যদি রাজামৌলির সিনেমাগুলো কেউ খেয়াল করেন, তাহলে একমত হবেন- সিনেমাগুলোর গল্প খুব একটা 'আউট অব বক্স' না। গল্পের রূপান্তর দেখে পিলে চমকে উঠবে, এরকমটা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই বললে চলে৷ সেটা রাজামৌলি নিজেও জানেন৷ তিনি গল্পে তাই চমক রাখেনও না। তার যাবতীয় মুন্সিয়ানা তিনি রাখেন গল্প বয়ানে। ঠিক এখানে এসেই যেন বরাবর সপাটে ছক্কা হাঁকান রাজামৌলি। দর্শককে কিভাবে গল্প, গল্পবয়ান, চরিত্র আর সেট ডিজাইনে হুক করতে হয় গল্পের সাথে, তা তার নখদর্পনে। এবং সেটার বরাতেই তার সিনেমা দর্শককে সেই 'মোর দ্যান আ ফিল্ম' এর অনুভূতি দেয় বরাবর...

"সিনেমায় শিল্প এবং ব্যবসার মিশেল সবসময়ই থাকবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, শিল্পটা যেন ব্যবসার ওপরে থাকে, ব্যবসা শিল্পের ওপরে নয়।"

কথাটা এমন একজন নির্মাতার, যে নির্মাতা আদতেই বিশ্বাস করেন- সিনেমায় শিল্পই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে নির্মাতা বিশ্বাস করেন- সিনেমা বরাবরই লার্জার দ্যান লাইফ। এই নির্মাতা যেসব সিনেমা বানিয়েছেন, সেসব সিনেমার গল্প নিয়ে হয়তো খানিকটা প্রশ্ন তোলা যাবে, কিন্তু যেভাবে তিনি গল্পগুলো বলেন, যে সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় তিনি সেট ডিজাইন করেন, যেভাবে তিনি চরিত্রগুলোর এক্সিকিউশন নিয়ে ভাবেন- তা নিয়ে প্রশ্ন কেন, 'টু' শব্দও করা যাবেনা মোটেও। তাকে অনেকে 'রোবট' বলেন, অনেকে বলেন- শুটিং সেটে কুশীলবদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম তিনি করান, কিন্তু তবুও এই 'হৃদয়হীন' কিংবা 'রোবট' পরিচালকের সাথে কাজ করার জন্যে মুখিয়ে থাকেন ভারতের সব রাজ্যের শিল্পীরা৷ কারণ, এই নির্মাতার সিনেমায় অংশ নিতে পারা মানে, ফিল্ম ক্যারিয়ারেই একটা বিশেষ পালক যুক্ত হয়ে যাওয়া। ভাবছেন, কার নাম বলছি? না, আর সাসপেন্সে রাখবো না। যে নির্মাতাকে নিয়ে এতবড় গৌরচন্দ্রিকা লিখলাম, তার পরিবার-প্রদত্ত নাম- কদুরী শ্রীশৈল শ্রী রাজামৌলি। যদিও যিনি আপামর জনতার কাছে পরিচিত, 'এস এস রাজামৌলি' নামেই। 

২০০১ সালে তার প্রথম সিনেমা 'স্টুডেন্ট নাম্বার ওয়ান' মুক্তি পায়। সেই শুরু। ২০২২ সাল অবদি তিনি বানিয়েছেন ১২টি সিনেমা। সংখ্যার বিচারে খুব বেশি সিনেমা, এমনটা মোটেও না৷ আগ্রহের বিষয়ও সেটা নয়। বরং সময়ের ফেরে সিনেমাগুলোর যেভাবে রূপান্তর হয়েছে, এবং, যেভাবে বক্সঅফিসে আলোড়ন তুলেছে সিনেমাগুলো, আগ্রহ মূলত সেখানেই। বিশেষ করে, শেষ তিনটি সিনেমা; 'বাহুবলি', 'বাহুবলি টু' এবং 'আরআরআর' যেভাবে নিজেরাই নিজেদের রেকর্ড ভাঙ্গার জন্যে আদাজল খেয়ে নেমেছে, তা একটা কথাই প্রমাণ করেছে বারবার- রাজামৌলির টক্কর শুধু তার নিজের সাথেই৷ আর কারো সাথে না৷ 

যদি রাজামৌলির সিনেমাগুলো কেউ খেয়াল করেন, তাহলে একমত হবেন- সিনেমাগুলোর গল্প খুব একটা 'আউট অব বক্স' না। গল্পের রূপান্তর দেখে পিলে চমকে উঠবে, এরকমটা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই বললে চলে৷ সেটা রাজামৌলি নিজেও জানেন৷ তিনি গল্পে তাই চমক রাখেনও না। তার যাবতীয় মুন্সিয়ানা তিনি রাখেন গল্প বয়ানে। আপাতদৃষ্টে মোটামুটি গোছের একটা গল্পের বয়ানও তিনি এমনভাবে করেন- সেখানে অবধারিতভাবেই মিশে থাকে নানা চলকের উপাদান। কিছুটা আবেগ, কিছুটা ইতিহাস, দেশপ্রেমের নানাবিধ আর চোখধাঁধানো সেট ডিজাইন; বিচিত্র সব অনুষঙ্গ মিলেমিশে তিনি এমন এক দৃশ্যপট দাঁড় করান, দর্শকের বিহ্বল, হতচকিত কিংবা স্থানু হওয়া ছাড়া উপায়ও থাকেনা।

নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী যেমন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- একটা গল্পের সার্থকতা নির্ভর করে, দর্শক সে গল্পে কতটুকু চমকালো, তার উপরে। এবং ঠিক সেখানে এসেই রাজামৌলি বরাবর দেখান তার দাপট। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। রাজামৌলির সাম্প্রতিকতম নির্মাণ 'আরআরআর'কেই কেসস্টাডি হিসেবে যদি ধরি- সেখানে কোমারাম ভীম এবং সীতারাম রাজু নামের  দুই বিপ্লবীর পোর্ট্রেয়াল যেভাবে হলো, তাদের এন্ট্রি থেকে শুরু করে নানারকম অ্যাকশনের কোরিওগ্রাফি যেভাবে করা হলো, গল্পের সাথে মিথোলজিক্যাল অ্যাঙ্গেলকেও যেভাবে স্টাবলিশ করা হলো- সেটা বিস্ময়কর। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, 'আরআরআর' এর অজস্র লেয়ার থাকা সত্বেও সব শ্রেণি-পেশার দর্শকই লেয়ারগুলো ধরতে পারলো, এবং সিনেমার সাথে কানেক্ট করতে পারলো! আল্টিমেটলি, সিনেমা হিট। হাউজফুল। রাজামৌলির জয়জয়কার! 

রাজামৌলির সিনেমায় যারা অভিনয় করেছেন, তারা একবাক্যে একটা কথা সবসময় স্বীকার করেন, সিনেমার শুটিং শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের আর আলাদা কোনো অস্তিত্ব থাকেনা৷ সিনেমার চরিত্র অনুযায়ী, তারা হয়ে যান বাক্সবন্দী। এবং চরিত্রের এই বাক্সে অভিনেতাদের ঢোকানোর এই কাজটি বেশ যত্ন নিয়েই করেন রাজামৌলি। যিনি নিজেই বলেন-

তারকা আমার কাছে কোনো সমস্যা না। আমি তারকাদের ডিল করতেই পারি। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ক্যারেক্টার। তাদের ব্যালেন্স না করতে না পারলে গল্পই দাঁড়ায় না।

এবং ঠিক সে কারণেই, তার সিনেমার চরিত্ররা আলাদা হয়েই কথা বলে বরাবর। 'বাহুবলি'র কাটাপ্পা, 'আরআরআর' এর ভীম-রাজু কিংবা 'মাগাধিরা'র 'কালভৈরব'; স্বকীয় অবতারেই তারা ঢুকে পড়ে মানসপটে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য, রাজামৌলির সিনেমার প্রোটাগনিস্ট চরিত্রেরা বরাবরই পুরুষ, এবং তারা বরাবরই 'লার্জার দ্যান লাইফ' আবহের প্রতিনিধি। শক্তিশালী, নীতিবান একেকটা চরিত্র, যারা হোঁচট খায়, মুখ থুবড়ে পড়ে, কিন্তু আবার উঠে দাঁড়ায়, আগের থেকে আরো ঢের শক্তিশালী হয়ে আবির্ভূত হয় শত্রুপক্ষের সামনে। মূল চরিত্রের এই ডাইমেনশন, ন্যারেশন, আর্ক, এক্সিকিউশন দর্শককে অবধারিতভাবেই হুক করে রাখে গল্পের সাথে, সিনেমার সাথে। আবার, পুরুষেরা প্রধান বলে সিনেমার নারীচরিত্রেরা যে 'শো-পিস', তাও না। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গল্পকে যোগ্য সঙ্গত দিতে আবির্ভূত হন তারাও। যে অ্যান্টাগনিস্টের সাথে দ্বৈরথ হবে প্রোটাগনিস্টের, তার ব্যাকস্টোরিও বেশ যত্ন নিয়ে ডেভেলপ করেন রাজামৌলি। ফলে তার সিনেমার চরিত্রেরা বরাবরই নিখুঁত ছাঁচে আবির্ভূত হয় সামনে। আধাখেঁচড়া চরিত্রের উপস্থিতি আর যেখানেই থাকুক, এই নির্মাতার সিনেমায় নিয়মিতই অনুপস্থিত।

রাজামৌলির বাবা কে.ভি বিজয়েন্দ্র প্রসাদ নিজেও নির্মাতা ও স্ক্রিনরাইটার। তিনি মাঝেমধ্যে একটা কাজ করতেন। যেকোনো একটা দৃশ্যের মোটামুটি একটা সারাংশ শুনিয়ে রাজামৌলিকে বলতেন, ঐ দৃশ্যের ছোটখাটো ডিটেইলস নিয়ে ভাবতে। এবং রাজামৌলিও নিজের মত করে ভাবতে থাকতেন এবং নানারকম বিচিত্র উপাদান যুক্ত করতেন দৃশ্যপটে। বাবার কাছ থেকে পাওয়া এই যে অভ্যাস, সেটা রাজামৌলির কল্পনার চৌহদ্দিকে কতটা বিস্তীর্ণ করেছে, তা তার সিনেমাগুলোর সেট ডিজাইন দেখলেই খানিকটা বুঝতে পারার কথা। হোক তা 'বাহুবলি' কিংবা 'আরআরআর', তিনি এমন সব অভূতপূর্ব আয়োজন যুক্ত করেছেন সিনেমার নানাবিধ অংশে, তা ক্রমশই চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মুগ্ধ করে। সিনেমার যে আসলেই কোনো গণ্ডি হয় না, সেটাই যেন বুঝতে শেখায় তার যাপিত সব নির্মাণ। 

'আরআরআর' এর জয়জয়কার চলছে এখনও! 

রাজামৌলির সিনেমা নিয়ে অনেক তারকাই বলেন, এগুলো আসলে সিনেমা না। এগুলো তাদের জন্যে একেকটা 'অভিনয়ের স্কুল।' এদিকে রাজামৌলি নিজেও বিশ্বাস করেন- তার প্রতিটা সিনেমা তার নিজের জন্যেও একেকটা শিক্ষা। যদি রাজামৌলির ফিল্মোগ্রাফি লক্ষ্য করা হয়, তাহলেই এ বাক্যের সত্যতা মিলবে হাড়েহাড়েই। তেলেগু ডিরেক্টর থেকে ক্রমশ নিজেকে ছাপিয়ে যেতে যেতে প্যান ইন্ডিয়ান ডিরেক্টর হয়ে ইন্ডিয়ান সিনেমার ভাগ্য বদলে দেয়ার কারিগর হওয়া- এই যাত্রাটা খুব যে সোজা না, তা বলাই বাহুল্য। এবং এ যাত্রাপথে যেভাবে তিনি নানারকম জঁরা; মিথোলজিক্যাল, পিরিয়ড কিংবা রোমান্টিক ফিল্ম নিয়ে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, তা করতে পারে খুব কম নির্মাতাই। পাশাপাশি, 'প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা'র সংজ্ঞাও যেভাবে পাল্টেছেন তিনি, সেটাও বিস্ময়কর। তার নিজের ভাষাতেই-

প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা মানে এমন না যে, বিভিন্ন ভাষার অভিনয়শিল্পীরা এখানে অভিনয় করছেন। বরং, প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা মানে এমন এক গল্প, যে গল্পে ভাষার প্রতিবন্ধকতা থাকবে না, যে গল্পে যুক্ত হতে পারবে সবাই। আমি তো মাঝেমধ্যে এও ভাবি, সিনেমার কিছু অংশ থেকে ডায়লগ উঠিয়ে দেবো। এবং আমি এও জানি, ডায়লগ উঠিয়ে দিলেও দর্শক ঠিকই বুঝতে পারবে সিনেমা! 

এবং ঠিক এভাবেই, তেলেগু'র রিজিওনাল সিনেমাকে যেভাবে দোর্দণ্ডপ্রতাপে 'প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা'র গণ্ডিতে উত্তীর্ণ করেছেন এস এস রাজামৌলি, তা খানিকটা রূপকথা বলে মনে হলেও মানতে হবে এটাই, একমাত্র রাজামৌলির পক্ষেই সম্ভব এই অসাধ্যসাধন। 

প্যান-ইন্ডিয়ান সিনেমার সংজ্ঞাই পালটে দিয়েছেন যিনি! 

এত এত চরিত্র, এত বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে কাজ করেন বরাবর, কঠিন মনে হয় না সবকিছু... এরকম প্রশ্নের জবাবে রাজামৌলি যেমন বলেন-

আমি প্রথমে স্ক্রিপ্ট দেখি। স্ক্রিপ্ট দেখে যদি মনে হয়, এ গল্পটা মানুষকে টানবে। আমি তখনই এগোই। আমার কাছে কঠিন তাই স্ক্রিপ্ট বাছাই করা। সেটা হয়ে গেলে বাকিসব এমনিই হয়ে যায়।সমস্যা হয় না।

এটা তো ঠিক, কোনো সিনেমা শতভাগ দর্শক পছন্দ করবে, এরকম কথা কোনো নির্মাতাই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন না। সেটা সম্ভবও না৷ 'সিনেমা' এমন এক শিল্প, যেটা সবাইকে একসাথে সন্তুষ্ট করবে না, এটাই নিয়ম। কিন্তু ঠিক এখানে এসেই যেন বরাবর সপাটে ছক্কা হাঁকান রাজামৌলি। দর্শককে কিভাবে গল্প, গল্পবয়ান, চরিত্র আর সেট ডিজাইনে হুক করতে হয় গল্পের সাথে, তা তার নখদর্পনে। এবং সেটার বরাতেই তার সিনেমা দর্শককে সেই 'মোর দ্যান আ ফিল্ম' এর অনুভূতি দেয় বরাবর। এবং ফলশ্রুতিতে, দর্শকেরও আর বের হওয়া হয়না সিনেমার ইন্দ্রজাল থেকে৷ আর এভাবেই দর্শক-সিনেমার এক অপার্থিব মেলবন্ধন ঘটিয়ে এস এস রাজামৌলি প্রতিবারই হয়ে থাকেন প্রাসঙ্গিক, স্বকীয় এবং বিশেষ! আর এভাবেই, রাজামৌলি প্রতিবারই জানান দেন, কেন তিনি দ্য মাস্টার ফিল্মমেকার! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা