রোয়ান অ্যাটকিনসন: সংলাপ ছাড়াই যিনি মানুষকে হাসিয়েছেন যুগ যুগ ধরে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

শৈশব আর কৈশোরে আমাদের বিনোদনের সবচেয়ে বড় যোগানদাতাদের একজন ছিলেন এই রোয়ান অ্যাটকিনসন, আমাদের স্বর্ণালী স্মৃতির ভাণ্ডারের অনেকখানি তো এই মানুষটার সঙ্গেই মিশে আছে...
এলা মে এবং এরিক অ্যাটকিনসনের একগাদা সন্তান। কিন্ত চতুর্থ ছেলেটাকে নিয়ে এলা’র চিন্তার শেষ নেই। বাকীরা সবাই ঠিকঠাক হেসেখেলে বেড়াচ্ছে, কথাবার্তা বলছে, এই ছেলের সমস্যাটা কোথায় এলা কিছুই বুঝতে পারছেন না। কারো সঙ্গে কথা বলে না, খুব দরকার না পড়লে মুখ খোলে না, দশটা প্রশ্ন করলে একটার জবাব দেয়, আর সারাদিন কি যেন ভাবে! জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি। পড়াশোনায় মন নেই, থিয়েটারে গিয়ে বসে থাকে দিনের বেশীরভাগ সময়। সেখানে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে বোধহয় বাড়ীতেও ফিরতো না। এই ছেলেকে নিয়ে যে কি করবেন, ভেবেই পাচ্ছেন না এলা!
তবে পরীক্ষার ফল খারাপ নয় রোয়ানের, না পড়েও কিভাবে যেন ভালো নম্বর নিয়েই পাশ করে ফেলে! স্কুল শেষ করে ঠিক করলো সে ইঞ্জিনিয়ারিঙে পড়বে, ভর্তি হয়ে গেল নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটিতে, বিষয়ের নাম ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। পরে কুইন্স কলেজ থেকে একই বিষয়ের ওপরে স্নাতকোত্তোরও শেষ করেলো রোয়ান। কিন্ত ইলেক্ট্রনিক্সের মতো কাঠখোট্টা বিষয়ে নিজেকে বেঁধে রাখার জন্যে রোয়ানের জন্ম হয়নি, স্রষ্টা তাঁকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন লক্ষ-কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, টিভি পর্দায় দর্শকদের নির্মল বিনোদনের জোগান দিতে। নামের পাশে ইঞ্জিনিয়ার ডিগ্রী লাগানোর পরও রোয়ান তাই নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। সেই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় একটা মাইলফলক ছিল, তা আমরা এখন জানি।
বারো বছর বয়সে প্রথম টিভি দেখেছিলেন রোয়ান, এর আগে থিয়েটারেই নাটক দেখতেন, একটা সময়ে অভিনয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন, নাম লেখালেন নাট্যদলে। লেখালেখিরও শখ ছিল রোয়ানের, ছোটগল্প লিখতেন অবসর সময়ে। কিন্ত সেগুলো নিজের ট্রাঙ্কে তালাবদ্ধ অবস্থাতেই পড়ে থাকতো, কেউ দেখলে হাসবে, এই ভয়টা কাজ করতো সবসময়। তখন হয়তো রোয়ানের কল্পনাতেও ছিল না, একটা সময়ে সারা দুনিয়ার মানুষকে হাসানোর গুরুদায়িত্বটা পালন করবেন তিনি, তাও বছরের পর বছর ধরে!
রোয়ান অ্যাটকিনসন- নামটা অনেকের কাছে অপরিচিত ঠেকতে পারে, কিন্ত মিস্টার বিন বললে দুনিয়ার যেকোন প্রান্তের যেকোন মানুষই লাফ দিয়ে উঠবেন, জীবনে দুয়েকবার টিভি দেখেছেন অথচ মিস্টার বিনরূপী ভদ্রলোককে চেনেন না, এমন মানুষ বোধহয় এই ধরাধামে নেই একজনও!
স্কুলে পড়ার সময় থিয়েটারে ব্যাকস্টেজে কাজ করতেন, পরে পর্দার সামনেও এসেছেন। ছোটবেলায় তোতলা ছিলেন তিনি, একটা বাক্য বলতে তিনবার হুমড়ি খেতেন। একারণে সবাই হাসতো তাঁকে নিয়ে। কিন্ত তিনি হাল ছাড়েননি। মঞ্চের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কলেজে এসেও। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবার পরে বিভিন্ন টিভি শো’তে অডিশন দেয়া শুরু করলেন, কিন্ত বারবার বাদ পড়তে হচ্ছিল তাঁর স্পিকিং ডিজঅর্ডারের সমস্যার জন্যে। যারা খানিকটা দূর্বল, তাদের জন্যে আমাদের এই পৃথিবীটা বরাবরই খুব নির্মম। সেই নির্মমতার শিকার রোয়ান অ্যাটকিনসনকেও হতে হয়েছিল।

মঞ্চে নিয়মিত ছিলেন, কমেডি নাটকে অভিনয় করছিলেন। এরমধ্যে লেখালেখিটাও চলছিল। ১৯৭৯ সালে তার লেখা স্কেচ কমেডি শো ‘নট দ্যা নাইট’ ও ‘ক্লোক নিউজ’ নামের বইয়ের মাধ্যমে পাঠক হৃদয়ে বেশ ভালোভাবে জায়গা করে নেন রোয়ান অ্যাটকিনসন। বইটি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, বেস্ট সেলিং এর তকমাটা নিজের করে নেয়। জিতে নিলেন ব্রিটিশ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ও আন্তর্জাতিক এমি অ্যাওয়ার্ডও। সেখান থেকেই লাইমলাইটে চলে এলেন রোয়ান। পরের বছর এই বই থেকেই টিভি কমিক শো তৈরী করা হলো, সেখানে প্রধান অভিনেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন তিনি! আগের বছর নিজের লেখা বই দিয়ে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন, এবার সেই বিয়ের চরিত্রে অভিনয় করে জিতলেন ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড আর বিবিসি বর্ষসেরা ব্যক্তিত্বের পুরস্কার। এই সিরিজে অভিনয় করে ১৯৮০ সালে সেরা কমেডিয়ানের পুরস্কারও ঘরে তুললেন তিনি!
১৯৯০ সালে এলো দুনিয়াকে তোলপাড় করে দেয়া মিস্টার বিন সিরিজ। এর আগে কয়েকটা টিভি সিরিজে তাঁকে দেখা গেছে, এমনকি সিনেমাতেও নাম লিখিয়েছেন, কিন্ত বিশ্বজোড়া পরিচিতি তাঁকে এনে দিলো মিস্টার বিন। হাস্যরসাত্নক এই চরিত্রটা দিয়েই মানুষের মনের গহীনে ঢুকে গেলেন রোয়ান অ্যাটকিনসন। কোন সংলাপ নেই, কিচ্ছু নেই, শুধুমাত্র বিচিত্র সব অঙ্গভঙ্গি আর মূকাভিনয় দিয়েই মানুষকে হাসিয়ে চললেন তিনি। এক-দুই বছর নয়, টানা বিশ বছর মিস্টার বিনের চরিত্রে দেখা গেছে তাঁকে, এই মানুষটার চেহারা দেখলেই আমাদের মুখটা অটোমেটিক হাসি হাসি হয়ে যেতো, এখনও যায়।
তাঁর গোবেচারা মুখটা দেখে আমরা হাসিতে গড়িয়ে পড়ি, একেকটা কাণ্ড ঘটিয়ে তিনি যখন ভাজা মাছটি উলটে খেতে না জানা লোকের মতো চেহারা নিয়ে তাকাতেন, তখন হাসি চেপে রাখা দায় হতো। শৈশব আর কৈশোরে আমাদের বিনোদনের সবচেয়ে বড় যোগানদাতাদের একজন ছিলেন এই রোয়ান অ্যাটকিনসন, আমাদের স্বর্ণালী স্মৃতির ভাণ্ডারের অনেকখানি তো এই মানুষটার সঙ্গেই মিশে আছে।
২০১২ সালে ‘মিস্টার বিন’ চরিত্রে আর অভিনয় করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, এই চরিত্রের জন্যে নিজেকে আর উপযুক্ত মনে করছেন না। টিভি সিরিজের গণ্ডি পেরিয়ে মিস্টার বিনকে দেখা গেছে রূপালী পর্দাতেও। এছাড়াও ‘জনী ইংলিশ’ অবতারেও সিনেমায় হাজির হয়েছেন তিনি, অভিনয় করেছেন আরও অনেক টিভি সিরিজ আর সিনেমায়। কিন্ত রোয়ান অ্যাটকিনসন বলতে আমরা মিস্টার বিনকেই বুঝি, অন্যকিছু নয়। যে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষটার খোলসে ঢাকা একটা শিশু বাস করতো, সেই বিনকেই আমরা ভালোবেসেছিলাম, আজও ভালোবাসি।
মানুষকে হাসানোটা দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিণ কাজগুলোর একটি, অনেকগুলো বছর ধরে রোয়ান এই কাজটা করে গেছেন অবলীলায়। সংলাপ ছাড়া মানুষকে হাসানো বা কাঁদানোর মতো দুরূহ কাজটি অনেক আগে একজন করেছিলেন, তিনি চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন। তাঁর অনেকছর পরে আরও এক ব্রিটিশ আমাদের টিভি পর্দায় মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করেই হাসিয়েছেন, তাঁর নাম রোয়ান অ্যাটকিনসন। এই মানুষটা আমাদের শিখিয়েছেন, জীবন যেভাবেই চলুক না কেন, সেটাকে উপভোগ করতে হবে, প্রানখুলে হাসতে হবে, একাকীত্বকে পাশ কাটিয়ে নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে হবে। কারণে ‘আপনার’ চেয়ে বড় সঙ্গী তো মানুষের আর কিছু নেই!