পাকিস্তানও এত ভালো সিনেমা বানায়!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

উপমহাদেশের মানুষজন যে আগ্রহ নিয়ে বলিউড, তামিল, তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির নির্মাণ অনুসরন করে, তার সিকিভাগ আগ্রহ নিয়ে ললিউডের নির্মাণ কেউ অনুসরণ করে না। তাছাড়া রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা কারণে মাঝখানের কিছু সময়ে পাকিস্তানের শিল্প-সংস্কৃতিক্ষেত্র খানিকটা অবরুদ্ধও ছিলো। তবে আশার কথা এটাই, ললিউডেও আজকাল এমন সব সিনেমা হচ্ছে, যা প্রকৃত সিনেমাপ্রেমীদের বাধ্য করছে মানচিত্রের এই বিশেষ অংশের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে...
পাকিস্তানের সাথে আমাদের নিরন্তর বৈরীতার সম্পর্কের সপক্ষে ইতিহাসের হলদেটে পৃষ্ঠা সাক্ষ্য দেবে। এবং এ বৈপরীত্যের সম্পর্কের কারণেই আমাদের অনেকের আগ্রহের পরিমণ্ডলে পাকিস্তানের নির্মাণ গুরুত্ব পায় না। আবার অপরপক্ষে এও ঠিক, সংস্কৃতির কোনো কাঁটাতার হয় না। সে হিসেবে পাকিস্তানের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করা, কড়চা করা নিন্দনীয় কোনো অপরাধও নয়। তাছাড়া কয়েক মাস আগে খোদ পাকিস্তানের এক নাটকে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করে যেভাবে বিশ্বমঞ্চকে চমকে দিয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রি, সেটিও বিস্তর ইতিবাচক। প্রশংসার।
এটা নির্জলা সত্যি, উপমহাদেশের মানুষজন যে আগ্রহ নিয়ে বলিউড, তামিল, তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির নির্মাণ অনুসরন করে, তার সিকিভাগ আগ্রহ নিয়ে পলিউড কিংবা ললিউডের নির্মাণ কেউ অনুসরণ করে না। তাছাড়া রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা কারণে মাঝখানের কিছু সময়ে পাকিস্তানের শিল্প-সংস্কৃতিক্ষেত্র খানিকটা অবরুদ্ধও ছিলো। তবে আশার কথা এটাই, সময় পাল্টেছে। ললিউড কিংবা পলিউডেও আজকাল এমন সব সিনেমা হচ্ছে, যা প্রকৃত সিনেমাপ্রেমীদের বাধ্য করছে মানচিত্রের এই বিশেষ অংশের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে। এরকমই দশটি সিনেমা, যা আমূল পালটে দিয়েছে পাকিস্তানের সংস্কৃতিক্ষেত্র, তাদের সুলুকসন্ধান নিয়েই আজকের কথাবার্তা।
১. বোল (২০১১)
'বোল' মূলত এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারের যাপিত কিছু সংকটের গল্প। পুত্রসন্তানের প্রত্যাশা, নারী অধিকার সহ নানাবিধ ক্রাইসিস সেখানে। তবে সংকটগুলো সিরিয়াস হলেও সে সিরিয়াস সংকটের উপস্থাপনা আবার মোটেও সিরিয়াস না। সেখানে হিউমার আছে, আছে মেটাফোর, সারকাজমও। পাশাপাশি চমৎকার স্ক্রিপ্ট ও দারুণ ক্যামেরা-সাউন্ডের কাজ। সব মিলিয়ে এমন এক সিনেমা 'বোল', সেখানে চমৎকার এক সামাজিক বার্তা যেমন আছে, তেমনি আছে পাকিস্তানি সিনেমা নিয়ে বিস্তর আশাবাদী হওয়ারও রসদ!

২. রামচাঁদ পাকিস্তানী (২০০৮)
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে বসবাসরত এক অস্পৃশ্য দলিত পরিবার এ গল্পের উপজীব্য। যারা পাকিস্তানের অধিবাসী। এ পরিবারের বাবা ও সাত বছরের শিশু-সন্তান একদিন ভুল করে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। এবং সেখানে গ্রেফতার হয়। এদিকে দলিত পরিবারের যে গৃহিনী, তিনি তখন পড়েছে বিপাকে। স্বামী-সন্তান আচমকা ভোজবাজির মতন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলো, তা নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এ নারী শুরু করেন বেঁচে থাকার লড়াই। পাশাপাশি স্বামী-সন্তান খুঁজে পাওয়ার সংগ্রামও থাকে জারি। দারুণ ভাবনার এ সিনেমায় জ্বলন্ত কিছু সামাজিক সমস্যা যেভাবে প্রকট হয়ে চলে আসে সবার চোখের সামনে, এখানেই এ সিনেমার সার্থকতা।

৩. জিন্দা ভাগ (২০১৩)
এ নির্মাণের উপজীব্য তিন তরুণ। যারা বাস্তবের গতানুগতিক জীবন থেকে বাঁচতে চায়। যারা চায় জীবন খানিকটা সুখের হোক৷ সমৃদ্ধির হোক। ভাগ্যের চাকা পাল্টানোর সে মিশনে একদিন বেড়িয়ে পড়ে তারা। উদ্দেশ্য- ভাগ্য পাল্টাবে। জীবন পাল্টাবে। এখান থেকেই গল্পে ক্রমশ আসতে থাকে চমক। হিউমার। সারকাজম৷ প্রাসঙ্গিক নানা সিরিয়াস ইস্যুকে যেভাবে তুলে ধরে এই সিনেমা, তা স্রেফ দুর্দান্ত। অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ডের ৮৬তম আসরে পাকিস্তান থেকে এ সিনেমা 'বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম' ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণও করে।

৪. মুর (২০১৫)
'মুর' পশতু ভাষার শব্দ। অর্থ- মা। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রধান সদস্য মা মারা যাওয়ার পরে সে পরিবারের সন্তান এবং বাবা মুখোমুখি হয় সামাজিক ও অভ্যন্তরীণ নানা দুর্নীতির। এসব বৈপরীত্যের সাথে তারা কিভাবে লড়াই করবে, এ অসম লড়াইয়ে তারা জিতবে কি না, এসব নিয়েই গল্প। মুরের মূল গল্প, এই নির্মাণের প্রোটাগনিস্টদের দুর্দান্ত অভিনয়ের পাশাপাশি তুখোড় সিনেম্যাটোগ্রাফী এ সিনেমাকে পৌঁছে দেয় ভিন্ন এক উচ্চতায়। 'অস্কার' এর ৮৮তম আসরে পাকিস্তান থেকে এই সিনেমাকে মনোনীত করা হয়েছিলো।

৫. খুদা কে লিয়ে (২০০৭)
নয়-এগারোর আক্রমণের পরে সারাবিশ্বে পাকিস্তানিরা যে বৈষম্য ও সামাজিক বিড়ম্বনার স্বীকার হয়েছিলো, তা নিয়েই মূলত এ সিনেমা। তিনটি গল্প, যে গল্পগুলো আবার পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত, তাদের মধ্য দিয়েই নির্মাতা অনেকগুলো প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে একত্রে এনেছেন৷ সেখানে ধর্মান্ধতার প্রসঙ্গ যেমন ছিলো, ছিলো উগ্রপন্থী সমস্যাও। পাশাপাশি বিদেশ-বিভুঁইয়ে পাকিস্তানিদের উপর ঢালাওভাবে চড়াও হওয়ার আখ্যান তো রইলোই। গল্প, এক্সিকিউশন, সেন্স অব মিনিমালিজম... সবকিছুর মিলিত মিশেলে এ সিনেমা বিশ্বমানের।

৬. না মালুম আফ্রাদ
কমেডি-থ্রিলার গোছের এ সিনেমায় খুব বেশি তাত্বিক কথাবার্তা নেই। তিনজন গরীব মানুষের সংগ্রামের গল্প এ সিনেমা, যেখানে এই তিনজন তাদের ভাগ্য পাল্টানোর জন্যে, বড়লোক হওয়ার জন্যে এমন কোনো কাজ নেই, যা করে না। যদিও বড়লোক হওয়ার এ মিশন মসৃণ নয়। তারা নিয়মিত বহুবিধ বিড়ম্বনার স্বীকার হন, প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। নিখাদ হাস্যরসের এ সিনেমার সাথে অনেকেই বলিউডের 'দিল্লি বেলি' কিংবা 'হেরা ফেরি'র কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন। তবে তা ধর্তব্য না মোটেও। গল্প, ক্যামেরার কাজ এবং অভিনয়... সিনেমার শুরু থেকে শেষতক দারুণ উপভোগ্য।

৭. অপারেশন টুয়েন্টি ওয়ান (২০১৪)
একুশ ঘন্টা সময়। একটি প্ল্যান। দুইজন মানুষ। ২১ ঘন্টার মধ্যে এই দুইজন মানুষ মিলে বিশেষ সে প্ল্যান বাস্তবায়িত করতে পারলে থেমে যাবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার ঐতিহাসিক যুদ্ধ। ভয়ালদর্শন যুদ্ধ থামাতে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের এই দুই মানুষ মিলে শুরু করে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এক মিশন। যে মিশনে ব্যর্থ হলে যুদ্ধের ডামাডোল শুরু হবে। নিমেষেই মারা যাবে বহু নিরীহ মানুষ। আবার মিশন সফল হলেও ক্ষতি কম না। স্পাই থ্রিলার জনরার এ সিনেমার কনসেপ্ট, সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স এবং ব্রিলিয়ান্সের জন্যে এ সিনেমা হাইলি রেকোমেন্ডেড।

৮. চাম্বাইলি (২০১৩)
পলিটিক্যাল এ ড্রামার মূল উপজীব্য কয়েকজন বন্ধু। সংকটকালীন সময়ে এই বন্ধুদের প্রণয়, সংগ্রাম, ত্যাগের গল্প নিয়ে "চাম্বাইলি' ক্রমশ এগোয় সামনে। 'পাকিস্তানি জিঙ্গোইজম'কে চাঙ্গা করে দেয়ার এ সিনেমা নিয়ে দর্শকমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও গল্প, টেকনিক্যাল দিক এবং অভিনয়ের নিয়ন্ত্রিত শৈলীতে এ সিনেমা শুধু যে উতরে যায়, তা না। বরং বেশ দুর্দান্তভাবেই উতরে যায়।

৯. ওয়ার (২০১৩)
পাকিস্তানের টেরোরিজম নিয়ে খুব প্রাসঙ্গিক ও দুর্দান্ত সিনেমা 'ওয়ার'। প্রতিটা টেরোরিজম থ্রেট ঠেকাতে পাকিস্তানি সিকিউরিটি ফোর্স কে যে পরিমাণ শ্রম দিতে হয় এবং জীবন বাজি রেখে যেভাবে প্রতিদিনের দায়িত্ব সামলাতে হয়, তা নিয়ে বেশ সম্যক এক ধারণা পাওয়া যাবে এ সিনেমা দেখলে। এই সিনেমার সিনেম্যাটোগ্রাফী, ক্যামেরার কাজ, টেকনিক্যাল এক্সিলেন্স...সব মিলিয়ে এ চলচ্চিত্র পাকিস্তানি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নেক্সট লেভেলকেই ইঙ্গিত করে। পাশাপাশি এ নির্মাণ এমন এক সমস্যাকে নিয়ে আসে ফ্রন্টলাইনে, যে সমস্যার বিষবাষ্প থেকে এখনও বের হতে পারেনি পাকিস্তান।

১০. মান্টো (২০১৫)
ভারত-পাকিস্তান পৃথক হওয়ার ডামাডোলে মুম্বাই থেকে একরকম নির্বাসিত হয়ে লাহোরে আসা বিখ্যাত উর্দু লেখক সাদাত হোসেন মান্টোর জীবনীকে উপজীব্য করে নির্মিত এ সিনেমায় দেশভাগের হিংস্র আখ্যান যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে উপমহাদেশের অন্যতম বর্ণময় লেখকের জীবন-গল্পও। সে সাথে যুগপৎভাবে এসেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খুন জখম, রক্তপাতও। অদ্ভুত সুন্দর এ সিনেমার শেষটা এমন, যা প্রত্যেক দর্শককে ভাবাবে। এবং এ সিনেমার সার্থকতাও এখানেই। বলা বাহুল্য, একই শিরোনামে বলিউডেও এক সিনেমা আছে। যেখানে 'মান্টো' চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী।

একটা সময় গিয়েছে, যখন পাকিস্তানে সারা বছরে সব মিলিয়ে দশটা সিনেমাও নির্মিত হতো না। সেখান থেকে ঘুরে এসে আজ তারা নিয়মিত সিনেমা বানাচ্ছে। সেসব সিনেমা ভূয়সী প্রশংসাও পাচ্ছে। দর্শকদের সমর্থনে ঋদ্ধ হচ্ছে। আমরা আশা করি, তারা বৈশ্বিক মানের সিনেমা নির্মাণের যে উদ্যোগ শুরু করেছে, তা সামনেও অব্যাহত থাকবে। উপমহাদেশের অন্যতম মেধাবী সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবেই তারা ক্রমশ প্রস্ফুটিত হবে, সাধারণ সিনেমাপ্রেমী হিসেবে এটিই থাকবে প্রত্যাশা।