
'সাদা প্রাইভেট' এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই, যাপিত জীবনের জটিলতার বাইরে গিয়ে মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে ভাবলো এ গল্প। ভাবালো আমাদেরও। এবং এই ভাবানোর ক্ষমতাতেই এ নির্মাণ সার্থক। পাশাপাশি, যেহেতু নিজের জীবনের সাথেও মিললো এই গল্প, তাই তারিয়ে তারিয়েই উপভোগ করলাম পুরোটা...
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বেশ অদ্ভুত। আয়োজনেই এদের ফুরিয়ে যায় প্রয়োজন৷ আবার, প্রয়োজন উবে যায় আয়োজনেই। কপট অভিনয়ে এই প্রকোষ্ঠের মানুষেরা মেনেও নেয় সব। 'সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ' নামক প্রচণ্ড অবাস্তব লাইনটিরও তারাই প্রতিনিধি। সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ যে হয়না... এটা তাদেরও জানা। তবু নিজেদের প্রবোধ দিয়ে যান তারা। হাহাকারের শরীরে জড়ান সুখী মানুষের জামা। করেন অভিনয়। যে অভিনয় চলে আমৃত্যু।
এরকম এক মধ্যবিত্ত পরিবারেরই কর্তা বজলুল সাহেব। যিনি ছোট ছোট আনন্দ নিয়ে বিস্তর ভাবেন। যিনি ছোটখাটো সুখকে পরম মমতায় আগলান। যিনি নাতিদীর্ঘ সন্তুষ্টিকে পূর্ণদৈর্ঘ্য উৎসাহে পরিবারের মধ্যে ছড়িয়েও দেন। অনাড়ম্বর আবহে, নানা সুখে-অসুখে এভাবেই কাটে দিন। এরইমধ্যে, বজলুল সাহেব একদিন পান এক সুসংবাদ৷ তিনি জানতে পারেন- তাকে অফিস থেকে গাড়ি দেয়া হবে। যে গাড়িই মূলত 'সাদা প্রাইভেট।'
এই 'গাড়িপ্রাপ্তি'র সংবাদ বজলুল সাহেবের নিস্তরঙ্গ জীবনে বেশ বড় সংবাদ হয়ে ধরা দেয়। তিনি আকাশকুসুম কল্পনা করেন। গাড়ি নিয়ে কি করবেন, গাড়ি থাকলে পরিবারের সবার কি সুবিধে হবে... এসব নানাকিছু। তিনি এতটাই উৎসুক হন, গাড়ি পাওয়ার আগেই গাড়ির ড্রাইভারও রেখে বসেন তিনি। সেই ড্রাইভার সেলিমের সাথে রিক্সায় তিনি অফিস যান। গাড়ি থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট... নানা কিছু নিয়েই কথা বলেন। যদিও যে গাড়ি নিয়ে বজলুল সাহেবের এত আগ্রহ, এত সাতপাঁচ ভাবা, কোনো এক অদ্ভুত কারণে সে গাড়ির আসা ক্রমাগত বিলম্বিত হয়৷ পাশাপাশি, ফিকে হয় আশাও। শেষমেশ এ প্রশ্নও গজায় মনে- বজলুল সাহেব শেষমেশ গাড়িটা পাবেন তো? 'সাদা প্রাইভেট' এর যে স্বপ্ন বজলুল সাহেব বহন করছেন বুকে, সে স্বপ্ন জগদ্দল পাথর হয়েই বুকে চেপে বসবে না তো?
'সাদা প্রাইভেট' উপন্যাস খুব যে আহামরি, এমনটা না। উপন্যাসের শেষটাও যে খুব অন্যরকম, তাও না। তবুও, এ গল্প কোথাও গিয়ে ভীষণ মন খারাপ করায়। 'গাড়ি'কে যেভাবে মেটাফোরিক্যালি রেখে মধ্যবিত্ত জীবনের নানাবিধ অনুভূতির শেকড় ধরে এ উপন্যাস টান দেয়, তা কোথাও গিয়ে আমাদের অংশই হয়ে যায়। কিছু বিষয় অবশ্যই বৈচিত্র্যের প্রয়োজনে ভাবা হয়েছে। সেটুকু বাদ দিলে বাদবাকি অংশের সাথে আমরা খুব ভালোভাবেই যেন রিলেট করতে পারি। এবং, ঠিক সেজন্যেই, এ গল্প শুধুমাত্র বজলুল সাহেব আর তার পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। তা হয়ে যায় আমাদেরও গল্প।
পাশাপাশি, অন্যান্য যেসব দিক, যেমন হতে পারে- শফিক-নীরার গভীর কথোপকথন, রেস্তোরায় মঞ্চস্থ হওয়া সূক্ষ্ম জীবনবোধ , নীরার মায়ের সহজসরল জীবনাচরণ, বাবা-মা'র সাথে সন্তানের দূরত্বের ইঙ্গিত... সবকিছু বেশ ভালোভাবেই গল্পকে টানে। গল্পকে সঙ্গত দেয়। বোঝায়- মধ্যবিত্ত জীবনের এইসব দিনরাত্রিতে টুকরো দৃশ্যেরা কেউই ফেলনা না, সবাই-ই প্রাসঙ্গিক।

যেকোনো গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করেন চরিত্রেরা, গল্পাশ্রয়ী নির্মাণকে শিল্পীরা। সে কাজ এখানেও খুব দারুণভাবে হয়। 'বজলুল সাহেব' চরিত্রে তারিক আনাম খান দুর্দান্ত। চরিত্র বুঝে অভিনয়ে তিনি খুঁত রাখেন না। ইরফান সাজ্জাদ, রুকাইয়া জাহান চমকের অভিনয়ও ভালো লাগলো। বিশেষভাবে ভালো লাগলো দুটি মানুষের অভিনয়। একসময়ের প্রিয় অভিনেত্রী ফারহানা মিঠুকে অনেকদিন পরে দেখলাম টিভি-পর্দায়। নির্ভেজাল সাদামাটা গৃহকর্ত্রী চরিত্রে কি দারুণ অভিনয়ই না তিনি করলেন! মুগ্ধ হলাম। দ্বিতীয়ত, ভালো লাগলো, 'ড্রাইভার সেলিম' চরিত্রে জিয়াউল হক পলাশের অভিনয়। কমিক রিলিফ হওয়ার পাশাপাশি কিছু জায়গায় খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বার্ডেন ছিলো তার। সেসব ছিমছামভাবেই সামলালেন তিনি। আলাদাভাবে, এই দুজন শিল্পী তাই নজর কাড়লেন। ভালোভাবেই কাড়লেন।

যদি 'সাদা প্রাইভেট' এর ট্রেলারে গল্পের অনেকটুকুই বলে দেয়া না হতো, যদি মাঝের কিছু টানাপোড়েন কমানো হতো, যদি শেষের এন্ডিংটা একটু অন্যরকম হতো, আরেকটু আনপ্রেডিক্টেবল হতো শেষাংশের চমক, তাহলে হয়তো আরেকটু ভিন্ন দ্যোতনায় ছুঁয়ে যেতো এ নির্মাণ। তবে, সেসব না হয়েও যা হয়েছে, সেটুকুই এ নির্মাণকে মনে রাখার জন্যে যথেষ্ট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাগলো এটাই, যাপিত জীবনের এত জটিলতার বাইরে গিয়েও কেউ মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে ভাবলেন এবং সে ভাবনা নাটক হয়ে উঠে এলো পর্দায়। যে ভাবনা ভাবালো আমাদেরও। এবং এই ভাবানোর ক্ষমতাতেই এ নির্মাণ সার্থক। পাশাপাশি, যেহেতু নিজের জীবনের সাথেও মিললো এই গল্প, তাই তারিয়ে তারিয়েই উপভোগ করলাম পুরোটা। মূলত সেজন্যেই তাই এ নির্মাণ রেকোমেন্ডেড।