আশফাক নিপুণ যে দুর্দান্ত ওয়েব সিরিজ বানানোর ক্ষমতা রাখেন, তার প্রমাণ আমরা গত বছরেই পেয়েছি। 'মহানগর' বোধকরি এযাবৎ নির্মিত দেশীয় সমস্ত ওয়েব সিরিজের তালিকার শীর্ষের দিকেই থাকবে। এরকম নির্মাণ যার, সেই নির্মাতা যদি নতুন কিছু নিয়ে আসেন, তা নিয়ে প্রত্যাশা থাকবেই। এবং এ প্রত্যাশা প্রাসঙ্গিকও। এবার, সে প্রত্যাশার সিকিভাগও যদি পূরণ না হয়, বিপত্তি সেখানেই। যেটা হয়েছে এবার, 'সাবরিনা'র বেলায়।

ধরা যাক, আপনি একটা ওয়েব সিরিজ বানিয়েছেন। এবং সেই ওয়েব সিরিজের গল্পে সমসাময়িক নানা বিষয়কে এনেছেন। পলিটিক্যাল ইনজাস্টিস থেকে মার্কেট সিন্ডিকেট, মিডিয়া মুঘল থেকে এমএলএম ফ্রড...বাদ দেননি কিছুই। তবুও ওয়েব সিরিজটা মনে দাগ কাটলো না। কেন? কারণ, আপনার নির্মাণের সাবপ্লট কিংবা সাইডকিকগুলোর প্রধানতম দায়িত্ব যা, অর্থাৎ নির্মাণের মূল গল্পকে সমর্থন দেয়া, সেখানেই তারা হয়েছে ব্যর্থ। তারা গল্পে সমর্থন তো দিতে পারেইনি, বরং নির্মাণের মূল গল্পই এতটা 'সার্ফেস লেভেল' থেকে ভাবা, যা অধিকাংশক্ষেত্রেই চর্বিত চর্বণ মনে হয়েছে। ঠিক সে কারণেই দর্শক একাত্ম হতে গিয়ে ক্রমশই বিচ্যুত হয়েছে গল্প ও গল্পাশ্রয়ী নির্মাণ থেকে। 

এবং ঠিক এটাই হয়েছে আশফাক নিপুণের সাম্প্রতিকতম ওয়েব সিরিজ 'সাবরিনা'র ক্ষেত্রে। নির্মাণের যে গল্প, সে গল্পকে কেন্দ্র করে যদি আরো দুই-তিন বছর আগেও কেউ কিছু বানাতো, সবাই বেশ প্রসন্নচিত্তেই গ্রহণ করে নিতো সেটিকে। কিন্তু গত বেশ কিছু বছরে দেশীয় নির্মাণের মান এতটাই বেড়েছে, এতই গভীর ও বর্ণময় একেকটা কাজ হয়েছে, আতশী কাঁচ দিয়ে খুঁজেও তাই এই নির্মাণের খুব বেশি ভালো দিক পাওয়া গেলো না। এবং 'সাবরিনা'র নির্মাতা আশফাক নিপুণও বিগত অতীতে মহানগর, কষ্টনীড় কিংবা ভিক্টিম এর মতন এত এত ভালো কাজ করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই তুলনা চলে এলো সেসবের সাথে। ফলাফল- প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি একবিন্দুতে এলো না। তৈরী হলো বড়সড় তফাৎ। অসন্তোষের এও এক কারণ। 

ভালো লেগেছে অর্ষার অভিনয়! 

ফিরি 'সাবরিনা'র মূল গল্পে। মোটা হরফে- গল্প খুবই গড়পড়তা। 'সাবরিনা' নামের এক গৃহিনীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পরে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে কে বা কারা। যদিও শেষপর্যন্ত তাকে পুরোপুরি নিকেশ করা সম্ভব হয়না। অগ্নিদগ্ধ সাবরিনাকে অচেতন অবস্থায় রাস্তায় পায় কিছু পথচারী। তারাই তাকে নিয়ে আসে হাসপাতালে। পাকেচক্রে, সাবরিনার ট্রিটমেন্টের দায়িত্ব পড়ে যে ডাক্তারের উপরে, তার নামও সাবরিনা। ডাক্তার সাবরিনা নেমে পড়ে এই হত্যাচেষ্টার রহস্য উদঘাটনে। আস্তে আস্তে 'কেঁচো খুঁড়তে কেউটে'র মতন আসে এমএলএম ফ্রড, রাজনীতির দৌরাত্ম্য, নারীর অসহায়ত্ব'সহ বহুকিছু। যদিও এর কোনোকিছুই নতুন না৷ গল্পবয়ানেও আহামরি কোনো নতুনত্ব নেই। শেষটায় তৃপ্তির ঢেঁকুর? না, তাও নেই। কারণ, গল্প শেষ হয়নি। তাকে টানা হবে দ্বিতীয় সিজনেও। পাশাপাশি, অনেক লুপহোলেরই উত্তর মেলেনি। যদিও সেসব নিয়ে কিছু বলাও যাবে না। কারণ, দ্বিতীয় সিজনে কি হবে কেউ জানেনা। অগত্যা, ঝিনুক নীরবে সহো! 

'সাবরিনা'র অভিনয়ে যারা রইলেন তারা কেউ খারাপ না। মেহজাবীন চৌধুরী, নাজিয়া অর্ষা, ইন্তেখাব দিনার, হাসান মাসুদ, রুনা খান, ইয়াশ রোহান, এজাজুল ইসলাম কিংবা ফারুক আহমেদ... খারাপ অভিনয় না কারোরই। কিন্তু, অভিনয় খারাপ না হলেও কিছু চরিত্রের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আছে সংশয়। বিশেষ করে- 'হাসান মাসুদ' যে চরিত্রে অভিনয় করলেন সেটি। 'কমিক রিলিফ' এর দায়িত্ব তার উপরেও থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে তা আরোপিতই মনে হয়েছে। গল্পেও আহামরি ভূমিকা নেই তার। দুই গোয়েন্দা- এজাজুল ইসলাম ও ফারুক আহমেদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাদের উপস্থিতি 'হুমায়ূন আহমেদের নাটক' এর সেই সুসময়ের কথা বারবার মনে করালেও তাদের ভূমিকাও গল্পে খুব বেশি গভীর না। 

মেহজাবীন চৌধুরীর চরিত্রও আরেকটু খোলতাই হতে পারতো

আশফাক নিপুণ যে এর চেয়ে আরো দুর্দান্ত ওয়েব সিরিজ বানাতে পারেন, তার প্রমাণ আমরা গত বছরেই পেয়েছি। 'মহানগর' বোধকরি এযাবৎ নির্মিত বাংলাদেশি সব ওয়েব সিরিজের তালিকায় বেশ শীর্ষের দিকেই থাকবে। এরকম নির্মাণ যার, সেই নির্মাতা যদি নতুন কিছু নিয়ে আসেন, তা নিয়ে প্রত্যাশা থাকবে। থাকবেই। এবং এ প্রত্যাশা প্রাসঙ্গিকও। এবার, সে প্রত্যাশার সিকিভাগও যদি পূরণ না হয়, বিপত্তি সেখানেই। যেটা হয়েছে এবার। আশা করি, 'সাবরিনা'র দ্বিতীয় কিস্তি এই ভুলগুলো কাটিয়ে উঠবে। গল্প আরেকটু জটিলে যাবে, চিত্রনাট্য আরেকটু গতিশীল হবে। আশফাক নিপুণ চমকপ্রদ কিছু বানাবেন। সেটাই রইলো আশাবাদ।  রইলো বিস্তর শুভকামনাও। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা