সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী', লিজো জোশে পেলিসারির 'জালিকাট্টু' বৈশ্বিক হয়েছিলো আঞ্চলিকতার মোড়কেই। এসব সিনেমার সাথে তুলনায় যাচ্ছিনা, তবে এটুকু বলতেই পারি, 'হাওয়া' সিনেমায় যেভাবে প্রচ্ছন্নে প্রকট হয় 'আঞ্চলিকতা', আঞ্চলিকতার আটপৌরে মোড়কেই যেভাবে জলজ এক গল্প শোনান মেজবাউর রহমান সুমন, সেটুকুর গুণে হলেও এ সিনেমা অনায়াসেই পৌঁছে যায় বৈশ্বিক মানে...

সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে স্মৃতিচারণায়  একবার বলেছিলেন-

ঋত্বিক বাবুর সিনেমাগুলো আশ্চর্যভাবে আঞ্চলিক। সিনেমা আমরা সবাই-ই বানাচ্ছি। আর, এ কথা অস্বীকার করারও উপায় নেই- আমাদের সিনেমাতে না চাইতেও মাঝেসাঝে হলিউডের ধাঁচও চলে আসে। যদিও, এটার পেছনে যুক্তিও আছে। যুক্তিটি হচ্ছে- আমাদের দেখার সিনেমাগুলোর অধিকাংশই হলিউডের। সুতরাং, একটু হলেও টান চলে আসবেই, সেটা স্বাভাবিকও। কিন্তু, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করি- ঋত্বিক ঘটক নিজে বিস্তর হলিউডি সিনেমা দেখলেও, সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে কিভাবে কিভাবে যেন দেশী রূপ-রস-গন্ধ'কেই তিনি বজায় রেখেছেন নিখুঁতভাবে।

অন্য ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা দেখে অনুপ্রেরণা পাওয়ার বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক। এই যেমন- অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমাতে মাঝেসাঝেই মার্টিন স্করসেসির আভাস পাওয়া যায়। উল্টোও আছে, ক্রিস্টোফার নোলান আবার সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী'  দেখে ভারতীয় সিনেমা নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। তবে, যাই হোক, মোদ্দা কথা এটাই- যেহেতু, সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে এখনো হলিউড-ই আমাদের শেষ কথা, সেহেতু কিছু বিষয়ে সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া বোধহয় দোষেরও কিছু না। তবুও, অবাক হই, 'মেজবাউর রহমান সুমন' এর 'হাওয়া' দেখে। এই সিনেমার মধ্যে কেন যেন আঞ্চলিক অবয়বকেই ক্রমশ হতে দেখি প্রধান। একটা সিনেমার ক্ষেত্রে যেটা যেকোনো বিচারেই খুব বড় একটা গুণ। 

সিনেমার শুরু থেকেই, যেভাবে মাছধরা ট্রলারের যাত্রা শুরু হয়, সেখানে থাকা অধিবাসীরা যেভাবে সাজিয়ে বসে জীবনের আয়োজন, যেরকম বেশভূষা থাকে তাদের ('গুলতি'র শাড়ি-চুলের কাঁটা, চান মিয়ার লুঙ্গি-জামা-হাতের ঘড়ি বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য), সেখানে যেভাবে বজায় থাকে আঞ্চলিকতার প্রভাব, তাতে শুরুতেই নড়েচড়ে বসতে হয়। স্থানীয় 'কুসংস্কার'কে যেভাবে ফোকাস করা হয়, সেই কুসংস্কারের সাথে যেভাবে মেলানো হয় আবহমানকাল ধরে বহমান 'মনসা-মঙ্গল' এর অক্ষরকে, আঞ্চলিকতা সেখানেও থাকে আশ্চর্যজনকভাবে সজাগ।

আঞ্চলিকতা বজায় রইলো পোশাকেও 

এখানেই শেষ না। 'সাদা সাদা কালা কালা' গানে একটামাত্র খমকে আর থালা-বাসনের বয়ানেই যেভাবে শেষ করা হয় পুরো আয়োজন, সেখানেও বজায় থাকে আঞ্চলিকতা। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র, দেশীয় গান, দেশীয় সুর... এরকম দেশজ গান শেষ কবে কোন বাংলা সিনেমায় শুনেছি, ভাবতে গেলে খানিকটা চমকাতেই হয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে- 'মেঘদল' এর গাওয়া 'এ হাওয়া' গানটাকে সিনেমায় অন্তর্ভুক্ত করা কেন হয়নি, এ নিয়ে অনেককেই আক্ষেপ করতে দেখেছি। কিন্তু, এই গানটিকে যদি সিনেমার কোনো অংশে আনা হতো, তাহলে 'দেশজ' ঘ্রাণ থেকে সিনেমার যে স্থানচ্যুতি হতো, সেখানেও নেই কোনো সন্দেহ। পরিচালক কি এটা ভেবেই গানটিকে যুক্ত করেননি সিনেমার সাথে? হতেও পারে!

এবং, এই আঞ্চলিকতা নিয়ে কথাবার্তার শেষটুকু টানবো, যে বিষয় নিয়ে, সেটা নিয়ে কিছু মানুষের সমালোচনা দেখলাম সবখানে। সেটি হচ্ছে- গালির যথেচ্ছাচার। 'গালি' নিয়ে বিষদ বিশ্লেষণে যাবো না, তবে রাখঢাক করেও যদি বলি- জেলে নৌকার মাঝি-মাল্লারা যে গালিবর্ষণ করলেন, সেগুলোও আমাদেরই গালি। হ্যাঁ, খুলনা অঞ্চলের মানুষ কেন ঢাকার প্রচলিত গালি দিচ্ছে, তা নিয়ে কথাবার্তা হতে পারে। তবে, মনে রাখতে হবে এও, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হলে গালির থাকেনা অঞ্চল, কাল, দেশ। যেটাও আমাদের আঞ্চলিক মেজাজেরই বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া, জেলে নৌকার মানুষেরা যেভাবে এই গালিগুলোকে প্রয়োগ করলেন, সেখানেও বজায় রইলো আঞ্চলিকতার-ই প্রাধান্য।

সবার হাবেভাবে ষোলোআনা বজায় রইলো আঞ্চলিকতা! 

মেজবাউর রহমান সুমন বলেছিলেন-

সিনেমা আঞ্চলিক না হলে, সে সিনেমা বৈশ্বিক হয়ে ওঠে না।

আমিও কথাটার সাথে পুরোপুরি একমত। সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী', লিজো জোশে পেলিসারির 'জালিকাট্টু' বৈশ্বিক হয়েছিলো আঞ্চলিকতার মোড়কেই। এসব সিনেমার সাথে তুলনায় যাচ্ছিনা, তবে এটুকু বলতেই পারি, 'হাওয়া' সিনেমায় যেভাবে প্রচ্ছন্নে প্রকট হয় 'আঞ্চলিকতা', আঞ্চলিকতার আটপৌরে মোড়কেই যেভাবে জলজ এক গল্প শোনান মেজবাউর রহমান সুমন, সেটুকুর গুণে হলেও এ সিনেমা অনায়াসেই পৌঁছে যায় বৈশ্বিকমানে। এখানেই হয়তো বাদবাকি সিনেমার সাথে হয় 'হাওয়া'র মূল তফাত।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা