'রেহানা মরিয়ম নূর' কি সুশীলদের ছবি? এটা কি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষিত শ্রেণির বৌদ্ধিক স্তরেই বুদবুদ তোলে? মন ছবি দেখা কি ভালো? কেন দেখব এমন ছবি?

'রেহানা মরিয়ম নূর' কেমন ছবি? এটা কি সুশীলদের ছবি?

ছবিটি দেখতে বসে মনে হচ্ছিল, আমি সিনেমা দেখছি না, জীবন দেখছি। পুরো ছবিটি একটি লোকেশানে, একটি হাসপাতালে ধারণ করা। কম বাজেটেও যে ভিন্ন স্বাদের সিনেমা বানানো যায়, এবং সিনেমা বানানোর জন্য যে টাকা মূখ্য বিষয় নয় (সিনেমা বানাতে অবশ্যই টাকা লাগে, তবু কথাটি বললাম সঙ্গত কারণেই), থাকতে হয় প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর আমি কোন পদ্ধতিতে সিনেমার গল্পটি বলতে চাই, সে সমন্ধে সম্যক ধারণা, এই ব্যাপারটি 'রেহানা মরিয়ম নূর' আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

*

অভিনেতা-অভিনেত্রী এখানে অনেকেই আছেন। তবে মূল রেহানা চরিত্র রূপায়ণকারী আজমেরী হক বাঁধন সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, তিনি কি আসলে অভিনয় করেছেন? তার কি অভিনয় করার দরকার পড়েছে আদতে? এমনই ন্যাচারাল ছিল তার অভিনয়-ভঙ্গিমা। অবশ্য আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের এই দ্বিতীয় ছবিতে বাঁধনই মূল ফোকাস, 'লাইভ ফ্রম ঢাকা'য় যেমন ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার।

রেহানা মরিয়ম নূর সিনেমার একটি দৃশ্যে বাঁধন

ছবিটির পুরো ক্যানভাস নীল। কেন? আমাদের চেনা জীবনের ভেতরকার বেদনার গল্প এখানে বলা হলো বলে?

এই ছবিতে নারীবাদ আছে। আছে নারীবাদকে কেন্দ্র করে সমাজের মধ্যে চলা সাম্প্রতিক তর্কও। অর্থাৎ এখানে নারীবাদকেন্দ্রিক সমসাময়িক বিষয়-আশয় নিয়ে থিসিস ও অ্যান্টিথিসিস যেমন আছে, তেমনি অনুচ্চ স্বরে হলেও কি নেই সিনথিসিসও?

আছে।

এখানে আছে নাগরিক মধ্যবিত্তের ধর্মচর্চা। তবে এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি বা আরোপ নেই কোথাও।

*

স্বাধীনতার পর এখন আমাদের বিকাশমান যে নগর, তাকে তো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে করপোরেট। সেই করপোরেট সংস্কৃতি আমাদের সাধারণের জীবনকে কীভাবে তাদের ইচ্ছায় চালিত করে, অনেক সময় চলতে বাধ্যও যে করে, আমার কাছে তার মর্মান্তিক খতিয়ান হলো 'রেহানা মরিয়ম নূর'।

তবে মজার ব্যাপার হলো, ছবিটি আপনার ভেতরে কোনো ধরণের চাপ তৈরির বিপরীতে আপনাকে কেবল আলতো করে বেদনার্ত করতে চায়। অনেকটা 'একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে একবার বেদনার পানে'র মতন। আর এই বেদনার ক্ষেত্রে কোনো উপশম তো সে দেয়ই না, বরং খানিকটা সময় আপনাকে গ্রাস করে আপনাকে ভাবাতেও চায় ওই নচ্ছাড় নীলচে ক্যানভাস।

পরিচালক সাদ এবং অভিনেত্রী বাঁধন

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের রেহানা মরিয়ম নূর আমাদের চাপহীনভাবে ভাবতে সাহায্য করে। বলে আমাদের নিজেদের সময়ের গল্প৷ ফলে, চেনা সময়ের, চেনা জীবনের গল্পটি বলার ক্ষেত্রে যখন নির্মাতা সাদ কোনো ছক না মেনে নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে 'অচেনা' পন্থায় গল্প বয়ান করেন, সে সময় আমরা শুধু বিস্ময় নিয়ে দেখি। দেখি আর ভাবি যে এভাবেও গল্প বলা যায়! এভাবে আমার জীবনের গল্প সিনেমার আয়োতনে আগে বলেনি তো কেউ! এবং আমাদের চারপাশে, চরাচরে সুনশান নীরবতা নেমে আসে।

*

লেখার শুরুতে প্রশ্ন রেখেছিলাম, 'রেহানা মরিয়ম নূর' কি সুশীলদের ছবি?

প্রশ্ন রেখেছিলাম এ কারণে যে, ছবিটি দেখতে দেখতে একসময় মনে হচ্ছিল, এটা কি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষিত শ্রেণির বৌদ্ধিক স্তরেই বুদবুদ তোলে?

কিন্তু সিনেমা শেষে মনে হলো, না, এই কাহিনিচিত্রটি আমাদের বুদ্ধির গোড়ায় কোনো রকমের পানিই ঢালে না, এটা আমাদের কেবলই নিজেদের মুখ আয়নায় দেখতে বাধ্য করে। আমাদেরকে জীবন দেখায়। অতঃপর কোনো প্রশ্ন না রেখে, কোনো বক্তব্য না দিয়েও দর্শকমনে প্রশ্ন তৈরি হওয়ার, বক্তব্যের চেয়ে বেশি 'বোধ' জন্ম নেওয়ার পটভূমি রচনা করে নীরবে প্রস্থান করে।

এখন আরও একটি প্রশ্ন করা যাক: এমন ছবি দেখা কি ভালো? কেন দেখব এমন ছবি?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শেষে এভাবে যদি বলি, কেন আমরা একটি ভালো গল্প পড়ি? কেন পড়ি ঘোরগ্রস্ত একটি কবিতা?

ঠিক একই কারণে আমরা 'রেহানা মরিয়ম নূর'ও দেখতে পারি। কারণ, এই ছবি আর কিছু করুক না করুক, আমাদের ঘোরের চক্করে ফেলে দেবে, আমাদেরকে একান্ত নিজের কাছে নিঃশব্দ করে রাখবে কিছুক্ষণ। একটি ভালো গল্প বা ভালো কবিতা পড়ার পর যে অনুভূতি হয়, সেই একই অনুভূতি আপনাকে দেবে 'রেহানা মরিয়ম নূর'।

তাই দেরি না করে ছবিটি দেখে ফেলাই তো উত্তম!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা