
সমসাময়িক নায়িকারা যখন বিদায় নিয়েছেন বলিউড থেকে, সেখানে রানী পরপর তিনটি বক্সঅফিস হিট উপহার দিয়েছেন এই বয়সে! এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তিনটি সিনেমাই নারীপ্রধান গল্পের...
বলিউডের রূপালী জগতে প্রতিদিনই কোন না কোন নায়িকার আগমন ঘটে। কেউ সাফল্য লাভ করেন কেউবা কিছু সময় পরে হারিয়ে যান। কিন্তু কিছু অভিনেত্রী তাদের ছাপ এমনভাবে রেখে যান যে, তাদের নামটি ছাড়া হিন্দি সিনেমার ইতিহাস অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে আর এমনই একটি নাম হচ্ছে রানী মুখার্জী। ১৯৯৭ সালে অভিনেত্রী হিসেবে যাত্রা শুরু করা রানী এই বছরেই পূর্ণ করতে যাচ্ছেন অভিনেত্রী হিসেবে দুই যুগের এক সফল জার্নি। ১৯৭৮ সালের ২১শে মার্চ জন্মগ্রহণ করা জনপ্রিয় এই গুনী বলিউড অভিনেত্রী রানী মুখার্জীর জন্মদিন উপলক্ষে তাকে নিয়ে আমাদের আজ এই বিশেষ ফিচার।
দুই দশকের অভিনয় জীবনে রানী পেরিয়ে এসেছেন অনেকটা সময়, ক্যারিয়ারে এসেছে উত্থান-পতন। তবুও তিনি নিষ্প্রভ হননি,আপন আলোয় জ্বলে উঠেছেন বারবার। সমসাময়িক নায়িকাদের মত ঝলসানো রুপ কিংবা উচ্চতা হয়তো তাঁর ছিল না,কিন্তু এই বাঙালি কন্যা মায়াবী চেহারা আর অভিনয় গুণে ঠিকই দর্শক জয় করেছিলেন। তিনি প্রমান করেছিলেন বলিউডের এই আলো ঝলকানো জগতে অভিনয়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাবা প্রযোজক রাম মুখার্জী, চাচী বলিউডের এক সময়ের নামকরা অভিনেত্রী তনুজা, চাচাতো বোন কাজল, কাজলের স্বামী অজয় দেবগন বলিউডের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় অভিনেতা, আরেক চাচাতো ভাই অয়ন মুখার্জী বলিউডের এই সময়ের অন্যতম সেরা পরিচালক। কলকাতার প্রখ্যাত অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় হচ্ছেন তার মাসি। স্বামী বলিউডের সবচেয়ে বড় প্রোডাকশন হাউজ ইয়াশ রাজ চলচ্চিত্রের মালিক আদিত্য চোপড়া। রানী মুখার্জীর পারিবারিক ইতিহাস দেখতে গেলে চোখ এমন ছানাবড়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে বাস্তবজীবনে খুবই সাধারন এক বাঙালি মেয়ের জীবন যাপন করতেই আগ্রহ তার। তাই তার সেই পাশের বাড়ীর মিস্টি মেয়ের ইমেজ এখনো বহাল।

বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে রানীই তার সময়ের একমাত্র অভিনেত্রী যার সাথে অন্য নায়িকাদের বন্ধুত্বের খবর দেখা যেত নিউজপেপারে। প্রীতি জিনতা হোক বা কারিনা কাপুর, বিপাশা বসু থেকে বিদ্যা বালান রানী সবার বন্ধু। সিনিয়র অভিনেত্রী প্রয়াত সুপারস্টার শ্রীদেবীর সাথে তার বন্ধুত্ব রীতিমতো বিস্ময়কর। অন্যদিকে শাহরুখ, সালমান, আমির, হৃতিক, গোবিন্দ, অভিষেক থেকে শুরু করে পরিচালক করন জোহর, মনি রত্নম, সঞ্জয় লীলা বনসালী বা সাদ আলী রানী তার রাজত্বে সবার কাছ থেকেই পেয়েছেন এক অসাধারন বন্ধুত্বের সার্টিফিকেট।
চলচ্চিত্র পরিবারের মানুষ বলেই হয়তো নিজের পিতার প্রযোজনায় বাংলা সিনেমা 'বিয়ের ফুল' দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক, সাথে ছিলেন প্রসেনজিৎ এবং ইন্দ্রাণী হালদার। সিনেমা ব্যবসাসফল তো বটেই, সাথে সুপারহিট হয়েছিল সিনেমার গান। বাংলা জয় করার পর বলিউড জগতে পদচারনা, তবে শুরুটা তেমন ভালো হয় নি। প্রথম ছবি 'রাজা কি আয়েগে বারাত' ফ্লপ, সাথে নিজের কণ্ঠস্বর নিয়েও কিছুটা সমালোচিত হন তিনি।
তবে দমে যাননি রানী, পরের সিনেমা আমির খানের বিপরীতে 'গুলাম', এই সিনেমা ব্যবসাসফল তো হলোই সাথে তার গ্ল্যামারাস লুক, অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। তবে অভিনয় করেছিলেন অন্যের কন্ঠে। তাই একটু খুতখুতানী যেন রয়েই গেল। তবে তাঁর এই ভিন্ন কন্ঠ কে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন তখনকার নবাগত পরিচালক করণ জোহর।
১৯৯৮ সালে করন জোহর তার পরিচালক হিসেবে প্রথম সিনেমা 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়' এর জন্য গিয়েছিলেন টুইঙ্কল খান্না, ঐশ্বরিয়া সহ বেশ কয়েকজন নায়িকার কাছে। তবে চরিত্রটির স্ক্রিন টাইম এবং শাহরুখ-কাজল মূল চরিত্রে তাই সকলেই ফিরিয়ে দেয় করনকে। তখন বন্ধু শাহরুখের কাছ থেকে বলিউডের এক নতুন মেয়ের কথা শুনে তার সাথে দেখা করে চূড়ান্ত করেন করন। সেই মেয়েটিই রানী মুখার্জী।'টিনা' চরিত্র করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। শাহরুখের রাহুল বা কাজলের অঞ্জলি চরিত্রগুলোর মাঝেও এতটুকুও ম্লান হয় নি টিনা। ব্যাস তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

বলিউডের প্রায় সকল হিসাব বদলে দিয়ে ছোটখাটো, শ্যামলা বর্নের রানী পাল্লা দিয়েছেন সেই সময়ের অনেক সুন্দরী, গ্ল্যামারস নায়িকাদের সাথে। ঐশ্বরিয়া, প্রীতি, কারিনা, বিপাশার মতো নায়িকাদের সাথে তাল মিলিয়ে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন রানী। তিন খান, হ্নতিক, অজয়, সাঈফ আলী খান, অভিষেক বচ্চনের সাথে হিট সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি।
দুই যুগের অভিনয় জীবনে তিনি উপহার দিয়েছেন হার দিল জো পেয়ার করেগা, চোরি চোরি চুপকে চুপকে, সাথিয়া, চলতে চলতে, পেহেলি, বান্টি অউর বাবলি, কাভি আলবিদা না ক্যাহনা, বীর জারা, যুবা, নো ওয়ান কিলড জেসিকা, তালাশ, মারদানী, হিচকির মত সিনেমা। তবে রানী সিনেমাপ্রেমীদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা 'ব্ল্যাক' সিনেমার জন্য, এক অন্ধ এবং বোবা মেয়ের ভূমিকায় দূর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন তিনি, যা এখনো যেকোন অভিনেত্রীর জন্য গাইডেন্সের মতো কাজ করে। 'হাম তুম' ছবিটিও তার ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
মূল নায়িকা হোক, বা কখনো পার্শ্ব চরিত্র তার অভিনয় প্রতিভা দিন দিন আরো বেশী পরিপক্ক হয়েই ফুটে উঠেছে সেলুলয়েডে। যেকোন চরিত্রে সবসময় নিজেকে সমুজ্জ্বল করেছেন তিনি। পর্দায় তার দিক থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে যায় দর্শকদের জন্য। যার স্বীকৃতিস্বরুপ জিসিনে, ফিল্মফেয়ার, আইফা, স্টারডাস্ট সহ বলিউডের প্রায় সব পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। বিশেষ জাতীয় পুরস্কারজয়ী 'ব্ল্যাক' সিনেমার এই অভিনেত্রীকে গতবছর দেখা গেছে নতুন 'হিচকি' সিনেমায়।
তবে মাঝে একটা সময় প্রধান নায়িকা হিসেবে রানীর বেশ কিছু সিনেমা ফ্লপ হয় এমনকি মুক্তির আগে আলোচিত 'আইয়া'র মত কনটেন্ট নির্ভর সিনেমাও যখন ফ্লপ করে তখন কিছুদিনের জন্য বিরতি দিয়ে 'মারদানি' সিনেমার মাধ্যমে ফিরে আসেন তিনি স্বমহিমায়। ২০১৪ সালে তাকে দেখা গিয়েছিল 'মারদানী' সিনেমায়। চার বছর পরে তিনি ২০১৮ সালে ফিরছেন 'হিচকি' সিনেমার মধ্য দিয়ে। একজন শিক্ষিকার ভূমিকায় অভিনয় করছেন তিনি যার কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কথা আটকে যাবার একটি রোগ রয়েছে। বিয়ে এবং মা হবার পরে কামব্যাক সিনেমাতে সফল হবেন রানী এমনটা আশা করেছিলেন রানী এবং তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তাদের আশা বিফলে যায়নি। 'হিচকি' বক্স অফিস এবং সমালোচক সব ক্ষেত্রেই সফল। সাথে রানীর অভিনয় নতুন করে আলোচনায় এসেছিলো।

তবে অভিনেত্রী রানী যে ফুরিয়ে যাননি তার প্রমান তিনি দিয়েছেন তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘মারদানি-২’ সিনেমায়। সাসপেন্স এবং থ্রিলারধর্মী এই সিনেমায় আবারো এক পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে। ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনসহ নানা সামাজিক সমস্যায় রুখে দাঁড়ানো পুলিশ কর্মকর্তা শিবানী শিবাজি রায় এই সিনেমার মূল চরিত্র। আর বড় পর্দার সেই মারদাঙ্গা আইপিএস কর্মকর্তা রানী মুখার্জী।
‘মারদানি টু’ সিনেমাতে রানী মুখার্জী ছাড়া আর কোনো বড় তারকা নেই। রানী মুখার্জির নেই কোনো ‘নায়িকা লুক’। নেই কোনো গান, আইটেম সং তো দূরের কথা নেই কোনো চমৎকার বিদেশি লোকেশন। উল্টো রানী মুখার্জী রাজস্থানের জয়পুরে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুলিশের পোশাক চেপে ছুটেছেন অপরাধীর পেছনে। মুক্তির পর থেকেই দর্শক আর সমালোচক, উভয় পক্ষের প্রশংসা কুড়িয়েছে এই সিনেমা।
চল্লিশের পরে নাকি বলিউড নায়িকারা অভিনেত্রী হিসেবে নিজেদের এক অন্যতম সেরা আসনে নিয়ে যান, উদাহরণস্বরূপ ওয়াহিদা রহমান, নূতন, শাবানা আজমী, জয়া বচ্চন, হেমা মালিনী, শ্রীদেবী, মাধুরী থেকে কাজল এরা সবাই চল্লিশের পরে নিজেদের ক্যারিয়ারের সেরা কিছু কাজ উপহার দিয়েছেন। ৪৩ বছর বয়সী রানী 'হিচকি' দিয়েই সেই পথেই নতুন যাত্রা শুরু করেছিলেন। এরপর 'মারদানি ২' দিয়ে সেই যাত্রাপথ আরো সুসংহত করলেন তিনি সেকথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। বাকিটা হয়তো সময়ই বলে দিবে।
তার সমসাময়িক নায়িকারা (কারিনা কাপুর খান বাদে) যখন একভাবে বললে বিদায় নিয়েছেন বলিউড থেকে সেখানে রানী পরপর তিনটি বক্সঅফিস হিট উপহার দিয়েছেন। এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তিনটি সিনেমাই নারীপ্রধান গল্পের। বলিউড যে আস্তে আস্তে কন্টেন্ট নির্ভর সিনেমার প্রতি ঝুকছে তা এখন বলা যায় সন্দেহাতীত ভাবে। যেখানে আগে বিয়ের পর নায়িকারা সফল হলেও সেটি ভিন্নধারার সিনেমা বা আর্টফিল্ম ঘরানার মাধ্যমে আলোচনা এবং প্রশংসা কুড়াতেন সেখানে বানিজ্যিক সিনেমায় রানী নিজেকে আরো বেশি অপরিহার্য অভিনেত্রী হিসেবে প্রমান করে যাচ্ছেন।
সামনে রিলিজের অপেক্ষায় আছেন সাইফ আলী খান, সিদ্ধার্থ চতুর্বেদী, শর্বরীর সাথে সুপারহিট ‘বান্টি অর বাবলি’ এর দ্বিতীয় কিস্তি ‘বান্টি অর বাবলি-২’। এছাড়া ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ নামক একটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন সম্প্রতি। খুব শিগগিরই সিনেমার শ্যুটিং শুরু হতে যাচ্ছে।
ব্যক্তিজীবনে ২০১৪ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন বলিউডের স্বনামধন্য এবং সফল প্রযোজক পরিচালক আদিত্য চোপড়াকে। ২০১৫ সালে কন্যা সন্তানের মা হন তিনি। মেয়ের নাম আদিরা চোপড়া। সংসার, স্বামী এবং মেয়েকে সময় দেবার পাশাপাশি কোন মন ছুয়ে যাওয়া স্ক্রিপ্ট পেলেই রুপালি পর্দায় হাজির হবেন তিনি এমন থিওরি ফলো করা ক্যারিয়ারে মনোযোগী এই গুনী এবং জনপ্রিয় বলিউড অভিনেত্রীর জন্য রইলো অনেক অনেক শুভকামনা এবং শুভেচ্ছা।