রাত জাগা ফুল সেসব ফুলের মতো মানুষের কথাই বলে যারা পরের তরে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, অবলাকে অন্ন দেয়, দুঃস্থের পাশে দাঁড়ায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। আমাদের মতো সভ্য মানুষদের রইসের মতো পাগল হলেই ভালো। এই রইসই রাত জাগা ফুল, এই পাগলামিই রাত জাগা ফুল...

বাংলাদেশে এখনই প্রকৃতি নিয়ে, অবলা প্রাণী নিয়ে জনরা ডিফাইনিং কাজ হবে ভাবাটা কষ্টসাধ্যই বটে। যেখানে ত্রিভুজ প্রেমের গল্প, নায়কের বীরত্বের গল্পই বলা শেষ হয় না আমাদের সেখানে একজন পাগলকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখতে পারাটা নতুন অভিজ্ঞতাই বটে। রাত জাগা ফুল অনেকগুলো নতুন অভিজ্ঞতার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলো। সাথে জানান দিয়ে গেল বাংলা গানের মিষ্টতা। জানান দিয়ে গেল প্রকৃতিকে ভালোবাসার কথা, প্রাণীদের আপন করে নেয়ার কথা।

রাত জাগা ফুল চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে। গ্রামের মহাজন আর রইস পাগলা যেখানে প্রধান চরিত্র। এই রইস নাকি পশুপাখির ভাষা বোঝে। ভাষা বোঝে গাছাপালারও। সবাই যে তার দোস্তো। গ্রামের অদূরে জঙ্গলের মাঝে একটি মাচা করে নিজের বন্ধুদের সাথে সে বসবাস করে। সিনেমার শুরুতেই বানর বন্ধু গান দিয়ে সে একে একে পরিচয় করিয়ে দেয় তার বন্ধুদের সাথে। এরই মাঝে গ্রামে একটি খুন হয়। খুনের সাক্ষী একটি অবলা প্রাণী, যে কীনা রইসের কাছে গিয়ে সব বলে দেয়। কিন্তু পাগলের কথা বিশ্বাস করার কেউ নেই। তার চেয়ে পাগলকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া সোজা। রইস কি পারবে সত্য প্রকাশ করতে? প্রকৃতি কি পারবে রইসের হয়ে প্রতিশোধ নিতে? নাকি মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও আচরণ করবে পশুর মতো? রাত জাগা ফুল হয়ে কেউ কি আসবে অন্ধকার সরিয়ে আলোর মুখ দেখাতে? মনুষ্যত্ব জাগ্রত করতে?

রাত জাগা ফুল সিনেমায় রইস চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন মীর সাব্বির। বছরের পর বছর ধরে তাকে টাইপকাস্ট দেখতে দেখতে সাধারণ দর্শক আশা করতেই পারে যে আবার চিরাচরিত বরিশাইল্লা কোন চরিত্রে ভাঁড়ামি করবেন হয়তো তিনি? কিন্তু না, মীর সাব্বির নিজেকে ভেঙ্গে চুড়চুড় করেছেন। নিজের সিনেমা বলেই নিজের চরিত্রকে সবচেয়ে বেশি খাটিয়েছেন। ছেঁড়া-ময়লা লুঙ্গি, মুখজুড়ে কালো প্রলেপ, নোংরা-পাগল রইস হতে মীর সাব্বির নিজের সীমা লঙ্ঘন করেছেন বারবার। অভিনেতা হিসেবে নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, স্ক্রিনে যা স্পষ্ট। 

রইস ও মহাজন

অন্যদিকে ফজলুর রহমান বাবু তার ক্যারিশম্যাটিক স্ক্রিন প্রেজেন্স দিয়ে প্রতি শটেই ছক্কা মেরেছেন। মহাজনের ক্যারেক্টারকে বাবু একদম নিজের মতো করে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন। টিপিক্যাল ‘ভিলেন মহাজন’ হতে গিয়েও তাই হন নি তিনি তার অসম্ভব অভিনয় দক্ষতার জন্য। মিস বাংলাদেশ ঐশীকে বেশ সাবলীল লেগেছে তার দ্বিতীয় সিনেমাতে এসেই। মিশন এক্সট্রিমের চেয়েও রাত জাগা ফুলে ঐশী বেশি ভালো করেছেন। জয়রাজ মীর সাব্বিরকে হুমকি দেয়ার সিনে নিজেকে ছাপিয়ে গেছেন। সাথে অন্যান্য অভিনেতারাও সকলে দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন। ডাঃ এজাজের অল্প সময়ের উপস্থিতি দর্শকদের অনেক হাসিয়েছে। সাথে ‘আইটেম বয়’ হিসেবে নাজিম শাহরিয়ার জয়ের অভিষেকটাও নচিকেতার গানের সাথে ভালো মানিয়েছে। 

অন্যান্য চরিত্রের অভিনেতারাও ছিলেন সাবলীল

রাত জাগা ফুলের হাইলাইট হচ্ছে তার ম্যাসেজিং আর গান। এতো দারুণ কনসেপ্টে সিনেমা বানানো ও এক্সিকিউট করা পাহাড়সম কাজ। সেকেন্ড হাফের দুর্বলতা অনেকটাই চোখের আড়াল করে দেয়া যায় কেবলমাত্র শেষ পাঁচ মিনিটের জন্য। মমতাজের দরাজ গলায় ‘রাত জাগা ফুল’ এর টাইটেল ট্র্যাক অন্যমাত্রা এনে দেয় এই সিনেমায়। সাথে অন্যান্য গানগুলোও অসম্ভব সুন্দর ও শ্রুতিমধুর।

সব মিলিয়ে রাত জাগা ফুল মীর সাব্বিরকে নতুন করে চিনিয়ে দিয়ে গেল। মীর সাব্বির আমাদের অতীত নস্টালজিয়ার অংশ, বর্তমানে এসেও যে তিনি তার ক্যাপাবিলিটির সাক্ষর রাখলেন তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। রাত জাগা ফুল সেসব ফুলের মতো মানুষের কথাই বলে যারা পরের তরে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, অবলাকে অন্ন দেয়, দুঃস্থের পাশে দাঁড়ায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। আমাদের মতো সভ্য মানুষদের রইসের মতো পাগল হলেই ভালো। এই রইসই রাত জাগা ফুল, এই পাগলামিই রাত জাগা ফুল।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা