বাংলাদেশের কোনো প্রেক্ষাগৃহে অথবা ওটিটি প্লাটফর্মে রিলিজ করার আগেই 'রেহানা মরিয়ম নূর' সিনেমা হয়েছে ফাঁস। অনলাইনে মুক্ত হওয়া এই সিনেমা হাজার, লাখ কপিতে বিভক্ত হয়ে কুষ্ঠরোগের মতন দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়েছে টরেন্ট, গুগল ড্রাইভ, টেলিগ্রাম সহ নানাবিধ মাধ্যমে। মানুষ দেদারসে সেগুলো ডাউনলোড করছে। দেখছে। ইনবক্সে ইনবক্সে শেয়ার করছে। রীতিমতো এক উৎসবেই পরিণত হয়েছে সবকিছু...

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এর 'রেহানা মরিয়ম নূর' যখন 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এর গুরুত্বপূর্ণ 'আঁ সাতেঁ রিগা'র জন্যে মনোনীত হয়, আমরা, বাংলাদেশের মানুষ,  যারপরনাই গর্বিত হলাম। এর আগে বাংলাদেশের আর কোনো সিনেমা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ চলচ্চিত্র উৎসবের মূল পর্বে তো যায়ইনি, এ সিনেমা সেখানে দেখানোর পরে যেভাবে উপস্থিত দর্শকদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা, মুহুর্মুহু করতালি এবং স্টান্ডিং ওভেশন পেয়েছে, সেটিও আমাদের দেশের সিনেমার জন্যে বিরলতম অভিজ্ঞতা। সিনেমাবিষয়ক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট 'রজার এবার্ট ডট কম' এ এই সিনেমা নিয়ে প্রশংসার রিভিউ লিখেছেন ব্রায়ান ট্যালেরিকো। ধরা হয়, ব্রায়ান কোনো সিনেমা নিয়ে রিভিউ দিলে সে সিনেমার মান বেড়ে যায় কয়েকগুণ! বলিউডের মাস্টার ডিরেক্টর অনুরাগ কাশ্যপ থেকে শুরু করে অনেকেই এই সিনেমা নিয়ে সময়ে-সময়ে তাদের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন৷ 

অনুরাগ কাশ্যপ থেকে শুরু করে অনেকেই এই সিনেমা নিয়ে তাদের মুগ্ধতা জানিয়েছেন! 

বাংলাদেশের মত ছোট্ট একটুকরো দেশের খুবই অনুন্নত,  ক্রমশ পশ্চাৎগামী সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির এক সিনেমা নিয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা মানুষজনেরা যেভাবে মাতামাতি করেছে, তাতে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়েছি আমরাও। গর্ব হয়েছে৷ চোখ ভিজেছে জলে। এই এক সিনেমাকে কেন্দ্র করে আমরা আবারও এই মরে যাওয়া ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ে আশাবাদী হয়েছি, যেমনটি ডুবে যাওয়া মানুষ খড়কুটোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা চালায়। 'রেহানা মরিয়ম নূর' আমাদের এমন সব অনুভূতি, সম্মানের সাথে পরিচয় করিয়েছে, যা এর আগে আমাদের কাছে ছিলো বিরল, অজানা, অপরিচিত।

তবে ঘূনাক্ষরেও কল্পনা করিনি, এই সিনেমার সাথে ওতপ্রোতভাবে আমাদের লজ্জার গল্পও মিশে থাকবে! যে গল্প গত কিছুদিন ধরে অন্তর্জালে ভেসে বেড়াচ্ছে দগদগে ঘা এর মতন। যে সংবাদের সারমর্ম- বাংলাদেশের কোনো প্রেক্ষাগৃহে অথবা ওটিটি প্লাটফর্মে রিলিজ করার আগেই 'রেহানা মরিয়ম নূর' সিনেমা ফাঁস হয়েছে। অনলাইনে ফাঁস হওয়া এই সিনেমা হাজার, লাখ কপিতে বিভক্ত হয়ে কুষ্ঠরোগের মতন দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়েছে টরেন্ট, গুগল ড্রাইভ, টেলিগ্রাম সহ নানাবিধ মাধ্যমে। মানুষ দেদারসে সেগুলো ডাউনলোড করছে। দেখছে। ইনবক্সে ইনবক্সে শেয়ার করছে। রীতিমতো এক উৎসবেই পরিণত হয়েছে সবকিছু। 

মানুষের লকলকে জিহ্বার সামনে পরাজিত হয়েছে এ সিনেমা! 

মানুষ মুফতে সিনেমাটি পেয়ে ভুলেই গিয়েছে, এই সিনেমাটি কোনোভাবেই প্রাপক ছিলো না এই অসম্মানের। সিনেমাহলে টিকেট কেটে কিংবা ওটিটির প্যাকেজ কিনে আইনি উপায়ে এই সিনেমা দেখাটাই ছিলো এই সিনেমার একমাত্র প্রাপ্য। মানুষ এটাও ভুলে গিয়েছে, এই সিনেমা যে সম্মান এই দেশের জন্যে নিয়ে এসেছিলো, সে সম্মানের বিনিময়ে তারা ফেরত দিয়েছে একরাশ বিশ্বাসঘাতকতা। এমন না যে, এদেশের মানুষ এর আগে টরেন্ট থেকে কোনো সিনেমার পাইরেটেড কপি ডাউনলোড করেনি। বরং এদেশের মানুষ সিনেমার হলপ্রিন্ট ডাউনলোড করে 'আলুথালু-বিবস্ত্র' প্রিন্টের সিনেমা দেখতেও কুন্ঠাবোধ করে না। তাদের কাছে সিনেমা যেকোনোভাবে দেখাটাই মুখ্য। বহু বছর ধরে চলে আসা এ লোভ তাই তারা সামলাতে পারবেন না, সেটা হয়তো একরকম বাস্তবই ছিলো। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়, 'রেহানা মরিয়ম নূর' এর ক্ষেত্রেও তাদের এই লকলকে লোভের জিহ্বা সামলে রাখা কি খুব কষ্টের কাজ হতো? এরকম হিংস্রভাবে এই সিনেমার উপরে হামলে না পড়লে কি হতো না? এই নিকৃষ্ট কাজটি করার কি খুব দরকার ছিলো? একটু আত্মসংযমের এতই অভাব আমাদের?

আমরা যখন এভাবে পাইরেসি করে কোনো জিনিস দেখি, আমরা আসলে ঠিক কতটুকু তৃপ্তি পাই? প্রত্যেক নির্মাণের পেছনে একদল মানুষের কষ্ট, শ্রম, অর্থলগ্নির যে একেকটা ক্লান্তিকর গল্প, সেগুলো কি আমরা মনে রাখি কখনো? আমরা যখন এভাবে একদল মানুষের রুটিরুজি নষ্ট করি, তাদের কষ্টার্জিত নির্মাণকে এভাবে হেলায় ধূলোয় মিশিয়ে দিই, এইসব সৃজনশীল মানুষকে পথে বসানোর আয়োজন করি, দেঁতোহাসি হেসে চোরাইপথে সিনেমা দেখার উল্লাসে মাতি, আমার জানতে ইচ্ছে করে, আমরা আমাদের বিবেককে ঠিক কোথায়, কোন সিন্দুকে আটকে রাখি তখন? একটা সিনেমা মুক্তির পরে সবার আগে সেই সিনেমার হলপ্রিন্ট দেখে আমরা আসলে কী জাহির করতে চাই? সবার আগে সিনেমা দেখে আমরা আসলে ঠিক কোন প্রতিযোগিতার বিজয়ী হই? 

এদেশে এখন কেউ টাকা দিয়ে গানের ক্যাসেট, সিডি কেনে না। গুগল,  ইউটিউব থেকে নিখরচায় নামানো যায় সব। টাকা দিয়ে কেউ কেন গান কিনবেন? এরচেয়ে পাবজি গেমের ইকুইপমেন্ট কেনা সোজা! গান গাইতে পরিশ্রম হয় নাকি? গানের শিল্পীর আবার পেটের ক্ষুধা আছে নাকি? তার টাকাপয়সা লাগে নাকি? সে তো এমনি এমনিই গান গাচ্ছে। আমরা যে শুনছি, এটাই তো অনেক! এভাবে ভাবতে ভাবতে গানের সিডি, ক্যাসেট বিকিকিনির এককালের রমরমা সংস্কৃতি বেমালুম উবে গেছে এ দেশ থেকে। অর্নবের মত শিল্পী এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে নিজে গানের সিডি বিক্রি করেছেন। কলকাতার প্রখ্যাত শিল্পী নচিকেতা দোকানে দোকানে ঘুরে নিজের সিডি বিক্রি করার জন্যে চেষ্টা করেছেন। এরপর আক্ষেপ করেছেন৷ বলেছেন-

এখন আর কেউ টাকা দিয়ে গান শুনবে না। মানুষের বিবেক মরে গিয়েছে৷ 

এত এত শিল্পীর এত এত চেষ্টার পরেও ক্যাসেট, সিডির এককালের তুমুল জনপ্রিয় সে সংস্কৃতি আজ বেমালুম মৃত। অ্যাপ, ওয়েবসাইট, ইউটিউব থেকে এখন কন্ঠশিল্পীরা যতটুকু যা পাচ্ছেন, সেটাই সম্বল। ওদিকে বই-ব্যবসারও একই অবস্থা। আজকাল কিনে কয়জন বই পড়ে, হাতের কড় গুনে বলে দেয়া যাবে। এমনিতেও বই পড়ে গুটিকয়েক মানুষ। কিনে পড়া তো আরো দূরের কথা৷ নতুন নতুন বই বাজারে আসার সাথে সাথেই পিডিএফ বানায় এক চক্র। সেই পাইরেটেড পিডিএফ পড়ে পাঠকশ্রেনির এক বিরাট অংশ৷ মহামারির ছোঁয়া লেগেছে সেখানেও। একজন লেখক কতটা শ্রম ও সময় দিয়ে বই লিখলেন কিংবা একজন প্রকাশক ঠিক কতটুকু আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে সে বই ছাপালেন, সে খবর রাখি না কেউ৷ নিয়মিত খবর পাই, নীলক্ষেতের একেকটা বইয়ের দোকান বন্ধ হচ্ছে৷ পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন একেকজন বই-বিক্রেতা, অজানা কোনো গন্তব্যে। বইয়ের দোকান ভেঙ্গে হচ্ছে ভাতের দোকান, টিশার্টের দোকান, কসমেটিকস এর দোকান! দায়ী কে? আমরা। শুধুমাত্র আমরা। 

বাংলায় একটা চালু প্রবাদ আছে- সুযোগের অভাবে সবাই সৎ। সেটাই যেন বারবার প্রমাণ করে এদেশের মানুষ। 'মানুষ' নামক মুখোশের আড়ালে আমরা যে খুবই হিংস্র জন্তু, সেটাই যেন সময়ে-অসময়ে নানা প্রেক্ষাপটে বেরিয়ে আসে৷ 'রেহানা মরিয়ম নূর' সিনেমার ক্ষেত্রেও যেমন টিকটিকির লেজের মতন খসে পড়লো অনেকের মুখোশ। হয়তো এ চৌর্যবৃত্তি করে পাওয়া সিনেমাটি তারা দেখবেনও। হয়তো সিনেমাসংক্রান্ত নানা মাধ্যমে সেগুলো নিয়ে বড় বড় কথাও বলবেন। কিন্তু বিবেকের সামনে তারা কি দাঁড়াতে পারবেন? তারা হয়তো প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরবেন৷ কিন্তু ভেতরে ভেতরে কি সামান্য হলেও কুঁকড়ে যাবেন না? তারা কি জীবনে কোনোদিনও বলতে পারবেন, এই সিনেমা চুরি করে দেখার সুযোগ ছিলো আমারও, কিন্তু আমি তা করিনি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, এই মানুষদের কী আসলেই বিবেক, রুচিবোধ কিংবা মনুষ্যত্ব বলে কোনো পদার্থ আছে?

এরকম অকৃতজ্ঞদের জন্যে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ'রা কেন সিনেমা বানাবেন? কেন নিজেদের জীবন, শ্রম, সারাজীবনের উপার্জন ঝুঁকির মুখে ফেলে এসব নিকৃষ্ট উলুবনে মুক্তা ছড়াবেন তারা? কেউ কি জানেন? কেন এদেশে গানের ক্যাসেটের দোকান উচ্ছেদ হয়ে কাপড়ের দোকান হবে না? কেন বইয়ের দোকানের জায়গায় ভাতের দোকান হবে না? আপনার যে ভূমিকা ছিলো এসবের পেছনে, সেটা কতটুকু স্বীকার করেন আপনি? কতটুকু সৎ ছিলেন আপনি আপনার কাজে, দায়িত্বে, মানসিকতায়? বলতে পারবেন? যদি বলতে পারেন, তাহলে তো পারলেনই। যদি না পারেন, তাহলে বুঝে নেবেন, এই হাহাকারের, এই দাবানলের পেছনেও আপনার দায় মোটেও কম না। আপনিও কম দায়ী নন।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা