে শিল্প-স্রষ্টাকে। অনেকটা ট্রাপিজের সরু তারে দুলে দুলে রাখতে হবে ভারসাম্য। এটাই আসল চ্যালেঞ্জ।
এবার আসি দেশের প্রসঙ্গে। বিশ্বসিনেমা বাদই দিলাম, উপমহাদেশে অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তানে নিয়মিতই 'ডার্ক হিউমার' জনরার একেকটা কাজ আমরা দেখি। কিন্তু বাংলাদেশে এই কাজগুলো হয় না কেন? এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণ- আমরা খুব প্রতিক্রিয়াশীল। পানের ডগা থেকে চুন খসলেই আমরা বিরক্ত হই। হই আক্রমনাত্মক। এই শঙ্কাতেই হয়তো আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এক্সপেরিমেন্টাল কাজ হয় খুব গুনেবেছে। ঠিক একই কারণে, প্রেম-ভালোবাসা-পারিবারিক সংকট এর গতানুগতিক গল্পে এদেশের সিনেমা-নাটক আটকে ছিলো বহুদিন। ওটিটির কল্যানে এখন কিছু ভিন্নধর্মী কাজ হচ্ছে। তবে সে কাজেও ক্রমশ লক্ষ্য করি এক সহজ প্যাটার্ন। ক্রাইম, থ্রিলার, খুন-জখম। আপনি আগস্ট ১৪, ডার্ক সাইড অব ঢাকা, জানোয়ার, তাকদীর, মহানগর, মরীচিকা, বরফ কলের গল্প, কিস অব জুডাস বলুন...একই পুরাণ, একই ফ্রেম। ক্রাইম, থ্রিল, ভায়োলেন্স। এর মাঝখানে ফারুকীর 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন' একটু অন্য আশা দেখিয়ে শুরু করলেও মাঝপথে গোত্তা খেয়ে চলে আসে ক্রাইম-থ্রিলারের বহু চেনা রাস্তায়। নির্মাতাদের এই প্যাটার্ন অনুসরণ করার পেছনে এক কারণ হতে পারে, এই কাঠামোতে রিস্ক কম। থ্রিলার মানুষ পছন্দ করবেই। ফ্লপ করার সম্ভাবনা নেই।

কিন্তু, এটাও মাথায় রাখা দরকার, একই ধাঁচের গল্পে কোনো ইন্ডাস্ট্রি চলে না। শুধু আর্ট ফিল্মেও চলে না, শুধু কমার্শিয়াল ফিল্মেও চলে না। দুটিই লাগে। আবার শুধু থ্রিলারেও হয় না। শুধু ক্রাইমেই হয় না। অন্যান্য জনরাও ট্রাই করতে হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগতের পঞ্চাশ বছর পার হয়ে আসার পরেও কেউ বলতে পারবেন না, এদেশে ভালো একটা সায়েন্স ফিকশন হয়েছে, বা, ভালো একটা হরর সিনেমা হয়েছে। হয়নি।
না হওয়ার পেছনে কারণ, নির্মাতারা সাহস করেন না এক্সপেরিমেন্ট করার। কারণ, তারাও জানেন, এখানে এক্সপেরিমেন্ট একটু অসফল হলে, গঠনমূলক সমালোচনা তো আসবেই না, আসবে অবিবেচক আচরণ ও আক্রমনাত্মক প্রতিক্রিয়া। যেহেতু তাদের একেকটা নির্মানের পেছনে তাদের রুটিরুজিও জড়িত, তাই তারা এমন কোনো এক্সপেরিমেন্ট এখানে করবেন না, যেটা মানুষ খাবে না। যেটাতে ব্যবসা হবে না। ঠিক এই কারণেই আমাদের নির্মাণগুলো নিয়মিত আটকে যায় 'সহজ প্যাটার্ন' এর পুরোনো শ্যাওলায়।
চরকি'তে এলো ইউটিউমার। ডার্ক হিউমার জনরার এক কাজ। আমি মোটেও বলবো না, কাজটা 'ম্যান্ডেলা' অথবা 'দ্য লবস্টার' লেভেলের হয়েছে। স্ক্রিনপ্লে'র স্পিড অথবা ঘটনার এক্সিকিউশনের বিন্যাস নিয়ে আমারও আপত্তি আছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক, এক্সপেরিমেন্টাল কাজের প্রথমেই যে বাজিমাত হবে, সেটা তো সবসময় আশা করাও ভুল। কিন্তু এই যে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একজন নির্মাতা এক কাজ করলেন, সেটাকে একটু সমর্থন অথবা বিস্তর গঠনমূলক সমালোচনা চাইলেই আমরা করতে পারতাম। কেউ কেউ করেছিও। কিন্তু অনেকেই যেটা করেছেন, তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন কাজটিকে। এই যদি হয় আমাদের অবস্থা, কিভাবে পাল্টাবে সব?

ডার্ক কমেডি জনরার তামিল ক্লাসিক 'সুপার ডিলাক্স' সিনেমার কথা বলেছিলাম, লেখার কোনো এক অংশে। সেই সিনেমাতে খুব সুন্দর এক ডায়লগ ছিলো-
আপনি যদি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ান, বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারবেন না। স্রোতের মানুষেরা এসে হয় আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে স্রোতের দিকে। অথবা আপনাকে পিষে মিশিয়ে দেবে মাটির সাথে। আপনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সামান্য সময়ের জন্যেও টিকতে পারবেন না। এটাই নিয়ম।'
হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। যে নিয়মের ঘোরপ্যাঁচে আটকে যায় দুর্দান্ত সব নির্মাণের স্বপ্ন, আয়োজন, সম্ভাবনা। কিন্তু এর পেছনে দায়ী কে, সে বিবেচনা আপনার। লেখা বাহুল্য।