পর্দায় যাদেরকে হাসতে দেখি, কাঁদতে দেখি, হিংস্র হতে দেখি, উদার হতে দেখি, তাদের প্রত্যেকেরই সযত্নে লুকিয়ে থাকা মানবিক গল্প আছে। 'জীবনানন্দের কালো ট্রাঙ্ক' এর মতন সে গল্পগুলো যখন হুট করেই আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়, চমকে উঠি...

বেশ কয়েকদিন আগে বিশ্বখ্যাত অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস এর জীবনীর উপরে ভিত্তি করে নির্মিত ডকুমেন্ট্রি ফিল্ম 'Robin Williams: Come Inside My Mind' দেখেছিলাম। অসাধারণ এই অভিনেতা সুইসাইড করে মারা যাওয়ার আগে লড়েছিলেন দুটি ভয়ঙ্কর রোগের সাথে। পার্কিনসন ডিজিজ এবং লিইউই বডি ডিজিজ। ডকুমেন্ট্রির এক পর্যায়ে দেখলাম, এই দুই রোগ শরীরে নিয়ে তিনি একের পর এক কমেডি শো করছেন, সিনেমা করছেন, ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। মানুষকে হাসাচ্ছেন। কাঁদাচ্ছেন। তখনই প্রথম 'অভিনেতাদের পেশাদারিত্ব' এবং 'দ্য শো মাস্ট গো অন' এই দুটি তত্ত্বের পর্দা পুরোপুরি খুলে গিয়েছিলো আমার সামনে। 

রবিন উইলিয়ামস

'রোড টু লাদাখ' নামে এক সিনেমায় ইরফান খান অভিনয় করেছিলেন। বিনা পয়সায়। গল্প সেটা না৷ শুটিং এর জন্যে দিল্লি থেকে লাদাখ যখন যাচ্ছিলেন তিনি, যাওয়ার পথে কবজি তে চোট পেলেন। ইরফান খান ডাকসাইটে স্টার, চাইলে এই চোটের জন্যে শুটিং বন্ধ করে রাখতে পারতেন কয়েকদিন৷ তা তো করেনইনি, বরং পরদিন সকালেই হাজির হয়ে গিয়েছিলেন শুটিং সেটে। পেশাদারিত্ব। 

ইরফান খান

জুনিয়র এনটিআর এর গল্প সবাই-ই জানেন। বাবা মারা যাওয়ার পরে শোকে আচ্ছন্ন থাকার বদলে যিনি হাজির হয়েছিলেন মুভির সেটে। কাকতালীয় বিষয় হলো, শুটিং এ তখন ফ্যামিলি গানের এক সিন ছিলো। শট ওকে করার পরে সেটেই প্রবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। জানান, বাবা সারাজীবন দায়িত্বশীল এক মানুষ ছিলেন৷ বাবার মৃত্যুর পরেই তাই তার স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যেই তিনি এসেছিলেন অভিনয়ের সেটে। পেশাদারিত্ব আবারও। 

জুনিয়র এনটিআর

মুগ্ধ হয়েছিলাম কাঞ্চন মল্লিকের গল্প শুনেও। নিজের মা মারা যাওয়ার পর তাকে শ্মশানে সৎকার করে পরদিনই শুটিং সেটে ফিরেছিলেন তিনি। মানুষকে হাসানোর জন্যে। একজন অভিনেতা আসলে কত ভারী সব জগদ্দল পাথর বুকে চেপে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান, এটাও তার এক উদাহরণ। এরকম উদাহরণ আছে আরো অজস্র। 

কাঞ্চন মল্লিক

এই উদাহরণগুলো টানার পেছনে কারণ আছে। একটা নির্মাণ যখন আমরা দেখি, সেটা হয়তো আমাদের কাছে নিছকই বিনোদনের এক উৎস, কিন্তু এই নির্মানগুলোর পেছনে অনেকগুলো মানুষের শ্রম, ঘাম, রুটিরুজি মিশে থাকে। যে ঝকমকে মানুষটি অভিনয় করছেন, তার একটা ব্যাকস্টোরি আছে। আর যে ম্লান মানুষটি প্রোডাকশনের সব মেম্বারের সকাল-সন্ধ্যা খাবারের তদারকি করছেন, ব্যাকস্টোরি আছে তারও। তাই খবরে যখন দেখি, গুটিকয়েক মানুষের অপেশাদারিত্বের কারণে অনেক সময়ে ভেস্তে যাচ্ছে একেকটা কাজ, বেশ বিষণ্ণ লাগে। নির্মানের জন্যেও, ঐ কাজগুলোর সাথে সংযুক্ত মানুষদের জন্যেও। 

সম্প্রতি 'মরীচিকা' ওয়েব সিরিজের ট্রেলার নিয়ে খুব মাতামাতি দেখলাম সবখানে। চোখে পড়লো আফরান নিশোর 'সাইকোপ্যাথিক রগচটা ভিলেন' রোলে অভিনয়ও। 'দানবের বিনাশ নাই' আর 'মিস মিস' বলে চিৎকার করা দুর্দান্ত অভিনয়ের পেছনে নিশোর ব্যাকস্টোরি হয়তো অনেকের জানা নেই। সেটাই বলি।

গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে শুরু হয় মরীচিকার শুটিং। আর অক্টোবরের এক তারিখেই নিজের বাবাকে হারান নিশো। চাইলে শুটিং ঝুলিয়ে দিতে পারতেন। থমকে দিতে পারতেন কাজ। মরীচিকার ট্রেলার দেখে বোঝাই যাচ্ছিলো, স্ক্রিপ্টের অনেকটা জুড়েই আছেন তিনি। তিনি অপেশাদারিত্ব দেখালে অবধারিতভাবেই প্রভাব পড়তো শুটিং এ। কিন্তু পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে ফিরেছিলেন তিনি। 'দ্য শো মাস্ট গো অন' বেদবাক্যকেও মনে করিয়েছেন সে সাথে। নিশোর এই ব্যাকস্টোরি জানার সাথে সাথে তার করা চরিত্রটির উপরে অজান্তেই আলাদা একটা শ্রদ্ধা চলে এসেছিলো। 

আরফান নিশো

পর্দায় যাদেরকে হাসতে দেখি, কাঁদতে দেখি, হিংস্র হতে দেখি, উদার হতে দেখি, তাদের প্রত্যেকেরই সযত্নে লুকিয়ে থাকা মানবিক গল্প আছে। 'জীবনানন্দের কালো ট্রাঙ্ক' এর মতন সে গল্পগুলো যখন যখন হুট করেই আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়, চমকে উঠি।

হয়তো এটাই তাদের সার্থকতা৷ নিজেদের যাপিত গল্পকে আচকানের অন্তরালে অজ্ঞাত রেখে পর্দার গল্পকে আঁকড়ে ধরে সেটাকে জ্যান্ত করে তোলাই বোধহয় তাদের অসাধারণত্ব৷ তাদের বিশেষত্বও হয়তো সেখানেই।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা