তৌকীর আহমেদের চমক: স্ফুলিঙ্গ দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক পিন্টু ঘোষের!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

"আমার মনে হচ্ছিল আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বের হবে না। তখন বুঝলাম অভিনয় করাটা আসলে কী পরিমাণ কঠিন কাজ! অনেকেই ভাবে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে দুইটা সংলাপ বলে দিলাম- অভিনয় আর এর চেয়ে বেশি কি জিনিস?"
তৌকীর আহমেদ কখনও তারকানির্ভর সিনেমা বানান না। তার সিনেমায় মূল বিষয়বস্তু থাকে গল্প। অভিনেতাদের সবার কাছ থেকেই তিনি সেরাটা বের করে নেন, নির্মাণের মুন্সীয়ানার পাশাপাশি তৌকীরের সিনেমায় বাড়তি অনুষঙ্গ যোগ করে গানও। সব মিলিয়ে তৌকীর আহমেদের সিনেমা মানেই যেন পারফেক্ট একটা প্যাকেজ। বড়সড় তারকাদের নিজের সিনেমায় কাস্ট করে সবাইকে চমকে দেয়াটা তার কাজ নয়। তবে নিজের পরিচালিত সপ্তম সিনেমা স্ফুলিঙ্গ-তে এমন একজনকে অভিনেতা হিসেবে হাজির করেছেন তৌকীর, যার নাম শুনলে চমকে উঠবেন অনেকে। গায়ক, গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যার খ্যাতি, সেই পিন্টু ঘোষ এবার নাম লিখিয়েছেন অভিনেতা হিসেবেও।
পিন্টু ঘোষ গানের মানুষ, একদম ছোটবেলায় গানে হাতেখড়ি। ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকটা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। চিরকুট ব্যান্ডে যোগ দেয়ার পর প্রথম প্রচারের আলোয় এসেছিলেন, এই ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রায় একযুগের সংসার। এরপর ব্যান্ড ছেড়েছেন, একলা চলো রে নীতিতে চলা শুরু করেছেন। তৌকীর আহমেদের সবশেষ দুইটি সিনেমাতেই সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ছিলেন তিনি। ফাগুন হাওয়ায় সিনেমায় পিন্টু এবং সুকন্যার গাওয়া 'তোমাকে চাই' গানটা তো হয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়। একই জুটির গাওয়া হালদা সিনেমার নোনাজল গানটিও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই পিন্টু ঘোষ এবার স্ফুলিঙ্গ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি আবির্ভূত হলেন অভিনেতা হিসেবেও।
স্ফুলিঙ্গ'র গল্পটা মূলত ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণদের একটা ব্যান্ডদলকে নিয়ে। সেই গল্পে উঠে আসবে একাত্তর, আসবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও। পঞ্চাশ বছর আগের ও বর্তমানের দুটো আলাদা সময়ের গল্প বলবে স্ফুলিঙ্গ। যেহেতু গানের দলকে নিয়েই সিনেমার গল্প, আর চরিত্রটাও একজন মিউজিশিয়ানের, তাই পরিচালক তৌকীর আহমেদের মাথায় এসেছিল এই চরিত্রে পিন্টু ঘোষকে ব্যবহার করার কথা। পিন্টু নিজে যদিও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না শুরুতে, কারণ তিনি গানের মানুষ, অভিনেতা তো নন। কিন্ত ফেলতে পারেননি তৌকীরের অনুরোধ। পিন্টু ঘোষের ভাষায়-
"অভিনয় করাটা আমার পেশা না। আমি গানের মানুষ। কিন্তু যখন জানলাম দেশের গান একটা সিনেমায় থাকছে আর সিনেমাটা বেসিক্যালি মিউজিশিয়ানদের নিয়ে, তখন তৌকীর ভাইয়ের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। গানের ক্ষেত্রে অনুভূতিটা ব্যাপকভাবে কাজ করে আমার মাঝে, তখন অভিনয় করে কেমন টাকা পাব এসব জিনিস আসে না। গণজাগরণ মঞ্চের সময়ও দিনের পর দিন কোন ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই গান করেছি। কারণ একটাই- এর সাথে দেশ জড়িত। তাই তৌকীর ভাই যখন বললেন, ভাবলাম- দেখি একবার চেষ্টা করে। আর আমার ক্যারেক্টরটাও একটা মিউজিশিয়ানের ছিল, সো আলাদা করে তেমন কিছু করতে হয়নি আমাকে।"
কেমন ছিল স্ফুলিঙ্গে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা? তৌকীর আহমেদ খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তার সিনেমাগুলোর শুটিং শেষ করেন, স্ফুলিঙ্গ'র শুটিং শেষ হয়েছে মাত্র ২৩ দিনে! প্রফেশনাল অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই তো অনেক সময় গুণী এই পরিচালকের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খান। সেখানে অভিনয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা, একদম আনকোরা পিন্টু ঘোষের কি অবস্থা হয়েছিল? গানের জগতের এই প্রতিনিধি কিন্ত নিজের কাজটার চেয়েও অভিনয়কে কঠিন হিসেবে মেনে নিয়েছেন। বলেছেন, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে দুটো সংলাপ বলে দেয়াটাই অভিনয় নয়। পিন্টু ঘোষ জানালেন-
"আমার প্রথম শট নেয়া হল রাত ২.১৫ এর দিকে। গাজীপুরে শুটিং করছিলাম আমরা, খুবই শীত তখন। তার উপরে সিনেমায় শীতকাল দেখানো হচ্ছে না, তাই আমি চাইলেও গরম কাপড় পরতে পারব না। তারউপরে আমার প্রথম শটই নেয়া হচ্ছিল সুইমিংপুলের পাশে। ঠান্ডা কাকে বলে! আমার মনে হচ্ছিল আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বের হবে না। তখন বুঝলাম অভিনয় করাটা আসলে কী পরিমাণ কঠিন কাজ! বিশাল ধৈর্য লাগে আসলে। সাধারণত মনে হয়- ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে দুইটা সংলাপ বলে দিলাম- অভিনয় আর এর চেয়ে বেশি কি জিনিস? জিনিসটা যতটা সোজা মনে হয়, জিনিসটা আসলে ততটাই কঠিন। তবে ডিরেক্টর আর বাকিদের কো অপারেশন থাকলে জিনিসটা অসম্ভব কিছু না।"

সবকিছু সহজভাবে সম্পন্ন করার পুরো কৃতিত্বটা পিন্টু ঘোষ দিয়েছেন তৌকীর আহমেদকে। পরিচালকের অভয়ের কারণেই নাকি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজটা শেষ করতে পেরেছেন তিনি, পেশাদার অভিনেতা না হয়েও ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে খুব বেশি জড়তায় তাকে ভুগতে হয়নি তৌকীর আহমেদের গাউডেন্সের কারণে। পিন্টু ঘোষ জানালেন-
"ডিরেক্টর তৌকীর আহমেদ আমাকে খুবই হেল্প করেছেন। আমি গানের মানুষ। সাধারণত কোন গান গাওয়ার সময় মিউজিক ডিরেক্টরের সামনে দাঁড়ালে এখনও প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগে, গলাটা খানিকটা কাঁপে। তখন গানটা খুব একটা ভাল না হলেও মিউজিক ডিরেক্টররা বলেন- হচ্ছে হচ্ছে, আরেকবার যাই চলেন। তৌকীর ভাইও সেম জিনিসটা এপ্লাই করেছিলেন। সিনেমায় অভিনয় প্রথম বলেই তৌকীর ভাই বারবার ক্যামেরার পেছন থেকে বলছিলেন- পিন্টুদা, ঠিকঠাক আছে। এই জায়গাটা আরেকটু এভাবে দেন। তাহলেই পারফেক্ট হবে। বাকিসব ঠিকঠাক, নো টেনশন। ডিরেক্টরের এই ধরনের কো অপারেশন একজন শিল্পীকে যে কী পরিমাণ রিলিফ আর কনফিডেন্স দেয় সেটা বলার বাইরে।"
অভিনয়ে অভিষেক তো হয়ে গেল। নিয়মিত কি তাকে দেখা যাবে ক্যামেরার সামনে? এই প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই ছুটে গেছে পিন্টু ঘোষের দিকে। তিনি জানালেন, যথাযথ চরিত্রের প্রস্তাব পেলে, আর সেই চরিত্রের ভেতরে ঢোকার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাকে যথেষ্ট সময় দেয়া হলে তিনি ভেবে দেখবেন। তাড়াহুড়োর কাজ তিনি করতে চান না। পিন্টু ঘোষের ভাষায়-
"স্ফুলিঙ্গে অভিনয়ের পর অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, আমি এভাবে আরও অভিনয় করব কিনা। আসলে অভিনয় তো আমার জায়গা না, গান আমার জায়গা। তবে যদি কেউ কখনও কোন ক্যারেক্টর এপ্রোচ করে আর আমাকে যদি পর্যাপ্ত সময় দেয়, আমি তাহলে চেষ্টা করে দেখব। আমি ক্যারেক্টর হয়ে ওঠার জন্য সময় দেব। হুট করে ফোন করে কেউ বলবে- ভাই, কাল আপনার শুটিং, কস্টিউম নিয়ে চলে আসেন- সেই ধরনের কাজ আমার দ্বারা হবে না আসলে।"
একবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর পর অভিনেতাদের সম্পর্কে পিন্টু ঘোষের ধারণাই পাল্টে গেছে, বেড়েছে সম্মান। অভিনয়টা যে ছেলেখেলা নয়, সেটা বুঝতে পেরেছেন এই গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক-
স্ফুলিঙ্গে কাজ করার পর অভিনেতাদের প্রতি আমার যে সম্মান ছিল, তা আগের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেড়েছে। আমি বুঝে গেছি, অভিনয় এত সহজ জিনিস না। অভিনয়ের সময় দেয়া লাগে।"
পিন্টু ঘোষের জন্য শুভকামনা, শুভকামনা স্ফুলিঙ্গ সিনেমার জন্যেও। পিন্টু ঘোষের গাওয়া গান আমাদের মুগ্ধ করেছে, তার কথা, তার সুরে আমরা বিমোহিত হয়েছি। এবার তিনি অভিনয়েও বাজীমাত করবেন কিনা, সেটা সময় বলে দেবে। অপেক্ষা এবার স্ফুলিঙ্গ মুক্তির। মার্চের ১৯ তারিখে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে সিনেমাটি, এর আগে ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে আয়োজন করা হবে বিশেষ প্রদর্শনীর। আগামীকাল ইউটিউবে মুক্তি পাবে স্ফুলিঙ্গ'র অফিসিয়াল ট্রেলার।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা- সৈয়দ নাজমুস সাকিব