মূলত ইরফান খানের জন্যেই এ সিনেমা দেখতে বসা। 'দ্য লাঞ্চবক্স' এর সেই 'সাজান ফার্নান্দেজ' এর সাথেও যেন খানিকটা মিল পেলাম 'রবার্ট' নামের এই নিঃসঙ্গ, বিত্তবান পাজল খেলোয়ারের। ভাবুক চোখ, মৃদু হাসি, সূক্ষ্ম সব হিউমারে চেনাপরিচিত ইরফান খানকেই পেলাম অচেনা ভূখণ্ডের গহীনে!

জীবনের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আমরা? যে জীবন নিয়ে আমাদের গালভরা গর্ব, সে জীবনে আমাদের ভূমিকা কতটুকু? অদৃশ্য সুতোর পুতুল হয়ে সময়ের প্রলোভনে বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া আর কিছু কি করি আমরা? আচ্ছা, জীবন আসলে কি? কেউ বলেন- জীবন একটা সরাইখানা। দুইদিনের মুসাফির হয়ে এখানে আবির্ভাব মানুষ। আবার কেউ বলেন- জীবন একটা ভাঙ্গা বাহন। যে বাহনে সওয়ার আমরা সবাই। এক জীবন নিয়ে অজস্র সংজ্ঞা। কিন্তু সংজ্ঞা যেটাই হোক না কেন, এটা তো মোটামুটি নিশ্চিত, 'জীবন' নামক এ ঘূর্ণিতে আমাদের গণ্ডি সীমাবদ্ধ। নির্দিষ্ট। অনেকটা 'র‍্যাঙ্গো' সিনেমার সেই বিখ্যাত লাইনের মত, যেখানে বলা হয়েছিলো-

নিজের জীবনের স্ক্রিপ্ট থেকে বেরোতে পারে না কেউ। কেউই না। 

তবুও বিশেষ এ বাক্যকে ধূলিসাৎ করার স্বপ্ন দেখেন অ্যাগনেস নামের এক নারী। মধ্যবয়সী এ ভদ্রমহিলার পরিবারে স্বামী, দুই সন্তান। তাদের নিয়ে তার ছিমছাম পরিবার। যদিও মাঝেমধ্যে জনতার মধ্যে নির্জনতার মতন একাকীত্ব বোধ করেন তিনি। গৃহাভ্যন্তরের নানামুখী কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে শূন্যতা কাটানোর প্রবোধও দেন নিজেকে। তবুও মাঝেমধ্যে দমবন্ধ লাগে। জীবনের চেনা সমীকরণ ক্রমশই গিলে ফেলতে চায়৷ স্বস্তিতে-অস্বস্তিতে এভাবেই জীবন এগোতে এগোতে আচমকাই হয় ছন্দপতন। অদৃশ্য সুতোর টানে অ্যাগনেস 'পাজল' এ আকৃষ্ট হন। শত সহস্র খণ্ডের পাজল মেলানো শুরু করেন। আস্তে আস্তে নেশা পেয়ে বসে তার। পাজল মেলাতে গিয়ে তার পরিচয় হয় আরেক মানুষের সাথে, যে মানুষটিও পাজল নিয়ে খুব আগ্রহী। যে মানুষটিও অ্যাগনেসের মতন বাস্তব জীবনে খুব একাকী৷ দুইজন একাকীত্বে ভোগা মানুষ 'পাজল' এর সূত্রে এভাবেই চলে আসেন কাছাকাছি। ততটা কাছাকাছি, যতটা কাছাকাছি এলে আমরা কোনোকিছুকে 'প্রেম' বলতে পারি৷ গল্প মোচড় খায় তখনই। 

প্রশ্ন আসে মনে, প্রেম আসলে কী? মানুষ কখন প্রেমে পড়ে? কেন প্রেমে পড়ে? একটু আগে লিখেছিলাম, জীবনের কোনোকিছুই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। সে হিসেবে প্রেমও কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে? জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয় হয়েও কেন প্রেম নিয়ন্ত্রণের বাইরে আলগোছে ঢুকে পড়ে জীবনে? হিসেবনিকেশ, যুক্তি দিয়ে ভালোবাসা কেন হয় না? সর্বনাশা প্রেম যখন তার বাহনে উঠিয়ে নেয় একজোড়া মানুষকে, তখন কেন প্রতিরোধের ন্যূনতম চেষ্টাও দেখায়না কেউ? 

'পাজল' এর সূত্রেই মুখোমুখি দু'জন! 

এসব প্রশ্নের কোনোটারই উত্তর 'পাজল' এ পাওয়া যাবে না৷ তবে এক ঘন্টা তেতাল্লিশ মিনিটের এই নির্মাণ দেখতে দেখতে প্রশ্নগুলো মাথায় আসবে বারবার৷ যাপিত জীবনে নানাবিধ সংকটে বুঁদ হয়ে থাকা গড়পড়তা আমাদের এই প্রশ্নগুলো অস্বস্তিকর অনুভূতিও দেবে নিশ্চিত। গল্পের প্রোটাগনিস্ট 'অ্যাগনেস' ও 'রবার্ট' বারবার মনে করাবে 'দ্য ব্রিজেস অব ম্যাডিসন কাউন্টি' এর 'ফ্রান্সেসকা' ও 'রবার্ট'কে। যদিও এ দুই সিনেমার মধ্যে পার্থক্য বিস্তর, কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন অদ্ভুত এক আবছা সংযোগও থাকবে দুই সিনেমার মধ্যে। একটু মনোযোগ দিয়ে না দেখলে যে যোগসূত্র বোঝা যাবেনা মোটেও। 

রবার্ট ও অ্যাগনেস! 

এ সিনেমা হয়তো অনেকেরই ভালো লাগবে না। না লাগার পেছনের কারণ, গল্পের নিষ্পৃহ বয়ান। এ গল্পে আবেগ আছে, অনুযোগ আছে, অনুতাপ আছে, প্রণয় আছে, বিচ্ছেদও আছে। এত এত মানব-অনুভূতির চলক যে গল্পে, সে গল্পের বয়ানে চাইলে অনেক ম্যাক্রো-ইমোশনস যুক্ত করা যেতে পারতো। কিন্তু নির্মাতা মার্ক টার্টলটাব সে পথে মোটেও হাঁটলেন না। বরং তিনি চাইলেন, এ গল্প দেখে মানুষের ভেতরটা সামান্য হলেও খচখচ করুক। শূন্যতাবোধ জাগুক। চোখে জল না আসুক, কিন্তু চোখ জ্বালা করুক। এবং বলতে দ্বিধা নেই, এ কাজে বেশ সফলও তিনি। 

প্রোটাগনিস্ট দুই চরিত্র- অ্যাগনেস ও রবার্ট এর কাঁধে এ সিনেমা টেনে নিয়ে যাওয়ার দায় ছিলো অনেকটুকু। সে কাজ দক্ষতার সাথেই সামলালেন তারা। 'অ্যাগনেস' চরিত্রে কেলি ম্যাকডোনাল্ড বরাবরের মতই অনবদ্য। জীবন নিয়ে বিভ্রান্ত এক নারীর চরিত্র লেগে রইলো তার চেহারায়, আচরণে।  'রবার্ট' চরিত্রে ইরফান খানও তেমনি। মূলত ইরফান খানের জন্যেই এ সিনেমা দেখতে বসা। 'দ্য লাঞ্চবক্স' এর সেই 'সাজান ফার্নান্দেজ' এর সাথেও যেন খানিকটা মিল পেলাম 'রবার্ট' নামের এই নিঃসঙ্গ, বিত্তবান পাজল খেলোয়ারের। ভাবুক চোখ, মৃদু হাসি, সূক্ষ্ম সব হিউমারে চেনাপরিচিত ইরফান খানকেই পেলাম অচেনা ভূখণ্ডের গহীনে। 

'পাজল গেম' এর মোড়কে যেভাবে মনুষ্যজীবনের ভঙ্গুরতাকে একপ্রস্থ কটাক্ষ করা হলো এই নির্মাণে,  সেটুকু উপলব্ধি করার জন্যে হলেও এই চলচ্চিত্র দেখা যেতে পারে একাধিকবার। যে জীবন নিয়ে আমরা এত তড়পাই, সে জীবনের পাদপ্রদীপের ত্রিসীমানাতেও যে আমাদের থাকার অধিকার নেই, ছিলোনা কখনও... সেটাই উপলব্ধি করায় 'পাজল।' বুঝতে শেখায়- জীবন নিয়ে এত পরিকল্পনার কিছু নেই মোটেও। যা আসবে, তা মেনে নেয়াই জীবন। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা