রাঁধে সালমানের অন্যতম বাজে সিনেমা হয়ে গেল আমার চোখে। এমনকি রেস থ্রির চেয়েও বাজে। দর্শকদের সামনে তারা নিয়ে এলো হাফবেকড একটা সিনেমা, যার গ্রাফিক্সের কাজ এখনো বাকি, যার এডিটের দফারফা অবস্থা, যার ডাবিং জঘন্য। আর অভিনয়ের কথা যত না বলা যায় তত ভালো...

আমি যদি বলি রাধে সালমান খানের বিগত দশ বছরের অন্যতম সেরা সিনেমা হতে পারতো তাহলে অনেকেই হেসে উড়িয়ে দেবে। দেয়াটাই স্বাভাবিক। বজরঙ্গি ভাইজান, সুলতানের পর এই সিনেমাকে রাখার কথা সালমানের পাঁড় ভক্ত হওয়া ছাড়া বলা সম্ভব না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে চাইলেই রাধে হতে পারতো, হ্যাঁ চাইলেই। কিন্তু সেটা তারা চান নি। প্রভুদেভা চাননি, সালমান চাননি, চাননি সিনেমার সংশ্লিষ্ট কেউই। তাদের চাওয়া ছিল সালমানের নামের দমে সিনেমাটা চালিয়ে দেয়া। যার দরুন যেটা হল, রাধে সালমানের অন্যতম বাজে সিনেমা হয়ে গেল আমার চোখে। এমনকি রেস থ্রির চেয়েও বাজে। দর্শকদের সামনে তারা নিয়ে এলো হাফ-বেকড একটা সিনেমা, যার গ্রাফিক্সের কাজ এখনো বাকি, যার এডিটের দফারফা অবস্থা, যার ডাবিং জঘন্য। আর অভিনয়ের কথা যত না বলা যায় তত ভালো।

কোরিয়ান আউটল'জ সিনেমার রিমেক হল রাধে। আউটল'জ দেখা হয়েছিল দু বছর আগে। দেখার সময়ই ডন লির স্টাইল, Swag দেখে মনে হয়েছিল সালমানের সাথে এই চরিত্র খুব ভালোমতো যাবে। কিন্তু সেটাই যদি একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে সিনেমার তাহলে সব আশাই সার। আউটলজের পরতে পরতে ছিল থ্রিল, ড্রামা; এমন রোমহর্ষক থ্রিলারকে কার্টুনিশ বানাতে ভালোই বেগ হয়েছে প্রভুদেভাকে। সেখানে গল্প ছিল দুটো গ্যাং এর, যাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়ে ৩ জনের একটা ছোট্ট গ্যাং। যাদের ভায়োলেন্স, ব্রুটালিটি দেখলে পিলে চমকে যেতে হয়। সাইকোপ্যাথ কিলার সে ৩ জনের গ্যাংকে সামাল দেয়ার দায়িত্ব পায় একজন ক্লামজি পুলিশ অফিসার। যে কীনা নিজেই অনেক করাপ্টেড, দুর্নীতিগ্রস্থ। নেশায় ঢোল হয়ে থাকে, মেয়েদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে। তাকেই মাত্র ১০ দিন সময় দেয়া হয় পুরো এলাকা পরিষ্কার করার জন্য। তারপর পুলিশ বনাম গ্যাংদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়ায় আউটলজ হয়ে ওঠে দারুণ উপভোগ্য।

সেই গল্পটাই মুম্বাইতে এসে যেন দম বন্ধ হয়ে মরে গেল। গ্যাং ওয়ার, ব্রুটালিটি, ভায়োলেন্স যেভাবে আনলেন প্রভুদেভা দেখে মনে হল না আনলেই পারতেন। দিশা আর সালমানকে নিয়ে জোকারি আর গান গাওয়াতেই ব্যস্ত থাকতে পারতেন। ডার্ক একটা সিনেমাকে কতভাবে ফানি করা যায় ও কতো বাজেভাবে জোকারি করিয়ে ফানি করা যায় এই সিনেমা না দেখলে বুঝতে কষ্টই হতো। এতো জঘন্য সব কমেডি সিন সালমান রেস থ্রিতেও করেন নি বোধহয়। জ্যাকি শ্রফের ক্যারিক্যাচারিশ একটা রোলের অবতারণা করা হল যেন ডন লির খারাপ গুণগুলো রাধেকে না দিয়ে তাকে দেয়া যায়। অথচ এভাবেই যে একটা ক্যারেক্টার বিলিভেবল হয় সেটা প্রভুকে কে বোঝাবে!

