পরাণ: গল্প, অভিনয় আর গানে ঈদের 'পারফেক্ট' সিনেমা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পরাণের সবচেয়ে ভালো দিক এর অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্স। মুখ্য চরিত্র থেকে পার্শ্বচরিত্র- সবাই দারুণ অভিনয় করেছেন। রিফাত হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি- এমন খবরের কারণে 'পরাণ' অনেক আগে থেকেই আলোচনায় ছিল। এই কথাটি পরিচালক কখনও স্বীকার করেননি, অস্বীকারও করেননি। তবে পরাণের গল্পে সেই ঘটনার ছাপ আছে, এটি অস্বীকারের উপায় নেই...
বাংলাদেশে যে কয়জন নির্মাতা দর্শকের পালস ঠিকঠাক বোঝেন, তাদের মধ্যে রায়হান রাফী অন্যতম। পোড়ামন-২ এবং দহনের নির্মাতা রাফী প্রায় তিন বছরের বিরতি দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা নিয়ে সিনেমা হলে ফিরলেন আবার। 'পরাণ' নামের এই সিনেমাটি মুক্তি পাবার কথা ছিল ২০২০ সালের ভালোবাসা দিবসে। করোনার কারণে কয়েক দফায় পিছিয়ে এই ঈদে অবশেষে আলোর মুখ দেখলো শরিফুল রাজ, বিদ্যা সিনহা সাহা মিম এবং ইয়াশ রোহান অভিনীত সিনেমাটি৷ কেমন হলো পরাণ? দর্শকের পরাণে জায়গা করে নেয়ার ক্ষমতা কী আছে এই সিনেমার? ঈদের সিনেমা হিসেবে এই রোনান্টিক থ্রিলার দর্শকের চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারলো?
বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি- এমন খবরের কারণে 'পরাণ' অনেক আগে থেকেই আলোচিত। এই কথাটি পরিচালক কখনও স্বীকার করেননি, অস্বীকারও করেননি। তবে পরাণের গল্পে সেই ঘটনার ছাপ আছে, এটি অস্বীকারের উপায় নেই। পরাণ একটা ত্রিভুজ প্রেমের গল্প বলেছে। যে গল্পের পটভূমি রচিত হয়েছে মফস্বল এক শহরে।
পড়াশোনায় ভীষণ অমনোযোগী তরুণী অনন্যা, প্রতি বছর নিয়ম করে পরীক্ষায় ফেল করাটা যার রুটিন। তাকে ভালোবাসে এলাকার বখাটে যুবক রোমান। মারপিট, ইভটিজিং থেকে শুরু করে মাদক চোরাচালান- সবকিছুর সঙ্গেই জড়িত রোমান৷ অনন্যার প্রেমে পড়ে বাঁকা রাস্তায় তাকে পাশ করিয়ে দেয়ার সব বন্দোবস্ত করে দেয় রোমান। আর অনন্যাও রোমানের একপেশে প্রেমের সুযোগ নিতে থাকে। কিন্তু অনন্যা কি ভালোবাসে রোমানকে?
না, অনন্যার মনের মানচিত্র জুড়ে আছে সিফাত। কলেজের ভালো ছাত্র, কোন খারাপ অভ্যাস নেই, আদর্শ ছেলে যাকে বলে। একদিকে রোমানের উথাল পাথাল প্রেম, অন্যদিক্র নিজের ভালোবাসার মানুষ সিফাত- অনন্যা এখন কোন পথে যাবে? রোমানকে নিজের রাস্তা থেকে সরাবে কীভাবে? অনন্যার ভালোবাসার কথা জানলে রোমান কি সিফাতকে ছেড়ে কথা বলবে?
এই চরিত্রগুলোর মধ্যে চাইলে আপনি বরগুনার রিফাত, মিন্নি বা নয়ন বন্ডকে কল্পনা করতেই পারেন, সেই অধিকার দর্শকের আছে। তবে রায়হান রাফী নিজের স্টাইলে গল্প বলেছেন, চরিত্রগুলোকেও তৈরি করেছেন তার কল্পনা দিয়ে৷ যেখানে তিনজন মানুষ আর তাদের প্রেমকাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে স্থানীয় রাজনীতির নোংরা চাল, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মাদকের চোরাকারবার এবং আইন-শৃঙখলা পরিস্থিতি।
পরাণে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন শরিফুল রাজ, রোমান চরিত্রটি যেন শুধু তার জন্যেই তৈরি হয়েছিল। প্রেমে পড়ার পাগলামী, নেশা ছেড়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা, অনন্যাকে ভুলতে না পারার কষ্ট- সবকিছুই দারুণভাবে সামলেছেন তিনি। বখাটে এক তরুণ হিসেবে এই চরিত্রে তার বিকল্প কেউ হতে পারতেন বলে মনে হয় না। বেশ কয়েকটা দৃশ্যেই নিজেকে উজাড় করে দিয়ে অভিনয় করেছেন রাজ, তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স এটি, নিঃসন্দেহে।
ছোট্ট একটা দৃশ্যের কথা বলা যাক, মিম প্রতারণা করেছেন রাজের সঙ্গে। পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে রাজকে। রাজের চোখেমুখে অবিশ্বাস, আর হাহাকার। তার অনন্যা তার সাথে মিথ্যা বলতে পারে না। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা জ্বলজ্যান্ত বাস্তব। এই যে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচাল, এটা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রাজ। 'ক্র্যাক হেডেড লাভার' বলতে যা বোঝায়, রাজ ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছেন গোটা সিনেমায়। আরেকটা দৃশ্যে জেলে বন্দী রাজের সাথে দেখা করতে গেছেন মিম। সেখানেও প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার তীব্র আকুলতা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রাজ। একটা একটা ফুল জোড়া দিয়েই গোটা সিনেমায় রাজের পারফরম্যান্স আস্ত একটা মালা হয়ে উঠেছে।
বিদ্যা সিনহা মিমের চরিত্রটা ছিল 'পাশের বাড়ির মেয়ে' টাইপের, সেটাকে তিনি চমৎকারভাবে টেনে নিয়ে গেছেন। শেষ অব্দি তার চরিত্রটাই হয়ে ওঠে পুরো গল্পের চালক। কখনও আহ্লাদী প্রেমিকা, কখনও আটপৌরে গৃহবধু, কখনও আবার পুলিশি জেরার মুখে বসে থাকা অসহায় বিধবা- এই জায়গাগুলো বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন মিম। রাজ বা মিমের মতো স্ক্রিনটাইম না পেলেও, ইয়াশ রোহানও বেশ ভালো অভিনয় করেছেন।
তবে রায়হান রাফীর এই সিনেমায় সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন পার্শ্বচরিত্রের অভিনয়শিল্পীরা। রাগী বাবার চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম দারুণ, মিমের মা হিসেবে শিল্পী সরকার অপুও চমৎকার অভিনয় করেছেন। সিনেম্য যতবারই তিনি বলেছেন- 'আপনারে একটু পানি দেই?- ততবারই হাসি পেয়েছে৷ রাজনৈতিক নেত্রীর চরিত্রে রোজি সিদ্দিকীর অভিনয় মুগ্ধ করেছে। তার ডায়লগ ডেলিভারিতেই ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ পেয়েছে স্পষ্টভাবে।
সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাশেদ মামুম অপু। দুর্দান্ত এক অভিনেতা তিনি। সিনেমায় তার চরিত্রটা তোতলা এক যুবকের, এবং তোতলাদের মতো করেই প্রতিটা ডায়লগ ডেলিভারি করেছেন অপু। পুলিশ অফিসারের চরিত্রে মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন নাসিরউদ্দিন খান। তার বয়ানেই এগিয়েছে সিনেমার গল্প। কখনও তিনি হাসিয়েছেন, কখনও সাসপেন্স তৈরি করেছেন, শেষে আনার নিজেই করেছেন রহস্যের ভেদ। পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এই পারফরম্যান্সই পরাণকে স্পেশাল করে তুলেছে।
পরাণের সিনেমাটোগ্রাফি, গান এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও বেশ ভালো। সিনেমা হলে গিয়ে দর্শক যে ধরণের বিনোদন খোঁজেন, সেই বিনোদনের পুরোটাই আছে পরাণে। তবে এই সিনেমার ক্ল্যাইম্যাক্সের গাঁথুনিটা আরও ভালোভাবে বিল্ডআপ করে আনা উচিত ছিল। রোমান, অর্থাৎ শরিফুল রাজের অতীত জীবনটা আরেকটু বিস্তারিতভাবে দেখালে দর্শক হয়তো তার আগ্রাসী মানসিকতা সম্পর্কে ভালোভাবে আইডিয়া নিতে পারতো। তাছাড়া অনন্যা এবং সিফাত, অর্থাৎ মিম এবং ইয়াশের প্রেমের অংশটাও খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছে, এই জুটির প্রেমের সিগ্ধতা আরও বেশি সময় থাকতে পারতো।
তবে যেটুকু হয়েছে, তাতেই পরাণ দর্শকের পরাণে জায়গা করে নিতে সক্ষম। গল্প, অভিনয়, গান আর নির্মাণ মিলিয়ে ঈদের সিনেমা তো এমনই হওয়া উচিত!