পুনর্জন্ম ২: একটি সার্থক সিক্যুয়েল ও সার্থক থ্রিলার!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

সবমিলিয়ে তাই এটাই বলার, 'পুনর্জন্ম'র দ্বিতীয় কিস্তি দেখা উচিত সবার। বাংলাদেশি নির্মাণেও যে আজকাল মুগ্ধ হওয়ার বিস্তর অনুষঙ্গ আছে, তা জানার জন্যে হলেও এ নির্মাণ রেকোমেন্ডেড। এবং একজন নির্মাতা এক বিশেষ নির্মাণের প্রথম পর্বের সাফল্যজনিত প্রত্যাশার আকাশপ্রমাণ চাপকে মাথায় রেখে যেভাবে দ্বিতীয় গল্পে আবারও বাজিমাত করলেন, ভিকি জাহেদের সে চমৎকারিত্ব জানার জন্যে হলেও এই নির্মাণ দেখার বিকল্প নেই।
একজন নির্মাতা যখন থ্রিলার বানান, তখন তাকে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। প্রথমত- শুরু থেকে শেষপর্যন্ত গতির সামঞ্জস্য। প্রথমে খুব রোলারকোস্টার গতিতে শুরু হয়ে শেষদিকে এসে গল্প যদি জরাগ্রস্ত শ্লথ বৃদ্ধের গতির সমানুপাতিক হয়, তাহলে সে থ্রিলার উপভোগ্য হবে না। দ্বিতীয়ত- উপাদানগুলোর মিশেল। এ বিষয়টি অবশ্য শুধু থ্রিলার না, সব নির্মাণের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। নির্মাণের প্লট, সাবপ্লট, স্টোরি টেলিং, ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট- সবগুলো উপাদান দারুণ এক কম্বিনেশনে থাকতে হয়। নাহলে নির্মাণ আপেক্ষিকতা হারায়। বাহুল্যদোষে দুষ্ট হয়। তৃতীয়ত, থ্রিলার গল্পের শেষে যদি বেশ বড়সড় কোনো চমক রাখার পরিকল্পনা থাকে নির্মাতার, তাহলে সে চমকের আগে প্রয়োজনীয় সব গ্রাউন্ডওয়ার্ক সেরে নিতে হয়। গল্পের শেষে এসে যে চমক নির্মাতা দেবেন, তা অনেকটা আস্তিন থেকে বের করা তুরুপের তাসের মতন। এটা দিলেই বাজিমাত। সুতরাং এই চমকের সদ্ব্যবহার করার আগে দর্শককে আরেকটু খাবি খাওয়াতে হবে। অনেকটা লেজেগোবরে করে এরপর যখন চমকের মুখোমুখি করা হবে তাকে, দর্শক কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাবে। সেখানেই ষোলোআনা তৃপ্তি।
থ্রিলারের এই তিন বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমরা বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করেছিলাম ভিকি জাহেদের গত নির্মাণ 'পুনর্জন্ম' তে। গত ঈদে এই নাটক মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই চারপাশে প্রচুর কথাবার্তা। হিসহিস। ফিসফিস। রটনা। এরপর যখন নাটকটি দেখলাম, স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, এত এত কথাবার্তা একেবারেই অমূলক না। নির্মাতা ভিকি জাহেদ যেভাবে আপাতদৃষ্টিতে সহজ-সরল এক গল্পকে ইউটার্ণ দিয়ে একেবারে ভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। যে রাফসান সাহেব (আফরান নিশো)কে 'নিষ্পাপ' ভেবে দর্শক গল্পের এক পরিণতি ভেবেছে, সেই রাফসানই শেষে এসে রূপান্তরিত হয়েছেন ঠাণ্ডা মাথার ভিলেনে। যিনি নিজের ভালোবাসার স্ত্রী'কে খুন করে সে লাশ টুকরো টুকরো করে রান্না করে মানুষকে খাওয়াতে পারেন। যিনি প্রয়োজনে নৃশংসতার সর্বোচ্চ সীমায়ও যেতে পারেন। গল্পের শুরুতে যাকে দেখেছিলাম প্রিয়জনকে হারানো এক বিপর্যস্ত মানুষ হিসেবে, শেষে এসে তিনিই যে এরকম ঠাণ্ডা মাথার খুনি'তে রূপান্তরিত হবেন, তা আর কে-ই বা ভেবেছিল!
যে ক্লিফহ্যাঙ্গারে 'পুনর্জন্ম' শেষ হয়েছিলো, সেখানে অনেক প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। অনেক বাক্য সমাপ্তবিন্দুতে পৌঁছায়নি। তাই এটা বোঝাই যাচ্ছিলো, 'পুনর্জন্ম' এর সিকুয়েলে এই প্রশ্নগুলোর হয়তো খানিকটা হলেও সুরাহা হবে। গল্পের আরো কিছু গভীর শাখা-প্রশাখার সাথে দর্শকের পরিচয় হবে। বলা ভালো, 'পুনর্জন্ম'র দ্বিতীয় পর্বে বেশ কিছু প্রশ্নের যেমন উত্তর খুঁজে পাবে দর্শক, কিছু প্রশ্ন নতুন করে আবার তৈরীও হবে।