আউটলজের ডার্ক স্ক্রিনপ্লেকে লাইট করার জন্য ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের সিনেমায় ১ ঘণ্টাই প্রভু স্রেফ জোকারি করেছেন। দিশাকে দিয়ে, জ্যাকিকে দিয়ে, কখনো গান এনে, কখনো কার্টুনিশ ক্যারেক্টার এনে, কখনো তিনি সালমানকে ফ্ল্যাশ বানিয়ে এন্ট্রি দিয়েছেন আবার কখনো একশনের মাঝে হাস্যরসাত্মক সিকুয়েন্স এনে হাসাতে চেয়েছেন দর্শককে। সমস্যা আসলে গল্প নির্বাচনে। আপনি একটা ডার্ক ভায়োলেন্ট স্ক্রিপ্ট নিয়ে যদি ফ্যামিলি অডিয়েন্সের কথা চিন্তা করেন তাহলে আর যাই হোক ভালো সিনেমা হবে না।

রাধে সিনেমার একটি দৃশ্যে সালমান খান

নায়ক যদি নীতিবান, সিক্স প্যাকধারী, দুষ্টু, সরল, নাচতে-গাইতে জানা মেগাস্টার হয় তাহলে সে আর ঐ গল্পের কোন ক্যারেক্টার হতে পারবে না। এই ক্যারেক্টারের জন্য সালমানকে একটু ভারী দেখানো দরকার ছিল, এককালের দুঁদে পুলিশ অফিসার রাঁধেকে চাইলেই দেখানো যেত একটা বারে নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, ঘুষ খাচ্ছে। তা না করে সে দার্শনিক বনেছে, বগলের ভাঁজে সুপুরি রেখে এন্ট্রি নিচ্ছে যেখানে সেখানে। তাহলে তো সে সালমানই থাকবে, রাঁধে হবে না, আউটলজের সে পুলিশ অফিসার হবে না যে শেষবারের মতো একটা সুযোগ পেয়েছে নিজেকে প্রমাণ করার।

আমি কমার্শিয়াল সিনেমা পছন্দ করি। কিন্তু কমার্শিয়াল সিনেমার নামে এসব অখাদ্য গিলতে হবে সেটা মানতে পারবো না। সাউথেও কমার্শিয়াল সিনেমা বানায়, সালমানের চেয়ে বয়স্ক নায়কেরাই বানায়, কোরিয়ান আউটলজও কমার্শিয়াল ঘরানার সিনেমা, কিন্তু কমার্শিয়াল সিনেমায় বাস্তবিকতা থাকবেনা এটা ভ্রান্ত ধারণা। আপনি যদি বাহুবালিও দেখান, আপনার দর্শককে বিশ্বাস করাতে হবে যে না বাহুবালি পারে একসাথে দশজনকে আকাশে তুলে প্যাদাতে। আপনাকে বিলিভ করিয়েই রাজামৌলি সে পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। এজন্যই বাহুবালি বাহুবালি।

সুলতানে কি আমরা বিশ্বাস করিনি যে সুলতান প্রথমবারের মতো মিক্স মার্শাল আর্ট কম্পিটিশনে গিয়ে প্রতিটা ম্যাচ জিতেছে? করেছি, কারণ আলি আব্বাস জাফর সেটা বিলিভ করিয়েই ঐ পর্যন্ত নিয়েছেন। তিনি সুলতানের স্ট্রাগল দেখিয়েছেন। আর এখানে যখন রাধেকে দেখি মানুষকে কাগজের প্যাকেটের মতো ভাঁজ করে পেটাতে তখন কীভাবে বিশ্বাস করা যায়? শহরে ড্রাগের ঘনঘটা, পুলিশের ওপর প্রবল চাপ। আর আপনি যদি বাদাম চিবুতে চিবুতে মানুষ প্যাকেট করেন, ডায়লগবাজি করেন তাহলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়?

প্রভুদেভা খুবই নিম্নমানের পরিচালক। লেজেন্ডারি এই ড্যান্সার-কোরিওগ্রাফার কেন যে জোর করে সিনেমা বানাচ্ছেন আমি জানি না। উনি যদি রাউডি রাঠোর, আর রাজকুমারের মতো সিনেমা বানাতেন সেগুলাও কিছুটা এনজয় করা যেত, কিন্তু এখন যা বানাচ্ছেন প্রতিটাই পিওর গার্বেজ। একজন মেগাস্টারের নাম দিয়ে এসব গার্বেজ গিলতে হলে গেলা যাবে, কিন্তু যখন উগড়ে দেয়ার সময় হবে তখন তার কোন লেগ্যাসি থাকবে না, কোন সিনেমা অবশিষ্ট থাকবে না যেটা পরবর্তী প্রজন্মকে দেখানো যাবে। রাধে চাইলেই হতে পারতো দারুণ একটা রিমেক, বলিউডে ডার্ক কপ থ্রিলার নেই বললেই চলে। কিন্তু আফসোস হয়ে রইল অযত্নে, অবহেলায় রেখে দেয়া অনেক অনেক টেকনিক্যাল ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পন্ন গার্বেজ সিনেমা।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা