রুদ্রনীল ঘোষ: ক্যানভাসার, কমেডিয়ান, অভিনেতা...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
লম্বা একটা সময় ধরে ইন্ডাস্ট্রি রুদ্রনীলকে 'কমেডিয়ান' বানিয়ে রেখেছিল, 'অভিনেতা' হতে দেয়নি। তবু রুদ্র বাধার প্রাচীর ভেঙেছেন। তিন ইয়ারি কথায় ভেঙেছেন, চ্যাপলিনে ভেঙেছেন, প্রলয়ে ভেঙেছেন, ব্যোমকেশে ভেঙেছেন, ভেঙেছেন হাওয়া বদলে, রাজকাহিনীতে, ভেঙেছেন ভিঞ্চি দা'য়...
নন্দনের আড্ডায় একদম পেছনের সারিতে বসতো ছেলেটা, সেখানে আসন বিন্যাস হতো সিনিয়রিটির বিচারে। হ্যাংলামতো রোগা কালো ছেলেটা দু'কান উৎকর্ণ করে শুনতো, যারা আসর জমিয়ে বসেছেন, তারা কী বলছেন। সামনের সারিতে তখন চন্দন সেন, শান্তিলাল মুখার্জী, রজতাভ দত্ত, খরাজ মুখার্জীর মতো পাওয়ারপ্যাক অ্যাক্টররা বসে, ওরা তখন মঞ্চের ডাকাবুকো আর্টিস্ট, সিরিয়াল করেন, সিনেমাতেও নিয়মিত কাজ পান, আড্ডায় তাই উঠতি অভিনেতা, যারা স্ট্রাগল করছে, তারা সবাই এদের কথাই শুনতে চায়।
কোন পরিচালক কী বলেছেন, কোন স্টারের নামে কী গসিপ ছড়াচ্ছে, নাসিরউদ্দিন শাহ যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তাকে চোখের সামনে দেখে রজতাভের হাঁটুতে কেমন কাঁপাকাপি শুরু হয়েছিল; কিংবা টয়লেট খুঁজে না পেয়ে শুটিং লোকেশনের এক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করার পর পেছন ফিরে খরাজ যখন দেখলো সৌমিত্রবাবু তার দিকে তাকিয়ে আছেন- তখন তার কেমন লেগেছিল, এসব রসালো গল্প জমতো। স্বপ্ন দেখতো ছেলেটা, একদিন টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে ক্যামেরার সামনে সেও দাঁড়াবে, গেট দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান আর বাধা দেবে না।
ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবার, বাড়িতে পড়ালেখার চল ছিল, অভিনয়ের সঙ্গে ছিল না দূর-দূরান্তের সম্পর্কও। পড়তে হবে, তাই গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করেছিলেন রুদ্রনীল। কিন্ত ওই নিয়মিত জীবনের অংশ হতে ইচ্ছে করতো না, ভরাট গলায় জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করা রুদ্র বরং ফড়িং আর দোয়েলের জীবনের খোঁজেই মত্ত থাকতেন। অভিনয় করবেন, এই ব্রত নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়, বাড়িতে বলে এসেছিলেন চাকরির খোঁজে যাচ্ছেন। অভিজ্ঞতা বলতে কলেজে করা কয়েকটা মঞ্চনাটক, আর কিছুই নেই। উঠলেন শহর কলকাতার বাইরে ঘিঞ্জি একটা এলাকায়, এক মেসবাড়িতে। এক রুমে গাদাগাদি করে আট-নয়জন থাকা, ওটাকে আসলে থাকা বলে না, যুদ্ধ বলে।
নিজের খরচ তো চালাতে হবে, তাই একটা কোম্পানীর হয়ে মাছের ঔষধ বিক্রি করতেন দোকানে দোকানে, ক্যানভাসারের মতো। হাওড়া থেকে রবীন্দ্র সদনের দূরত্ব চৌদ্দ কিলোমিটার প্রায়, গোটা রাস্তা হেঁটে পার হতেন মাঝেমধ্যেই, কে দেবে বাস ভাড়ার টাকা? নেতাজী নগর গাছতলায় রাত বারোটার পর তরকারী আর রুটির দাম অর্ধেক হয়ে যেতো, রুটি ঠান্ডা, তরকারিটা টক হয়ে এসেছে- সেটা দিয়েই উদরপুর্তি করেছেন দিনের পর দিন। বন্ধুর জামা-জুতো-বেল্ট পরে অডিশন দিতে গেছেন, টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিতে পারেননি মাসের পর মাস। এসব দিন রুদ্রনীল পার করেছেন দাঁতে দাঁত চেপে।
এত অভাব, রিজেকশন আর স্ট্রাগলের মাঝেও জেদ ছিল ষোলো আনা, যা তা রোল তিনি করবেন না। কেউ হয়তো ডেকেছে তাকে, বলেছে- 'তোমার কাজ দেখেছি একটা, শুভাশীষের ডেটটা পাচ্ছি না, কাঞ্চনও তো ব্যস্ত, আমার সিনেমায় একটা কমেডিয়ানের রোল আছে, করবে?' রুদ্রনীল জবাব দিতেন- 'কী করতে হবে আমায়? খালি গা হতে হবে? কাদায় ঝাঁপ দিতে হবে? গলায় টাই চড়াতে হবে, তাই তো? করব না!' পায়ের তলায় মাটি ছিল না, ছিল বুকভর্তি আত্মবিশ্বাস, নিজেকেই নিজে বলতেন- 'ওরা জানে না আমি কি জিনিস!'
আসলেও হয়তো জানতো না। চ্যাপলিনের পর জেনেছে। ওই একটা সিনেমা, আমায় এত ধাক্কা দিয়েছিল, মাথা থেকে সেই শূন্য শূন্য বোধটা সরতে সময় নিয়েছিল অনেকদিন। সেই থেকেই রুদ্রনীলকে আমার ভীষণ পছন্দ। ছেলে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, মারা যেতে পারে যে কোন মুহূর্তে, আর বাবাকে তখন বিয়ের পার্টিতে লোক হাসাতে হচ্ছে, নিজের কান্নাটা লুকিয়ে রেখে! সন্তানকে বাঁচাতে অক্ষম এক পিতার আকুতি সেদিন আমায় স্পর্শ করেছিল তীব্রভাবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, 'কে হবে সেরা চ্যাপলিন' টাইপের একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্বয়ং চার্লি চ্যাপলিন নাকি তৃতীয় হয়েছিলেন। আমার মনে হয়, প্রথম বা দ্বিতীয় যারা হয়েছিলেন সেই প্রতিযোগিতায়, তাদের কারো জন্মান্তর ঘটেছিল রুদ্রনীলের মাঝে। চ্যাপলিনে এতটাই নিখুঁত ছিলেন রুদ্র।
যদিও গত এক-দেড় বছরে নামের পাশে কালিমা তিনি নিজেই লাগিয়েছেন, অ্যাক্টিভ পলিটিক্সে এসে। শুরুতে বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামেরা নির্মূল হলো, রুদ্রনীল ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের সাথে মিশে গেলেন, ক্ষমতা আর পদও বাগিয়ে নিলেন। বিজেপির হাওয়া দেখে ভোল পালটে গায়ে গেরুয়া বসন চড়ালেন। গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী অবস্থানে রুদ্রনীলকে দেখে আফসোস হয়েছে, এমনটা হওয়া তো একজন শিল্পীর কাজ নয়। নির্বাচনে হেরে মুখে চুনকালি মাখিয়েছেন মুখে, বেফাঁস কথাবার্তা বলে জন্ম দিয়েছেন বিতর্কের। রুদ্রের গল্প করতে গেলে তাই তার 'রাজনীতিবিদ' ইমেজটাকে একপাশে সরিয়ে রাখাটাই ভালো।
যে মাপের অভিনেতা তিনি, সেই অনুযায়ী ভালো কাজের পরিমাণ কম। বলতে গেলে তালিকাটা দীর্ঘ হবে না খুব একটা। কারন লম্বা একটা সময় ধরে ইন্ডাস্ট্রি রুদ্রনীলকে 'কমেডিয়ান' বানিয়ে রেখেছিল, 'অভিনেতা' হতে দেয়নি। তবু রুদ্র বাধার প্রাচীর ভেঙেছেন। তিন ইয়ারি কথায় ভেঙেছেন, চ্যাপলিনে ভেঙেছেন, প্রলয়ে ভেঙেছেন, ব্যোমকেশে ভেঙেছেন, ভেঙেছেন হাওয়া বদলে, রাজকাহিনীতে, ভেঙেছেন ভিঞ্চি দা'য়। এতসবের ভীড়েও আমি চ্যাপলিনের বংশী দাসকে মনে রাখব আজীবন। এই চরিত্রটা আমার অনেকগুলো রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, সেজন্যেই হয়তো...