'পুনর্জন্ম' এর দ্বিতীয় কিস্তির শুরু থেকেই আমরা দেখি খলচরিত্র রাফসান সাহেবের নানাবিধ ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড। তিনি ক্ষণেক্ষণেই চেষ্টা করেন নকল নীলা অর্থাৎ রোকেয়াকে (মেহজাবীন চৌধুরী) হত্যা করার। সে উদ্দেশ্যেই তিনি মাঝেমধ্যেই ফন্দি আঁটেন। পরিকল্পনা করেন। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। এদিকে আবার রাফসান সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার নিখোঁজ হয়েছে। পরবর্তীতে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, ড্রাইভারের এই ঘটনার সাথে রাফসান সাহেবের পরিবারের কেউ না কেউ থাকতে পারে জড়িত। সুতরাং তাদের সন্দেহের তীর ক্রমশ আচ্ছন্ন করছে বিশেষ এই পরিবারকে। এসব ছাড়াও এবারের গল্পে যুক্ত হয়েছে এক নতুন চরিত্র। নিলয়। এ চরিত্রে অভিনয় করা খায়রুল বাসারেরও বিশেষ কিছু ভূমিকা আছে এবারের গল্পে। সবমিলিয়ে তাই প্রশ্ন অনেক। রাফসান সাহেব কী এবার ধরা পড়বেন? রোকেয়ার পরিণতি কী? নিলয়ের ভূমিকা কি এই গল্পে? পুলিশ কেন সন্দেহ করছে রাফসান সাহেবের পরিবারকে?
অজস্র প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর এবারের পর্বে মিলবে না, তা আগেই উল্লেখ করেছি। নির্মাতাও ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, এ নির্মাণেরও তৃতীয় কিস্তি আসবে। সুতরাং, সব গল্প যে এখানেই পূর্নতা পাবে না, তা একপ্রকার অনুমিতই। তবে তৃতীয় পর্ব আসুক আর না-ই আসুক, এবারের পর্ব শেষে একটা কথা বলাই যায়, 'পুনর্জন্ম' এর সন্তুষ্টি বজায় ছিলো এ পর্বেও। গল্পের শেষে এসে এবারেও নির্মাতা বেশ অন্যরকম এক চমকে ঘোল খাওয়াবেন দর্শককে। এবং শুধু একটি চমক না। একাধিক চমক মুহুর্মুহু এসে আক্রমণ করবে কে। দর্শককে মুগ্ধ হতে বাধ্য করবে।

ভিকি জাহেদের গল্প বলার ভঙ্গি বরাবরই ছিমছাম, নিয়ন্ত্রিত। সেটা এবারেও ছিলো। গল্পে যদিও কিছু প্লটহোল, কিছু অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনাবলী ছিলো। তবে সেগুলোর পরিমাণ এতটাই কম, মূল গল্পের বিবেচনায়, তা ধর্তব্য না মোটেও। তাছাড়া কুশীলবেরাও প্রাসঙ্গিক অভিনয় করেছেন এখানে। খুব দুর্দান্ত অভিনয় না। যেটা দরকার, সেটাই করেছেন তারা। অভিনয়ের কোনোকিছু তাই আরোপিত বা একঘেয়ে কিংবা বিরক্তিকর না। নিশো, মেহজাবীন, নওশাবা, খায়রুল বাসার... সবাই পরীক্ষিত সৈন্য। এখানেও অভিনয়ের আদর্শলিপি বজায় রেখেই কাজ করেছেন তারা। তাদের অভিনয় নিয়ে তাই ঋণাত্মক কথা বলার সুযোগ খুব একটা নেই।
সবমিলিয়ে তাই এটাই বলার, 'পুনর্জন্ম'র দ্বিতীয় কিস্তি দেখা উচিত সবার। বাংলাদেশি নির্মাণেও যে আজকাল মুগ্ধ হওয়ার বিস্তর অনুষঙ্গ আছে, তা জানার জন্যে হলেও এ নির্মাণ রেকোমেন্ডেড। এবং একজন নির্মাতা এক বিশেষ নির্মাণের প্রথম পর্বের সাফল্যজনিত প্রত্যাশার আকাশপ্রমাণ চাপকে মাথায় রেখে যেভাবে দ্বিতীয় গল্পে আবারও বাজিমাত করলেন, ভিকি জাহেদের সে চমৎকারিত্ব জানার জন্যে হলেও এই নির্মাণ দেখার বিকল্প নেই। খুঁজতে চাইলে এ নির্মাণেও হয়তো অজস্র ভুল পাবেন অনেকে, কিন্তু, ঝাড়া হাতপা হয়ে দেখতে বসলে মুগ্ধতার উপাদানও কম পাওয়া যাবে না। 'পূনর্জন্ম' সিরিজের সার্থকতা এখানেই।