কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী- সর্বত্র শুধু একটাই নাম, রিহান্না! ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে তিনি টুইট করার পরেই সাড়া পড়ে গেছে ভারত সরকারের অন্দরমহলে, বিপদ সংকেত বেজে উঠেছে আইটি সেলের অফিসে, ভারতীয় সেলিব্রেটিরা নেমেছেন নিজেদের দেশপ্রেমিক প্রমাণের মিশনে...

সেলিব্রেটিদের একটা টুইটে কী এমন হতে পারে? বড়জোর বিতর্ক তৈরি হতে পারে, নতুন হ্যাশট্যাগ চালু হতে পারে, ট্রোল আর্মির ব্যস্ত সময় কাটতে পারে, কোন রাজনীতিবিদ বা ক্ষমতাসীন নেতা-নেত্রীকে উদ্দেশ্য করে নোংরা টুইট করলে বা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিলে বড়জোড় মামলা হামলার ঝামেলা পোহানো লাগে, স্থান-কাল-পাত্রভেদে জেলের ঘানিও টানা লাগতে পারে। নেটিজেনরা আজ পর্যন্ত এমনটাই দেখেছেন। কিন্ত একজন পপ স্টারের একটা টুইটে সোয়াশো কোটি মানুষের একটা দেশে তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে, সরকার দলের আইটি সেল উঠেপড়ে লেগে গেল, শুধু তাই নয়, দেশটার নানা অঙ্গনের সেলিব্রেটিদের নামানো হলো ভিনদেশি সেই তারকার টুইটের জবাব দেয়ার জন্য! গোটা ব্যাপারটাকে যদি সিনেমার গল্প ভেবে থাকেন, তাহলে বলে রাখি, পুরোটাই বাস্তব। 

ভারতে কৃষকদের আন্দোলন চলছে, প্রায় তিন মাস ধরে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা চাষীরা দিল্লির সিঙ্গু এবং গাজিয়াবাদ বর্ডারে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করছেন ভারত সরকারের নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে। রাস্তায় বাধা, পুলিশের লাঠিচার্জ, জলকামান, বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ- কিছুই তাদের রুখতে পারেনি। ফেব্রুয়ারীর ৩ তারিখে মার্কিন পপ তারকা রিহান্না সিএনএনের একটি নিউজ আর্টিকেল নিজের অফিসিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে শেয়ার দেন, সঙ্গে প্রশ্ন করেন, কেন আমরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলছি না? 

রিহান্নার ওই টুইটের সাথে সাথে যেন মৌচাকে ঢিল পড়লো। একদিকে রিয়ান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষেরা। আর অন্যদিকে বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌত এসে রিহান্নাকে 'পর্নস্টার' সম্বোধন করে টুইট করলেন, সেখানে আন্দোলনরত কৃষকদের উগ্রপন্থী এবং জঙ্গী বলে উল্লেখ করলেন, যেটা কঙ্গনা আগেও করেছেন। কঙ্গনার উল্টোপাল্টা বলার স্বভাব আছে, কিন্ত এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলো না ব্যাপারটা। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অফিসিয়ালি একটা প্রেসনোট জারি করলো, তাতে লেখা হলো, কৃষকদের আন্দোলন ভারতের আভ্যন্তুরীন মামলা, এটা নিয়ে বিদেশী কারো মন্তব্য না করাই ভালো! 

সেইসঙ্গে ময়দানে নামানো হলো বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের। শচীন টেন্ডুলকার থেকে বিরাট কোহলি, রবি শাস্ত্রী থেকে ব্যাডমিন্টন তারকা সাইনা নেহওয়াল, কিংবা করণ জোহর, অক্ষয় কুমার থেকে অজয় দেবগন, সবাইকে দিয়ে টুইট করানো হলো। সেসব টুইটের ভাষ্য এক, শব্দ এক, যেন একই ব্যক্তির লেখা সবগুলো! তারা ভারতের মানুষকে 'ঐক্যবদ্ধ' থাকার আহবান জানালেন! রিহান্নার একটা টুইটের ক্ষমতা দেখুন, ভারত নামের রাষ্ট্রটাকেই খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলেছিলেন বার্বাডোজে জন্ম নেয়া এই পপ তারকা! 

রিহান্নার পাশাপাশি কৃষকদের সমর্থন দিয়েছেন গ্রেটা থানবার্গও

ভারত সরকার গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিরোধীদের আপত্তি স্বত্বেও নতুন কৃষি আইন পাশ করেছে। তখন থেকেই ভারতের প্রধান কৃষি বেল্ট খ্যাত এলাকা পাঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষীরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন নতুন কৃষি আইনের তিনটি ধারা বাতিলের দাবীতে। কৃষকদের বক্তব্য হচ্ছে, নতুন আইনের এই ধারাগুলোর কারণে তারা প্রচলিত বাজারমূল্য থেকে কম দাম পাবেন ফসল বিক্রির সময়। তাছাড়া দরদামের বিষয়টাও তাদের হাতে থাকবে না, পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করবে মধ্যস্বত্বভোগী তৃতীয় স্তরের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। 

পাঞ্জাবে দুই মাস আন্দোলনের পর কৃষকরা দিল্লির দিকে চলে এলো। রাস্তায় তাদের বাধা দেয়ার সব আয়োজন করে রেখেছিল ভারত সরকার, কিন্ত কৃষকদের ঠেকানো গেল না। দিল্লির সীমান্তে এসে তারা লাখো ট্রাক্টর নিয়ে ধর্ণায় বসেছেন, দাবী আদায় না করে ঘরে ফিরবেন না। দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এই তীব্র শীতের মধ্যেও তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, হাজারো ভয়-ভীতি, মামলা-হামলা আর কূটচালেও হার মানছেন না, দাবী থেকে একবিন্দু সরে যাচ্ছেন না। কৃষকদের এই ন্যায্য দাবীগুলো জনগনের মধ্যেও দারুণ সাড়া ফেলেছে, আবার সমানে প্রোপাগাণ্ডাও ছড়ানো হচ্ছে কৃষকদের নামে। 

রিহান্নার টুইটের পর যেভাবে দলবেঁধে সেটার প্রতিউত্তর দিয়েছেন ভারতীয় সেলিব্রেটিরা, সেটা হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে অনেকের মনে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যে জায়গাটায় তাদের অবস্থান ছিল, সেটা নড়ে গেছে অনেকের মন থেকে। শচীন টেন্ডুলকার থেকে লতা মঙ্গেশকর, সবাই উল্টো ট্রোলের শিকার হয়েছেন। নেটিজেনরা বলেছেন, কৃষকদের আন্দোলনকে ভারতের আভ্যন্তরীন ব্যাপার বলার আগে এই তারকাদের মাথায় রাখা উচিত ছিল, সেরকম হলে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মুভমেন্টটাও আমেরিকার আভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল। সেটা নিয়ে তো সবাই ঠিকই কথা বলেছে! এই তারকাদের সরকারের এজেন্ট বলতেও ছাড়েনি অনেকে। চার মাসের বেশি সময় ধরে কৃষকরা রাস্তায়, তখন কারো টুইট করার সময় হয়নি, এখন রিহান্নার টুইটের জবাব দিয়ে নিজেদের ভণ্ড দেশপ্রেমিক প্রমাণ করতে আসার দরকার ছিল না। 

ভারতীয় মিডিয়ার একটা অংশ, যারা সরকারের অন্ধভক্ত, তারাও রিহান্নার পেছনে লেগেছেন। পাকিস্তান আর চীনের কাছ থেকে টাকা খেয়েই নাকি রিহান্না এমন টুইট করেছেন, এই ছিল তাদের ভাষ্য! রিহান্নাদের বিরুদ্ধে ভারতের রাস্তায় মিছিলও হয়েছে! অথচ টুইটে রিহান্না লারো প্রতি অভিযোগই করেননি, শুধু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, কেন ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে কেউ কথা বলছে না? তাতেই অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে ভারত সরকারের! শুধু রিহান্না নয়, তাকে সমর্থন জানিয়ে গ্রেটা থানবার্গ, মিয়া খলিফাদের মতো আরও যারা কৃষি আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন, তারাও এরকম আক্রমণের শিকার হয়েছেন। একটা টুইটের শক্তি কতটা হতে পারে, সেটা রিহান্নার টুইটের পরেই বোঝা গেছে ভালোভাবে! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা