মীর সাব্বির যেভাবে নিজের ক্যারিয়ারের আরেক অধ্যায় শুরু করেছেন, তা দুর্দান্ত। তিনি হয়তো নিজেও ভাবেননি, নিজের সহকর্মী ও সাধারণ দর্শকের এত ভালোবাসা তিনি পাবেন। ভালোবাসার যেমন শক্তি আছে, দায়বদ্ধতাও আছে। আশা থাকবে, সিনেমা-সংক্রান্ত তার এই দুর্নিবার শক্তি ক্রমশই সমৃদ্ধ করবে এই ক্ষুদ্র বদ্বীপের সংস্কৃতিক্ষেত্রকে!
একজন মানুষের গল্প বলি। একরোখা এক মানুষের গল্প। যিনি অনেকদিন ধরেই দেখছেন ক্যামেরার এপাশ-ওপাশ। করেছেন সিনেমা-নাটকে অভিনয়। বানিয়েছেন অজস্র নাটক। কিন্তু কিছুতেই যেন স্বস্তি নেই। অবশ্য স্বস্তি হবেও বা কেন? বারবার চেনা ঘর, চেনা গণ্ডি। এসব কাহাতকই বা সহ্য হয়? ভেতরের ডাক তার বড় কিছুর, বৃহৎ কিছুর। সমুদ্রের জলযান, নদীতে সঞ্চার করা খানিকটা হিমশিমেরও। সে কারণেই হয়তো এই মানুষ আর নদীতে থাকতে চাইলেন না। ভাবলেন, যা হোক এবার, সর্বস্ব বাজি রেখে সমুদ্রে নামবেন। বানাবেন সিনেমা। ক্যামেরার সামনে থাকবেন, পেছনে থাকবেন৷ পরিচালনায় থাকবেন, অভিনয়ে থাকবেন, থাকবেন গানেও। সিনেমাটা বানানো হলো। যে সিনেমায় তিনি একে একে দেখালেন তিনটি ঝকমকে তারা৷ নির্মাণশৈলী, অভিনয়-ক্ষমতা, গীতিকার-দক্ষতা। মানুষটি মীর সাব্বির৷ গল্পটা ফিনিক্স পাখির পুনর্জাগরণের। গল্পটা 'রাত জাগা ফুল' এর৷
মীর সাব্বিরের অভিষেক সিনেমা 'রাত জাগা ফুল' দেখে কোনো অংশেই এটা ভাবার অবকাশ পাইনি, এ সিনেমা এমন একজন মানুষ বানিয়েছেন, যিনি এর আগে সিনেমার এত বড় লটবহরকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেননি কখনোই! আচ্ছা, ক্যামেরার পেছনে থেকে সিনেমা বানানোর কথা নাহয় বাদই দিলাম৷ যে মানুষটা 'সিনেমা' নামক দক্ষযজ্ঞের এতসব যাপিত সংকট সামলাচ্ছেন, সিনেমার বিশাল বড় বাহিনীর নানা খুঁটিনাটি নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন, তিনিই আবার ক্যামেরার সামনে গিয়ে এমন দূরন্ত অভিনয় করছেন কি করে! মীর সাব্বিরের অভিনয়ে যদি খামতি থাকতো, একাগ্রচিত্তে অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে হয়তো এত কথা বলতে হতো না। কিন্তু 'রাত জাগা ফুল' এর 'পাগলাটে রইস' চরিত্রটি কি আমাদের মন জয় করেনি? নিঃসন্দেহে করেছে৷ মুগ্ধতা সেখানেই। একজন মানুষ এতদিক সামলে এসে ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন, এরপর সব ভুলে ডুবে যাচ্ছেন অভিনয়ের বিস্তীর্ণ জলাশয়ে... এ বিষয়টা দেখাও বিস্তর তৃপ্তির। পাশাপাশি, যে গানগুলো তিনি লিখেছেন, সেগুলোর কথা আর না-ই বা বললাম। সিনেমাতেই দ্রষ্টব্য।
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, এই দেশের গণ্ডি ক্ষুদ্র হলে কি হবে, এই ক্ষুদ্র গণ্ডির মানুষেরই নানা বিষয়ে মতের মিল খুব কম। বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমরা ক্রমশই বিবাদগ্রস্থ জাতি। আমাদের যে সংস্কৃতিক্ষেত্র সেখানেও বিবাদ বেশ প্রকট। একের সাথে অন্যের রেষারেষি, গঠনমূলক সমালোচনার অভাব, পিঠ চাপড়ে প্রশংসায় কার্পণ্য... নানা বৈপরীত্য৷ কিন্তু এরকম এক বিরুদ্ধস্রোতের আধিপত্যের ইন্ডাস্ট্রিতেও 'রাত জাগা ফুল'কে কেন্দ্র করে দেখলাম অন্যরকম চমকের এক দৃশ্য। বলা ভালো, 'রাত জাগা ফুল' যেন ধরেবেঁধে সবাইকে নিয়ে এলো এক সারিতে। শিল্পক্ষেত্রের কলাকুশলীরা, সোজা বাংলায় আমরা যাদের 'তারকা' বলি, তারা যেভাবে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করলো বিশেষ এ সিনেমা এবং সে সিনেমার কারিগর মীর সাব্বিরকে নিয়ে, তাতে বিস্তর মুগ্ধ হলাম। প্রয়াত গুণী অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান এই সিনেমার অল্প একটু অংশ দেখেই বলেছিলেন- এই সিনেমা মানু্ষ পছন্দ করবে নিশ্চিত৷ তিনি মীর সাব্বিরকে আশীর্বাদ করেও বলেছিলেন-
তোরে আগেই বলছিলাম, তুই সিনেমার মানুষ।
বিশেষ এই কথারই রেশ শুনলাম মীর সাব্বিরের সহকর্মী অনেকের মুখে, যাদের সবার কথাতেই ক্রমশ ঘুরেফিরো এলো, ছিমছাম সুন্দর এক সিনেমার কথা, এক অচেনা মীর সাব্বিরের কথা।
গাজী রাকায়েত, জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, বিজরী বরকতুল্লাহ, নাদিয়া আহমেদ, তানভীন সুইটি, শাহরিয়ার নাজিম জয়, অনিমেষ আইচ, সিয়াম আহমেদ, চয়নিকা চৌধুরী, সানি সারোয়ার... অভিনেতা থেকে নির্মাতা, নাটক থেকে সিনেমা, প্রবীণ থেকে নবীন... সবাই যেভাবে একের পর এক গুণমুগ্ধ প্রশংসা করলেন সিনেমাটির, বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে এরকমটা আগে হয়েছে কি? খুব একটা মনে পড়ে না। এবং কথা বলার সময়ে অধিকাংশেরই চোখের কোণে যেভাবে চিকচিক করছিলো অশ্রুবিন্দু, সিনেমার সার্থকতা যেন ঠিক সেই নেত্রকোণেই হয়েছিলো প্রকট। এই ঝাপসা চোখের পর আর বোধহয় কিছু না বললেও চলতো। তাতেও হয়তো বুঝে নেয়া যেতো সব।
মীর সাব্বির যেভাবে নিজের ক্যারিয়ারের আরেক অধ্যায় শুরু করেছেন, তা দুর্দান্ত। তিনি হয়তো নিজেও ভাবেননি, নিজের সহকর্মী ও সাধারণ দর্শকের এত ভালোবাসা তিনি পাবেন। ভালোবাসার যেমন শক্তি আছে, দায়বদ্ধতাও আছে। আশা থাকবে, সিনেমা-সংক্রান্ত তার এই দুর্নিবার শক্তি ক্রমশই সমৃদ্ধ করবে এই ক্ষুদ্র বদ্বীপের সংস্কৃতিক্ষেত্রকে। ক্রমশ একাট্টা করবে বিপরীতে অবস্থান করা মানুষকে। তাহলেই সুন্দর। সোনায় সোহাগা। ঠিক সে কারণনেই মীর সাব্বিরের জন্যে একরাশ ভালোবাসা।