পুষ্পা: গড়পড়তা কমার্শিয়াল পটবয়লার!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

পুষ্পা'র দ্বিতীয় পর্ব কেমন হবে, তা সময়ের হাতেই ন্যস্ত। কিন্তু প্রথম পর্ব দেখে এটা খুব ভালোভাবেই অনুমান করা যায়, দুই পর্বের গল্পকে যদি একত্রে এক পর্বে এনে টানটান একটা গল্প বলা যেতো, তাহলেই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হতো। সেক্ষেত্রে এরকম অহেতুক কমিক রিলিফ, অযথা হিরোইজম আনতে হতো না। গল্পকেও এভাবে মাঝপথে ঝুলে যেতে হতো না!
'যত গর্জে তত বর্ষেনা' বলে বাংলায় যে প্রবাদ আছে, সে প্রবাদই ক্ষণেক্ষণেই মনে পড়লো 'পুষ্পাঃ দ্য রাইজ' দেখতে গিয়ে। মনে পড়ার কারণও আছে বিস্তর। গত বছর সাউথের যে কয়টি সিনেমা নিয়ে সবচেয়ে কানাঘুষো, গুজগুজ, ফিসফিস হলো, সেগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকা 'পুষ্পা' নিয়ে বোধকরি সবারই প্রত্যাশার পারদ মনুমেন্ট ছুঁইছুঁই ছিলো। আল্লু অর্জুনের প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা, সম্ভবত ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুর্দান্ত সময়ে থাকা ফাহাদ ফাসিলের ভিন্ন অবতারে আত্মপ্রকাশ, নির্মাতা সুকুমারের ম্যাগনাম ওপাস... কোনো নির্মাণে এতগুলো এক্স ফ্যাক্টর থাকলে, সে নির্মাণ নিয়ে ইতিবাচক কড়চা হওয়াটাও তো স্বাভাবিক৷ যদিও ঠিক সময়ে ট্রেলার কিংবা পোস্টার রিলিজ না দেওয়া, সিনেমার প্রোমোশনাল স্ট্রাটেজির দূর্বলতা নিয়েও ঋণাত্মক কথাবার্তা হয়েছে বেশ, তবুও আশা ছিলো, সিনেমাটা হয়তো এমনই দুর্দান্ত হবে, ছোটখাটো সব অসঙ্গতি হেলায় উপেক্ষা করা যাবে। কিন্তু আক্ষেপ সেখানেই যে, এ সিনেমার গল্প, নির্মাণশৈলী কিংবা অন্তিম পরিণতি তৃপ্তির সে ঢেঁকুর তুলতে দেয়নি, যে ঢেঁকুরে যাপিত সব আক্ষেপ নিয়ে বিস্মৃতপ্রায় হওয়া যায়।
লাল চন্দনকাঠের ব্যবসা করা একদল চোরাকারবারিকে দিয়ে শুরু হয় 'পুষ্পা'র গল্প। এই চোরাকারবারিদের দলনেতা পুষ্পা। পুষ্পারাজ৷ রাফ অ্যান্ড টাফ দলনেতা। পুলিশ থেকে শুরু করে স্থানীয় মাফিয়া, কাউকেই খুব একটা পরোয়া করে না সে। গল্প এগোয়। পুষ্পার জীবনগল্প ঠিক তেমনটাই হয়, যেমনটা গড়পড়তা কমার্শিয়াল সিনেমাতে আমরা দেখেছি বরাবর। পিতৃপরিচয়হীন এক শিশু, যে বড় হচ্ছে মায়ের সাথে, সঙ্গদোষে বখে যাচ্ছে, বড় হয়ে ছিঁচকে কাজ করতে করতে পুকুরচুরি করছে, আস্তে আস্তে কেউকেটা হয়ে উঠছে, সব বাঘ-গরুকে একঘাটে জল খাওয়াচ্ছে, এরই মাঝে প্রেম হচ্ছে, দুয়েকটা গান হচ্ছে... চেনা সমীকরণ। পুষ্পার উত্থানের গল্পটাও এরকম। নতুনত্ব কিছু নেই৷ ক্রমশ গড়পড়তা পুষ্পার গল্পে 'বানওয়ার সিং শেখাওয়াত' নামে এক পুলিশ অফিসার যুক্ত হচ্ছেন। এই পুলিশ অফিসারও বেশ হিংস্র৷ হুটহাট মানুষ মেরে দিচ্ছেন, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা পুষ্পাকে থোড়াইকেয়ার করছেন না, নিজের মত করে নিয়ন্ত্রণ করছেন আয়ত্বাধীন এলাকার সব। চোর-পুলিশ খেলা চলছে। কে বিজয়ী, কে পরাজিত, তা নির্ধারণের আগেই সমাপ্তির লাল পতাকা দেখা যাচ্ছে। গল্প শেষ। নটে গাছটি মুরোলো।
কোনো একটা নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় গল্প, 'পুষ্পা'র ক্ষেত্রে সেই গুরুত্বপূর্ণ গল্পই যে বিস্তর গড়পড়তা, তা লেখার এটুকু পড়েই বুঝে ফেলবার কথা অনেকের। গল্প তো নানা রঙের, নানা বৈচিত্র্যের হয়৷ কমার্শিয়াল পটবয়লারেও তো চাইলে নতুন নতুন আঙ্গিক যুক্ত করা যায়। ইদানীং যেমন বানিজ্যিক অনেক সিনেমাতে সামাজিক সব বার্তা সূক্ষ্মভাবে যুক্ত করা হচ্ছে, চাইলে 'পুষ্পা'তেও তা করা যেতে পারতো। ন্যারেশন স্টাইলেও চাইলে আরো অভিনবত্ব আনা যেতে পারতো। ক্লিশে ঢালাইয়ে এই নির্মাণের ছাদ গড়পড়তাভাবে না বানালেও হয়তো চলতো। অন্তত নির্মাতা সুকুমারের কাছ থেকে এরকম নির্মাণের প্রত্যাশা যে ছিলোনা মোটেও, তা বলাই বাহুল্য৷

ঠিক সে কারণেই এই সিনেমার পুরো আয়োজন যে দ্বিতীয় অংশের জন্যে, এই পর্বের গালগল্প শুধু যে আড়মোড়া ভাঙ্গার জন্যে, তা যখনই দর্শক বুঝতে পারছে, নির্মাণ আপেক্ষিকতা হারাচ্ছে ঠিক তখনই। 'পুষ্পাঃ দ্য রাইজ' এর পুরোটাজুড়ে যেখানে পুষ্পাময় গল্প, যেখানে ভালো কোনো অ্যান্টিহিরো নেই, সেখানে বৈচিত্র্য পাওয়াটাও খানিকটা কষ্টের। যদিও শেষদিকে পুলিশ অফিসার 'শেখাওয়াত' এর উপস্থিতি যেরকম দ্বৈরথের একটা থমথমে উত্তেজনা তৈরী করেছিলো, শেষে এসে সেটাও কেমন যেন খেলো হয়ে যায়। যে ক্লিফহ্যাঙ্গারে শেষ হলে মানুষ কোনো নির্মাণের পরবর্তী পর্ব নিয়ে হাপিত্যেশ করে, ঠিক সেখানে এসেও ব্যর্থ হয় 'পুষ্পাঃ দ্য রাইজ' এর পুরো আয়োজন৷

যদিও 'ওয়ান ম্যান আর্মি' হয়ে 'পুষ্পা' চরিত্রে আল্লু অর্জুন ভালোই সঙ্গত দিলেন। বলতে গেলে, গল্পকে একাই টেনে নিলেন অনেকটা। শেষদিকে যুক্ত হলেন ফাহাদ ফাসিল। তিনিও স্বল্পদৈর্ঘ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন গল্পের হাল ধরে রাখার। তাদের দুজনের প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মতনও। কিন্তু মূল গল্পই যেখানে নাজুক, সে নাজুক গল্পের বিপর্যস্ত ডিঙ্গিতে এই দুই নাবিকের করার কী-ই বা ছিলো আর আলাদা? তাছাড়া, পুরো সিনেমাজুড়ে 'পুষ্পা'কে যেরকম 'বুনো ওল' হিসেবে দেখানো হলো, ফাহাদ ফাসিলকে ঠিক ততটা কেন 'বাঘা তেঁতুল' হিসেবে দেখানো হলো না, আক্ষেপ রইলো সেখানেও। যতটা যত্ন নিয়ে 'পুষ্পা'র ক্যারেক্টার ডেভেলপ করা হলো, বাকিদের কেন ঠিক ততটা গুরুত্ব দেয়া হলো না, সেখানেও রইলো চাপান-উতোর।
'পুষ্পা'র দ্বিতীয় পর্ব কেমন হবে, তা সময়ের হাতেই ন্যস্ত। কিন্তু প্রথম পর্ব দেখে এটা খুব ভালোভাবেই অনুমান করা যায়, দুই পর্বের গল্পকে যদি একত্রে এক পর্বে এনে টানটান একটা গল্প বলা যেতো, তাহলেই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হতো। তাহলে হয়তো এরকম অযথা কমিক রিলিফ, অযথা হিরোইজম আনতে হতো না। তখন গল্পকেও এভাবে অশীতিপর বৃদ্ধের মত কাঁপতে কাঁপতে এগোতে হতো না৷ দর্শকেরও অসন্তোষ হতো না৷ 'পুষ্পা'কেন্দ্রিক সমস্ত আক্ষেপেরও অবসান ঘটতো। চিরতরে। সে কারণেই তাই আশা থাকবে- 'শেষ ভালো যার, সব ভালো তার' কিংবা 'ওস্তাদের মার শেষ রাতে' রীতি মেনে শেষে এসে দারুণভাবে মুগ্ধ করবেন সুকুমার-অর্জুন-ফাহাদ। এটুকু হলেও বর্তে যাবে সবাই, বলাই বাহুল্য।